somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পপকর্ন খেতে খেতে ফিল্ম দেখা পছন্দ করি না: কার্লোস রেগাদাস (৪র্থ কিস্তি)

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(গত বইমেলায় (২০১০) ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত রুদ্র আরিফ ও বিজয় আহমেদ সম্পাদিত ‌‌ফিল্মমেকারের ভাষা বইটিতে একটি অধ্যায় অনুবাদ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বইটি দশজন বিখ্যাত ল্যাটিন আমেরিকান চলচ্চিত্রকারের জীবনী ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের সংকলন। আমার অনূদিত অধ্যায়টি ছিলো মেক্সিকান ফিল্মমেকার কার্লোস রেগাদাস কে নিয়ে। সামু ব্লগাদের জন্য কিস্তি আকারে অনুবাদটা প্রকাশ করলাম। এ পর্বে থাকছে নিজের তিনিটি ফিচার ফিল্ম সম্পর্কে কার্লোসের বক্তব্য)
কিস্তি ১
কিস্তি ২
কিস্তি ৩

বিষয়: নিজের নির্মিত ফিচার ফিল্ম জাপান ও ব্যাটেল ইন হ্যাভেন : পর্ব ১


সাক্ষাৎকারক : ‘জাপান’ ফিল্মে একাকীত্বের প্রবল উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
কার্লোস রেগাদাস : বিমূর্ত আলোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অন্তর্দ্বন্দ্বে আপনি সম্পূর্ণই একা। কেন ও কীভাবে একজন এই অন্তর্দ্বন্দ্বে যাপিত হয় সে বিষয়ে খুব আগ্রহী আমি। আপনি এটা করেন, কারণ আপনি বিবেকবান, অসাধারণ এবং আলাদা। ‘জাপান’ একজন মানুষের জীবনের নিজস্ব ধারণাগত অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে নির্মিত। এখানে অন্তর্দ্বন্দ্বটি প্রণোদিত হয়েছে ক্রিয়ার মাধ্যমে।

সাক্ষাৎকারক : 'জাপান' এ কিছু জায়গা তো ইচ্ছে করেই প্রহেলিকায় রেখে দেওয়া হয়েছে।
কার্লোস রেগাদাস : যুক্তি দিয়ে এগুলো সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ফিল্মে এর প্রয়োজন নেই। কুয়াশায় নেওয়া শটটি কুবই কুয়াশাচ্ছন্ন। মার্কোস বিস্ফোরণের কাছেই ছিল। তারপর একটা শক্তি তাকে পাহাড়ের চূড়োয় ছুড়ে দেয়। এর কোনো সতর্কসংকেত ছিল না।
আর আবহাওয়ার অবস্থা একে ব্যাখ্যা করে কেউ কিছু দেখছিল না, মানুষ কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল, সব জায়গায় নীরবতা নেমে এসেছিল এবং মার্কোস শুধু পালাতে চেয়েছিল; কারণ, সেই মুহূর্তটা ছিল পরম শান্তির।
আমার মতে বাস্তব ব্যাখ্যা প্রয়োজনীয়। কিন্তু সেটা কোথায়-কখন-কীভাবে ঘটেছে তার উপর নির্ভর করে ঐসব উপাদান রহস্যময়, প্রহেলিকাপূর্ণ ও প্রতীকি হয়ে ওঠে। ফিল্ম-অনুবাদের নিজস্ব স্বাধীন জায়গা থাকা দরকার। কারণ, এটি অন্যান্য ফিল্মের মতো প্রচারণামূলক নয় যে, একটি প্রতিক্রিয়ামূলক বার্তা দেবে যা পর্দা সরালেই যাবে হারিয়ে।
আমার ফিল্মে দরকার হলে পর্দার অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু পর্দার বাইরে, বিশেষ করে প্রদর্শের পর মানুষের মনে দাগ কাটতে পারলেই হলো।

সাক্ষাৎকারক : আপনার ‘জাপান’ ফিল্মে পল্লী এলাকার চিত্রায়ণ এবং গ্রামের সঙ্গে আবেগের গুরুত্ব ছিল খুব। কিন্তু আপনার ‘ব্যাটল ইন হেভেন’ ফিল্মটিতে অনেক বেশি শহুরে ও বিষন্ন। কেন এই অমিল?
কার্লোস রেগাদাস : মেক্সিকোর পল্লী এলাকায় চিত্রায়নের পর আমি খুব চেয়েছিলাম মেক্সিকো শহরে কাজ করতে। ক্যামেরার মুভমেন্ট কমিয়ে দৃশ্যের বিভিন্ন এঙ্গেলের ইন্টারকাট করা বেশি প্রয়োজন সেটা আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ, এতে বিভিন্ন দৃশ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় জায়গা বের করা সম্ভব। বড় এক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই এটাকে ধরে নিই আমি। ফিল্মে দৃশ্য কাটার ছন্দপতনটাই আমার সবচেয়ে বেশি ভালোলাগে।
শহরে কাজ করাটা বাস্তবিক অর্থে অনেক কঠিন ছিল। বিভিন্ন জায়গায় অনুমতি নেওয়া, তিন’শ জন মানুষ নিয়ে ঘোরাঘুরি করা খুব ঝামেলার ছিল।

সাক্ষাৎকারক : যেভাবে শহুরে জায়গায় আপনি অসাধারণভাবে সুর সংযোজন করেছেন ক্রমাগত ঘটনাকে সুষ্টি করার জন্য, এ ফিল্মে সেই ব্যাপারটি আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো, ক্যামেরা জানে না কোনো শট শুরুর পরে কোন জায়গায় থামতে হবে। হুটহাট করেই আশ্চর্য সব জায়গায় শট নেওয়া হয়েছে। যেমন ধরা যাক, হুইলচেয়ারে বসে থাকা মানুষটার অপ্রত্যাশিত কাট করার দৃশ্য। তবে এটা তো প্রায়ই ঘটে, যখন কিছু ঘটার আগেই জায়গাটা ঠিকমতো নির্মাণ করা যায়। একটা ভালো উদাহরণ হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড দৃশ্যটি। এখানে একজনকে অনুসরণ করার জন্য ক্যামেরা ক্রমাগত ডানে-বামে ঘুরছে, যা দেখে মনে হয়, ছোট শিশু পর্দাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। এবং আবার ক্যামেরা ঘুরিয়ে বিপরীত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো আরেকটি চরিত্রকে অনুসরণ করার জন্য, যে বুড়ো মানুষের মতো শটের ভেতর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঢুকে পড়ছে।
কার্লোস রেগাদাস : আমি ঘাসফড়িং ও পিঁপড়ের গল্পের মতো কখনোই ফিল্মে গল্প বলায় আগ্রহী না। আমি বরং মানুষের মনের অবস্থাকে অনুধাবন করতে ও ফুটিয়ে তুলতে চাই। আমি এর পরিকল্পনা করি না; বরং একে আমি অনুভব করি। ক্যামেরাকে আমি কোনো কিছু বর্ণনার জন্য, অনুভবের উপাদান কিংবা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাই।
তাই আমি কল্পনা করি, আমি চরিত্রের ভেতরে রয়েছি, এবং যেভাবেই হোক, ক্যামেরাও চরিত্রের ভেতরে উপস্থিত।
ক্যামেরা এমন একটা জিনিস, যা আপনাকেও দেখায়, আবার আপনার পছন্দের বিষয়আশয়ের চারপাশকেও দেখায়। ক্যামেরা অন্যকে আপনার চোখ দিয়ে যা বোঝাচ্ছেন, তা দেখায় না। আর এভাবেই আমি একটি চরিত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি ওবং তার উদাহরণ আপনি যে দৃশ্যের উল্লেখ করলেন, সেটা। আপনি একটি শিশুকে দেখলেন এবং তারপর হঠাৎ অন্যদিকে আরো আশ্চর্যের কিছু ঘটছে, এবং আপনি আবার আপনার দৃষ্টি সেখানে ঘোরালেন। আর মজার বিষয় হচ্ছে, তখন বিষয়ভিত্তিক ক্যামেরাটি বস্তুনিষ্ঠ ক্যামেরায় রূপান্তরিত হলো হুট করে একই দৃশ্যে, এবং আপনি পেছন দিক থেকে প্রথম মার্কোসকে দেখতে পেলেন।
নীতিগতভাবে বৈষয়িক ও বস্তুনিষ্ঠতার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনার মাধ্যমে নিজের উপর কর্তৃত্ব করতে দিতে চাই না আমি। কারণ, মানুষের মনের অবস্থাকে বোঝানোতেই আগ্রহ বেশি আমার।

সাক্ষাৎকারক : লেন্সের ব্যবহার দর্শকের কাছে খুব গাঢ় রহস্য সৃষ্টি করে, যা 'ব্যাটেল ইন হেভেনে' মার্কোসকে অপ্রীতিকর বা নিরাপত্তাহীন বা আত্মবিশ্বাসহীন জগতে টেনে নেয়।
কার্লোস রেগাদাস : আমি মনে করি, যদি এমন হয় যে, কেউ জীবনে ভয়ানক কোনো অপরাধ করলো কিংবা কারো কোনো অপরাধের কারণে কেউ মারা গেলো, তখন সে অবশ্যই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। অন্ততঃ তার মধ্যে আতংক ভর করবেই। তাই অবশ্যই সবসময় এটা একটা বোঝা হিসেবে মনে হবে, যেমনটা এ ফিল্মে মনে হয়েছে মার্কোসের কাছে।
আমরা সবসময় ভালো কিছু ঘটার প্রত্যাশা করি, যদিও ভালোর দেখা মেলা কঠিন।

সাক্ষাৎকারক : ‘জাপান’-এর গঠন হাল্কা, অপরিকল্পিত ও অসংলগ্ন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ‘ব্যাটল ইন হেভেন’ অনেক পরিপক্ক ও নিখুঁত। এই যথার্থতা থেকে ঘটনার প্রাণবন্ত বডি-ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্য দিয়ে ভাবনা ও অনুভূতিকে সুস্পষ্টভাবে রূপদানে আপনার যোগ্যতা বোঝা যায়।
কার্লোস রেগাদাস : ফিল্মের গতানুগতিক উপাদান হিসেবে সংক্ষিপ্ত ও বিভ্রান্তিমূলক গল্পকে অবলম্বন না করে আমি দৃঢ় ও নিখুঁত কিছু করতে চেয়েছিলাম। ফিল্মের মূল বিষয় হিসেবে যেটাকে আমি মনে করি, সেটা হলো পর্যবেক্ষণ। যদি পর্যবেক্ষণ না করেন, তাহলে ফিল্মটা মিস করবেন আপনি। আর এ জন্যই আমি পপকর্ন খেতে খেতে আমার ফিল্ম দেখা পছন্দ করি না। কারণ, যখন পপকর্ন মুখে তোলার জন্য আপনি বক্সের দিকে তাকাবেন, তখন হয়তো এমন কিছু মিস করে ফেলবেন যা আপনাকে ফিল্মটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ বুঝতে সাহায্য করতো।
অন্যান্য ফিল্মে হয়তো এই বিষয়গুলো উচ্চকণ্ঠে বারবার বলা হয়, তাই পর্দা থেকে চোখ সরালেও আপনার বুঝতে সমস্যা হবে না। কিন্তু আমার ফিল্ম দেখার সময় চোখ সরিয়েছেন তো মরেছেন!

(চলবে..................)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১:১২
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×