somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চা বাগানে গনহত্যাঃ ১৯৭১

২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিলেট চা বাগানগুলো একদিকে যেমন সৌন্দর্যের বিশালতা বুকে ধারণ করে আছে তেমনি সাক্ষী হয়ে আছে ১৯৭১ এর বিভীষিকাময় গনহত্যার। চা শ্রমিকদের জীবনে সেই সময়টা এখনো "সংগ্রামের সময়"। এই শ্রমিকদের বেশীরভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, আর হিন্দু ধর্মের প্রতি পাকিস্তানিদের জাত আক্রোশের কারণেই বোধহয় প্রত্যেকটা বাগানই পাকিস্তানিদের বর্বরতার শিকার হয়েছে। বাগানে যেমন গনহত্যা হয়েছে ঠিক তেমনই করা হয়েছে নারী নির্যাতন।

"গনহত্যা" কিংবা "Genocide"শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে geno এবং caedere শব্দ যুগল থেকে। গ্রীক শব্দ genoএর অর্থ হচ্ছে জাতি বা গোষ্টিএবং ল্যাটিন শব্দ caedereএর অর্থ হচ্ছে হত্যা করা। এই দুইয়ে মিলে সংক্ষেপে যা দাঁড়ায় তা হলো, "Genocide is the systematic elimination of all or a significant part of a racial, ethnic, religious, culture or national group"। উইকিপিডিয়ার এই সংজ্ঞার এক বাস্তব চিত্র পাবেন এই চা বাগানগুলোতে।

এই লেখাতে প্রথমে বাগানগুলোতে চালিত গনহত্যার কথা আলাদা আলাদা ভাবে বলার চেষ্টা করেছি। তারপর হালকা আলোচনা করেছি নারী নির্যাতন নিয়ে। এখানে বলে রাখা ভালো সব বাগানের কথা আমি বলি নাই তথ্যের অভাবে। কেউ তথ্য দিয়ে সাহায্য করলে উপকৃত হব। চা বাগানের গনহত্যা নিয়ে খুব একটা বই কিংবা তথ্য পাইনি। কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার, দুই তিনটা বই এবং বিভিন্ন সাইট থেকে তথ্য যোগাড় করে এই লেখা।

স্টার চা বাগানঃ
সিলেট শহরের তারাপুর চা বাগানে গনহত্যা চালানো হয় ১৮এপ্রিল। চা বাগানের মালিক তখন গুপ্ত পরিবার। বংশ পরম্পরায় এই পরিবারের প্রধান হয়ে উঠেন রাজেন্দ্র গুপ্ত। ১৮ তারিখের কিছুদিন আগে পাকিস্তানিরা তারবাসভবনে এসে দেখা করে তার কাছে কোন বন্দুক আছে কি না জিজ্ঞেস করে। তিনি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে তারা বন্দুকটি তাদের কাছে দিয়ে দিতে বলে। বন্দুকটি নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে বলে যায় মুক্তিবাহিনীর লোক এলে তাদের খবর দিতে।

১৮ তারিখ পাকিস্তানিরা আবারও আসে। এবার সবাইকে "ডান্ডি কার্ড" দেয়ার কথা বলে। বলে যে, এই ডান্ডি কার্ড প্রদান করার পর তারা অবাধে চলাফেরা করতে পারবেন। গুপ্ত পরিবারের সকল পুরুষ, বাগানের কর্মাচারী ও শ্রমিকদেরকে জড়ো করা হয় গুপ্ত বাবুর বাড়িতে। কার্ড ইস্যু করার জন্যে তাদের কে সিলেট রেসিডেন্সীয়াল মডেল স্কুল (ক্যাডেট কলেজ) এর দিকে মালনীছড়া হয়ে রওয়ানা দেয়। যাওয়ার সময় গুপ্ত বাবু বললনে, "সব পুরুষকে ধরে নিয়ে গেলে মেয়েরা ভয় পাবে। একজন পুরুষ মানুষকে থাকার অনুমতি দিলে ভালো হয়।" তাই ছোট ছেলে পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয়। স্কুলে যাওয়া লাগে নাই, মালনীছড়া টিলাকেই পাকিস্তানিরাবেছে নেয়তাদের নৃশংস কাজের জন্যে। মালিক ও কর্মাচারীদের এক ভাগ এবং শ্রমিকদের দুইটা ভাগ – এই তিন ভাগে আলাদা ফেলা হয় তাদের। রাজেন্দ্র গুপ্তের ভাই, দুই ছেলে ও ভাইয়ের ছেলেও ছিলেন, সাথে ছিলেন মেডিকেল অফিসার ডা ক্ষীতিশ চন্দ্র দে।

তারপর এই মালনীছড়ারটিড়ার পাশেই গুলি করা হত্যা করা হয় মালিক, কর্মচারী ও শ্রমিকদের। তাদের মাঝে সদানন্দ ও গনেশ হালদার নামক দুই শ্রমিকসৌভাগ্যক্রমে বেঁচে চলে আসে।সদানন্দেরহাটুতে গুলি লেগেছিল আর গনেশের গুলি লাগেনি। জ্ঞান ফেরার পর দুজনে ফিরে এসে সবাইকে এই গনহত্যার ঘটনা বলে।

চা বাগানে তখন কান্নার রোল চলছে। আবারও আসে পাকিস্তানিরা। পিতার লাশ দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলো রাজেন্দ্র গুপ্তের তিন মেয়েকে। রাজি না হলে জোর করে নিয়ে যাওয়া তাদের। বিকেলের দিকে একই গাড়িতে করে তিন বোনকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায় হায়েনার দল। ক্ষত বিক্ষত দেহে তিন বোনের তখন বিধ্বস্ত অবস্থা।

ঐদিনই রাজেন্দ্র গুপ্তের মেয়েরা, ডা ক্ষীতিশ এর পরিবার সহ আরো কয়েকটা পরিবার ভারতের দিকে রওয়ানা হয়। ১লা মে'র দিকে পাকিস্তানিরাআবারো আসে বাগানে। তিন মেয়েকে না পেয়ে আক্রোশে গুলি করে বাড়ির প্রহরীকে হত্যা করে। বন্দী করে নিয়ে যায় পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, নরেশ চক্রবর্তী, তার ছেলে নারায়ন চক্রবর্তী, কাজের লোক দুর্গেশ দাস ও মহেন্দ্র পালকে। ঘোষপাড়া গ্রামে নিয়ে এসে পরিত্যাক্ত একটি বাড়িতে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় তাদেরকে। ছেলেমানুষ হিসেবে পঙ্কজ কুমার গুপ্ত কে ছেড়ে দেয় তারা। পরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় লাশগুলা। এটাও জানা যায় যে, পঙ্কজ কুমার গুপ্ত তখন নাকি গুলি করার আগ মুহূর্তে বলেছিলেন, "হামকো মাত মার, হাম মুসলমান হোযায়ে গা ..." ; পরে তাকে আমানত আলী নাম দিয়ে দর্জিপাড়ার এক মুসলিম বাড়িতে রাখা হয়।

রাজেন্দ্র গুপ্তের বেঁচে যাওয়া সেই ছেলে পঙ্কজ কুমার ১৯৮৮ সালে তারাপুর চা বাগানের কেন্দ্রস্থলেই ঐদিনের ৩৮ জন শহীদদের স্মৃতিতে নির্মাণ করেন 'শহীদ স্মৃতিসৌধ'। বাগানে ঘুরতে গেলেই এটা আপনার চোখে পড়বে।


লাক্কাতুরা ও কালাগুল চা বাগান
সিলেট শহরের খুব পাশেই অবস্থিত লাক্কাতুরা চা বাগান আমাদের খুব পরিচিত জায়গা। তখন এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। বাগানের ব্যবস্থাপকের বাসভবনের একটু দূরেই আছে শ্রমিকদের ঝুপড়ি। মানবেতর জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই শ্রমিকরা যেমন ছিল শিক্ষা দীক্ষা থেকে অনেক দূরে তেমনি দূরে ছিল যাবতীয় রাজনীতি থেকে।

এই শ্রমিক কলোনিতে একদিন হাজির হয় পাকিস্তানি বাহিনী। "আগুন ধরিয়ে দেয় তাদের গোটা বস্তিতে। মুহূর্তে কলোনির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে আগুলের লেলিহান শিখা। নিজের চোখের সামনে যখন মাথা গোজার শেষ আশ্রয়টুকুওদাউদাউ করে জ্বলেউঠলো, তখন শ্রমিকরা প্রাণ নিয়ে পালাতে চেষ্টা করেন।" এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন দলদলি চা বাগানে; রক্ষ হয় না। ভোর বেলাতেই আবার সেখানেই আগমন ঘটে পাকিস্তানিদের। নিঃস্ব শ্রমিকরা এবার আশ্রয় নেয় কালাগুল চা বাগানে।

কালাগুল চা বাগান শহর থেকে প্রায়১৫ কিলোমিটার দূরে। যাওয়ার রাস্তাটা খানিক দুর্গম হওয়াতে তখন এই এলাকাটাকে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবেই মনে করতেন। তাই এখানে মোটামুটি অনেকেই এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৩ এপ্রিলের দিকে এই দুর্গম এলাকায় আক্রমন চালায় পাকিস্তানিরা। বাগানে ঢুকেই ব্যবস্থাপকের বাংলোয়্ উঠে পাকিস্তানিরা। সেখানে অবস্থান নিয়ে চারিদিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। শুরু করে গোলাবর্ষণ। প্রাণ রক্ষার জন্যে বাগানের শ্রমিকরা শুরু করলেন ছোটাছুটি; কেউ কেউ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন, কেউবা পলায়নরত অবস্থায়ই শহিদ হলেন আর কেউ কেউ ধরা পড়লেন পাকিদের হাতে। অনাহারে অর্ধাহারে বেঁচে থাকা হাড্ডিসার মানুষগুলার ভেতর থেকে তুলনামূলক সজীব শ্রমিকদের আলাদা করে চোখ বেধে নিয়ে যাওয়া বাগেনের পাশেই এক স্থানে। ঐ স্থানটাকে বলা হতো 'কাঠালতলি'। একে একে সবাইকে সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন কালোগুনা লোহার, কোষ লোহার, সাধু বাউরি, তুফান লোহার, ভীম লোহার, মিঠাই লোহার সহ অন্তত ১৫ জন। "নিহত শ্রমিকদের লাশ পড়ে থাকে ঘটনাস্থলেই। সরাবার বা সৎকার করার গরজও অনুভব করেনি কেউ কিংবা সে সুযোগও মেলেনি।" কেননা, ঐদিনই দেশ ছেড়ে সবাই ছুটে যান ভারতের দিকে।

কালাগুল থেকে যাওয়ার পথে আরো জীবিত শ্রমিকদের সন্ধান পায় পাকিস্তানিরা। এদের ধাওয়া করে নিয়ে যাওয়া হয় গুলনী চা বাগান পর্যন্ত। সেখানে পলায়নরত অবস্থায় হত্যা করা হয় গনেশ ছত্রী ও সিতারামকুর্মিকে। পুড়িয়ে দেয়া হয় বাগানও। নারী নির্যাতন ও চলে নির্বিচারে।

খাদিমনগর চা বাগান
সিলেট শহর থেকে মাইল পাচেক পূর্ব দিকে হযরত শাহ পরানের মাজারের পাশেই অবস্থিত খাদিমনগর চাবাগান একাত্তরের গনহত্যার আরেকসাক্ষী। ২৮মার্চ খাদিমনগর চাবাগানের তিন নম্বরের বস্তিতে হানা দেয় পাকিস্তানিরা। সবে তখন সকালটা শুরু হয়েছে। ঘুম থেকে তুলে শ্রমিকদের নির্দেশ দেয়া হয় একসাথে জড়ো হতে।বস্তির মধ্যবর্তী জায়গায় সবাই একসাথে জড়ো হলে তাদের কে দুই গ্রুপে বিভক্ত করে দেয়া হয়; এক গ্রুপে নারী – শিশু, আরেক গ্রুপে পুরুষ।নারী - শিশুদের দলটাকে তারপর বিশ্বহরির ঘরে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকিরা। তাদের গগন বিদারী কান্নার চিৎকারে কিছুটা হলেও দয়ার উদ্রেক হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিকটির। চুপিসারে পিছনের দরজাটি খুলে দিয়ে তাদের বের করে দেয়।ঘরটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

পুরুষের দলটিকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট স্থানে।মৃত্যুর সম্মুখে মানুষ প্রাণপনে লড়াই করে কিভাবে প্রাণটা রক্ষা করা যায়।প্রাণরক্ষার্থেতাই শেষ চেষ্টা হিসেবে অনেকেই প্রাণপনে দৌড় শুরু করে। কেউ কেউ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আর যারা পারেনি তাদেরকে বস্তির পুব দিকে একটি ছোট নালার পাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কতজনকে হত্যা করা হয় তার ঠিক হিসাব পাওয়া যায় নি। যগীন মালী, মহেন্দ্র মালী, নবকুমার মালী, উপেন্দ্রকুমার মালী, বিজয়কুমার মালী, ভেড়ী ভাগাল মালী, বাবুরাম মালী, বাবুচান্দ মালী, লাল বাবু ,আলী, ছনুয়া মালী সহ আরো অনেকেই ছিলেন সেই হতভাগাদের মধ্যে। বিজয়ের পর শরনার্থী শিবির থেকে ফিরে এসে শ্রমিকরা দেখেন তাদের ভাইদের কঙ্কাল পড়ে আছে যত্রতত্র।

অতঃপর পাকিস্থানিরা মেতে উঠে তাদের বিকৃত যৌন লালসা মেটাতে। ধর্ষনে ধর্ষনে ক্ষত বিক্ষত করে তুলে অসহায় স্বামী – পুত্র হারা শ্রমজীবী নারীদের দেহ।

খাদিম নগর চাবাগানের ব্যবস্থাপক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। তখন তিনিও চলে গেছেন। বাগানের অনেক শ্রমিকও তখন পাড়ি জমিয়েছেন পাশের দেশের শরনার্থী শিবির গুলোতে। এই বাগানে তখন আস্তানা গেড়েছে আরেক পাকিস্তানি কর্মকর্তা। ১৯ এপ্রিল তার নির্দেশে জড়ো করা হয় বাগানে অবস্থান রত সকল শ্রমিকদের। রেশন দেয়া হবে বলে সকল শ্রমিকদের নিয়ে ঢুকানো হয় ব্যাবস্থাপকের বাংলোর পিছনের এক কোয়ার্টারে। সবাইকে ঢুকিয়ে তারপর দরজা বন্ধ করে দেয় পাকিরা। প্রথমে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে টিয়ারগ্যাসের সেল। গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে ছটফট করতে থাকে ৪৬টি প্রাণ। তারপর শুরু করা হয় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ।একে একে প্রাণ হারান ৪৪জন। দুই জন বেচে যান আলৌকিক ভাবে।দুর্গাহাজং, মতিলালহাজং, দিলীপহাজং, বানোয়ারীলালহাজং, হাড়োছত্রী, ভানুছত্রী, চরুনায়েক সহ আরো অনেকেই ছিলেন সেই ৪৪ জনের মধ্যে। অবশ্য কিছু কিছু দৈনিক অনলাইন নিউজপোর্টালে দেখলাম এখানে নিহতের সংখ্যা ২১ বলে উল্লেখ করেছে।

এখানে ধর্ষন করা হয় বাতাসিয়া রুহিদা সহ আরো অনেক শ্রমজীবি মহিলাকে।

মালনীছড়া চা বাগানঃ
৬ এপ্রিল বিকাল সাড়ে চারটার দিকে মালনীছড়া চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপকের বাসভবন পাকিস্তানিরা ঘেরাও করে। শওকত নওয়াজ তখন এই বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক। তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক মানুষ, অকুন্ঠ সমর্থন করছিলেন অসহযোগ আন্দোলনকে। উল্লেখ্য, ১৮৫৪ সালে স্থাপিত বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান হিসেবে স্বীকৃত এই মালনীছড়া চা বাগানের মালিকানা ১৯৭১ সালে ডানকান ব্রাদার্স লিমিটেড এর হাতে ছিল।

২৬ মার্চ শওকতনওয়াজের ছোট ভাই শাহনওয়াজ এবং তার দুই বন্ধু মেজবাহউদ্দিন ও আব্দুল কাদের তার বাসায় উঠেন। চা বাগানের তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান করছে; মেজর সরফরাজ একটি লাল গাড়িতে চড়ে টহল দিত পুরো এলাকাজুড়ে। অনেকেই তখন শওকত নওয়াজকে উপদেশ দিত বাগান ছেড়ে পালিয়ে যেতে; কিন্তু তাকে রাজি করানো যায়নি।

৬ এপ্রিল তারিখে তার বাসভবন থেকে শওকতনওয়াজ, তার ছোট ভাই ও দুই বন্ধু মেজবাহউদ্দিন ও আব্দুল কাদের সহ আরো ছয়জন অধীনস্থ কর্মচারীকের ধরে আনে। বাগানের ভেতর তখন কামানের গর্জনে অন্যান্য শ্রমিকেরা প্রাণ বাচাতে দৌড়াতে থাকে দিগ্বিদিক। বন্দী এই ১০ জনকে অতঃপর একই স্থানে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্থানি পশুরা। বিজয়ের পর বধ্যভূমি থেকে সন্তানের কঙ্কাল উদ্ধার করেন শওকত নওয়াজের বাবা।

শওকতনওয়াজ মার্চ মাসে তার বোনের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির কিছু অংশ তার কবরের গায়েও লেখা আছে,
"... যদি আমরা বেচে থাকি তবে দেখা হবে। আর দেশের জন্য যদি প্রাণ হারাই, তার জন্যে দুঃখ নাই। তবে ভীরু কাপুরুষের মতো মরব না। ... আমরা এখান থেকে যতদূর সম্ভব দেশের কাজ করে যাব।"

আমার দেশের শহীদের কেউই ভীরু কাপুরুষের মতো মরেন নি।

কেওয়াছড়া চা বাগানঃ
এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে কেওয়াছড়া চা বাগানে গনহত্যা চালানো হয়। আকারে ক্ষুদ্র এই চা বাগান বিমান বন্দরের পাশেই অবস্থিত।

বাগানে ঢুকেই পাকিস্তানিরা শুরু করে ব্যাপক হারে অগ্নিসংযোগ; শ্রমিক বস্তির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে আগুনের লেলিহান শিখা। নির্বিচারে চলে লুটপাট। নিরুপায় খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা তখন নিজেদের জান বাঁচাতে জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াচ্ছে, দৌড়ে পালাচ্ছে। পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি জানোয়ারদের হাতে ধরা পড়ে যান সনেশ দাস, বছিয়া দাস, অতুল দাস, মাখন দাস, বিনোদ, রবিয়া, পাটুরিয়া মুড়া, শ্রীরামচরন দাস ও শ্রীকৃষ্ণ দাস। তাদের চোখ বেধে নিয়ে যাওয়া হয় বাগানের ভেতর তেলচিবড়া বস্তিতে। যে কারনেই হোক, অতুল দাস ও মাখন দাসকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে বেধে রাখা হয়। অতঃপর বাকি শ্রমিকদের সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে কিছুক্ষন মানসিক অত্যাচার করে গুলি করে হত্যা করে পাকিজন্তুরা।

পুরো শ্রমিক বস্তি তখন ছাই ভস্মে পরিণত হয়েছে। বাগানের সহকারী ব্যাবস্থাপক ছিলেন তখন সৈয়দ সিরাজুলআব্দাল। এই ঘটনার আরো কয়েকদিন আগে পাকিস্তানীরা বাগানে এসে তাকে তার বাংলো থেকে গ্রেফতার করে সিলেট কারাগারে বন্দী করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বাংলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এপ্রিলের ৫ তারিখ কারাগার ভাঙ্গার পর জেল থেকে তিনি মুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে থাকেন। কিছুদিন পর পাকিস্তানীরা কুলাউড়াতে তার শশুর বাড়িতে গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করা হয় স্বাধীনতাকামী এই মানুষটাকে।

খান চা বাগানঃ
জৈন্তাপুর উপজেলার অন্তর্গত খান চা বাগানে ১৭ এপ্রিল সারাদিন কাজ করিয়ে রাতের আধারে ১৭ জনকে হত্যা করা হয় নির্মম ভাবে।

খান চা বাগানের মালিক তখন একজন অবাঙ্গালী। ঐদিন সকালে পাকিস্তানিদের জলপাই রঙয়ের সামরিক কনভয়গুলো রাস্তায় দেখা মাত্রই বাগানের শ্রমিকেরা তাড়াহুড়ো করে ভারতে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। জৈন্তা থেকে সীমান্তখুব একটা দূরেও নয়। কিন্তু মাইল তিনেক পথ অতিক্রম করার পরেই পথ আটকায় পাকিস্তানীরা। বাগানে ফিরে যেতে বাধ্য করে শ্রমিকদের। এর মধ্যে শক্ত সামর্থ্য ১৭ জন যুবককে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হয়।

সারাদিন এই ১৭ জন পাকিস্তানিজন্তুদের নানা ফরমায়েশ খাটে; কখনো বাংকার খনন করায়, কখনো গোলাবারুদ বহন করায়। রাতে খরিস সেতুর বাম পাশে খনন করায় গর্ত। সে গর্তে লুকিয়ে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয় তাদের। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শ্রমিকরা গর্তে ঢুকার পরপরই পাকিস্তানি জন্তুদের রাইফেল জলে উঠে।

গর্তেই পড়ে থাকে আমার ভাইদের লাশ - বংশী মাঝী, নন্দলাল বাড়াই, অগুকুরুয়া, ছিকরাকুরুয়া, মকরাকুরুয়া, বধু সাওতাল, আকলাভুইয়া, পুষুয়াকুরুয়া, ছম্রাকুরুয়া, রামচান্দকুরুয়া, হীরালাল কুরুয়া, মংরু কর্মকার ও ভীম কুরুয়া।

ভাড়াউড়া চা বাগান ও শ্রীমঙ্গলঃ
শ্রীমঙ্গল শহরের পাশেই অবস্থিত ভাড়াউড়া চা বাগানে গণহত্যা চালানো হয় পহেলা মে। অবশ্য এই তারিখটা নিয়ে কিছুটা ভিন্নতম পাওয়া যায়। ড. এম এ হাসানের "যুদ্ধ ও নারী" বইতে পহেলা মে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্লগে কয়টা লেখাতেও তারিখটা পহেলা মে উল্লেখ করা আছে। আবার ৭১ এ সিলেটের যুদ্ধাবস্থা নিয়ে বেশ তথ্যমূলক কয়েকটা বই আছে তাজুল মোহাম্মদের। তার "সিলেটে গনহত্যা" ও "সিলেটের যুদ্ধকথা" দুই বইতেই তারিখটা ২৭ মার্চ বলে দেয়া আছে। মৌলভীবাজারেরকয়টা স্থানীয় নিউজ পোর্টালে তারিখটা ৩০ এপ্রিল দেয়া আছে। তবে গনহত্যার কথা সব জায়গাতেই একই রকম ভাবে বলা আছে।

২৫ শে মার্চের পর পরই অনেক শ্রমিকই ধীরে ধীরে দেশ ছেড়ে ভারতের দিকে পাড়ি জমাচ্ছেন। ভাড়াউড়া বাগানের অবাঙ্গালী ম্যানেজার তখন চলে গিয়েছেন। পহেলা মে সকালে বাগানে আগমন ঘটে পাকিস্তানি সেনাদের। স্থানীয় এক দালাল ই তাদেরকে নিয়ে আসে বাগানে। কালিঘাট ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ অমৃত হাজরা কে পাঠিয়ে পুরো বাগানবাসীকে তলব করে পাকিরা। মতলব বুঝে অনেকেই তখন পালিয়ে যায়। পালাতে গিয়ে অনেকেই ধরা পড়ে পাকিস্তানিদের হাতে।

বাগানে ঢুকেই সমস্ত শ্রমিকদের বাংকার খননে যেতে হবে বলে নির্দেশ দেয়া হয়; পাশাপাশি আশ্বাস দেয়া হয় যে, পাকি আর্মি তাদেরকে পাচ গুন বেশী মজুরী দিবে। সেই সাথে তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষন ও দেয়া হবে বলে ঘোষনা দেয়। বন্দি সকল শ্রমিককে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীমঙ্গল মহাবিদ্যালয়ের পাশে রাহামড়ারপুলে। তারপর পুলের পুব পাশে সবাইকে লাইন ধরে দাড় করিয়েব্রাশফায়ার করে পাকিস্তানি জানোয়াররা। সেখানেই প্রাণ বিসর্জন দেন ৪৬ জন নিরীহ শ্রমিক। তবে সঠিক সংখ্যাটা আরো বেশীও হতে পারে। অনেকেই সে সংখ্যা ৫৭ পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন। রামদাড়ী হাজরা, কেদার হাজরা সহ অনেকেই সৌভাগ্য ক্রমে বেঁচে যান ঐ দিন।

সেদিনের সকল শহীদদের নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তবে যাদের পাওয়া গেছেন তারা হলেন্– হোছনী হাজরা, চিনি লাল হাজরা, গূরা হাজরা, কৃষ্ণ চরণ হাজরা, মহারাজ হাজরা, রামলাল হাজরা, ফাগু হাজরা, নুনু লাল হাজরা, মংগুরা হাজরা, কুমার চান্দ তুরিয়া, সমমাঝি, নকুলা হাজরা, কালা চান্দ ঘাটুয়ার, অমৃতা হাজরা, ক্ষুদিরাম হাজরা বীরবলি হাজরা, রামদেও হাজরা, সুখ নন্দন রিকিয়াচরন, ইন্দ্র ভুইয়াশিবমূড়া সহ আরো অনেক।

এই বাগানেও বীভৎস নারী নির্যাতন চালানো হয়। সৌভাগ্যক্রমেবেচে যাওয়া কেদারলাল হাজরা জানান, শুধুমাত্র ভাড়াউড়া বাগানেই ৪৫ জন নারী আর্মিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। সে নারী নির্যাতন নিয়ে একটু পরেই বলছি।

শ্রীমঙ্গল এলাকা দখল নেয়ার পরপরই পাকিস্তানীরা সেখানকার চা বাগানেও ব্যাপক গনহত্যা চালায়। রাজঘাট চা বাগানের শ্রমিক নেতা পবন তাতিকে হত্যা করে পাকিরা। তার সাথে হত্যা করা হয় শংকর দেবনাথ ও ফুসকরি বাগানের শম্ভু সিংহকে। সাধু বাবার গাছ তলায় হত্যা করা হয় সিন্দুরখানের গোবিন্দ চরণ সোম, সোনাতন ব্যানার্জি, রাঝঘাট বাগানের বাসুতাতী ও ফুলছড়া বাগানের আইমুলাকে। সিন্ধুরখান বাগানে এনে হত্যা করা হয় রাঝঘাটের সন্তোষ কর্মকারকে। সিশেলবাড়ি চা বাগানের কুশো ও নিমাই নামে দুজনকে দেশীয় দালালরা পাকিদের দ্বারা হত্যা করায়।

মির্জাপুর বাগানে ১২ মে'র দিকে প্রবেশ করে বাগানের ব্যাবস্থাপক অঘোর ভট্রাচার্য, মেডিকেল অফিসার ডা রাখাল চন্দ্র দাশ, ডেসারহরিয়া দেব, চা ঘর বাবু প্রেমনালবড়ুয়া ও গুদাম বাবু নলিনী কুমারকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে আসে। তারপর কোথায় কখন কিভাবে তাদের হত্যা করা হয় আর জানা যায় নি।

দেওড়াছড়া চা বাগানঃ
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই চা বাগানে গনহত্যা চালানো হয় ৩ এপ্রিল। এই বাগানের ম্যানেজার ছিল একজন বিহারী। ২৫ শে মার্চের কিছু আগে ম্যানেজার বাগান ছেড়ে চলে যায়। ২৫ শে মার্চের পর অনেক কর্মাচারীরাও বাগান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। বাগানের শুধু রয়ে যায় অনাহারে অর্ধাহারে নির্জীব দেহের শ্রমিকেরা। ৭০ এর নির্বাচনে তাকে ভোট না দেয়ার কারনে মৌলভীবাজারের তখনকার মুসলিম লীগ নেতা এসে তাদের তখন নিয়মিত ভয় দেখাতেন।

৩ এপ্রিল বাগানে প্রবেশ করে পাকিস্তানীরা। মুসলিম লীগ নেতার শাসানী আর বাগানে মিলিটারী জিপের প্রবেশে তারা আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। অনেকেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। বাগানে ঢুকেই পাকিস্তানীরা অসহায় গরীব শ্রমিকদেরকে রেশন দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে একত্র সবাইকে জমা করে। সাথে করে নিয়ে আসা একটি বেসামরিক বাসে শ্রমিক দের উঠতে নির্দেশ দেয়া হয়। প্রায় ৭০ জন শ্রমিককে বাসে ভর্তি করে বাস রওয়ানা দেয় মৌলভীবাজার শহরের দিকে। তবে একটু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরই বাস একটি খাদে পড়ে যায়। শ্রমিকদের তখন বাধ্য করা হয় বাসটি টেনে তুলতে। ঘটনাস্থলেই আরেক পাকিমেজররের আগমন ঘটে। সবাইকে একটি নালার পাশে নিয়ে বিবস্ত্র করে তাদের পরিধেয় বস্ত্র দিয়ে হাত পা বেধে ফেলা হয়। তারপর শুরু করে নির্বিচারেগুলিবর্ষণ।
মোহিনী গোয়ালা, রবি গোয়ালা, মহেশ কানু, নারাইল কুর্মী সহ ১২ জন সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেচে যান। আহত অবস্থায় ভারতে গিয়ে এই ১২ জন চিকিৎসা করান। তাদের মাধ্যমেই জানা যায় এই নির্মম হত্যকান্ডের খবর।

আর যারা ত্রিশ লক্ষ শহিদের খাতায় নাম লিখিয়ে যান তাদের অনেকেরই নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। তবে এদের মধ্যে ছিলনে,উমেশসবর, হেমলাল কর্মকার, লক্ষনমূড়া, বিজয় ভূমিক, আকুল রায় ঘাটুয়ার, মাহীলাল রায় ঘাটুয়ার, বিনোদনায়েক, সুনারাম গোয়ালা, প্রহ্লাদনায়েক, মংরুবড়াইক, বিশ্বনাথ ভুঁইয়া , শাহজাহানভুইয়া, ভাদোভুইয়া, আগুন ভুইয়া, জহন গোয়ালা সহ আরো অনেকেই।

স্তানীয় দালাল রা সক্রিয় ছিল এসব হত্যাকান্ডে। তারাই পরে শ্রমিক ঝুপড়ি গুলোতেলুটপাট চালায়। নারী নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে এই বাগানে।

লালচান চা বাগান ও নালুয়া চা বাগানঃ
চুনারুঘাট থানায় অবস্থিত এই দুই চাবাগান ই সীমান্তের কাছাকাছি হওয়াতে এ দিক দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রবেশ করতেন। লালচান চা বাগান থেকেই নিয়মিত পরিকল্পনামাফিকঅপারেশন পরিচালনা করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ এসে অবস্থান ও নিত এই বাগানে। মুক্তিযোদ্ধাদের এমন আনাগোনার খবর পৌছে যায় পাকিস্তানিদের কাছে। আক্রমন করে লালচান চা বাগান।

মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে আক্রোশে বাগানের হতদরিদ্র নিরীহ ১৩ জন শ্রমিককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি জানোয়ারের দল। ধরে নিয়ে আসে শায়েস্তাগঞ্জে। এই ১৩ জনকে দিয়ে খোড়ানো হয় বিরাট কবরের মত গর্ত। এই গর্তের পাশে লাইনে সারিবদ্ধ ভাবে দাড় করিয়ে অতঃপর পাকিস্তানিজন্তুরা হত্যা করে ১৩ জনকে।

নালুয়া চা বাগানে ২০ মে'র দিকে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানিদের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানীরা সুবিধা করতে না পেরে কয়দিন পরে দেশিয় দালাল আবদুল হাসিমকে নিয়ে আবারো হানা দেয় বাগানে। এবার আক্রমণ করে চা শ্রমিকদের উপর। ধরে এনে হত্যা করা হয় ১৬ জন শ্রমিককে। এদের মধ্যে ছিলেন – আবদুল গফুর, নীলাম্বর রূদ্রপাল, জামলীমুন্ডা, চুনডেমুন্ডা, হাগরু জরা, আলী রাজা মুড়া, মংলু জরা সর্দার, রুদ্রমুড়া সহ আরো অনেকে।

চুনারুঘাট থানার চান্দপুর চা বাগানে হত্যা করা হয় আরো ৩ শ্রমিককে। দেওয়ানদি ও লস্করপুর বাগানেও চালানো হয় ব্যাপক হত্যাকান্ড।

তেলিয়াপাড়া চা বাগান ও সুরমা চা বাগানঃ
হবিগঞ্জের মাধবপুর থানায় অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা বাগানেই ৪ঠা এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ইউনিট গুলির কমান্ডারগন একত্রিত হন যুদ্ধের জন্যে কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে। এখানেই জেনারেল ওসমানীকে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়।

২৯ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক তুমুল যুদ্ধের পর চরম আক্রোশে পাকিরাঝাপিয়ে পড়ে বাগানের শ্রমিকদের উপর। প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয় বহু সংখ্যক শ্রমিককে। সকলের নাম পরিচয় জানা সম্ভব হয় নাই। আনন্ত পান, অনন্ত পান, মানব পান, বিরাট পান, ছানি খ্রিষ্টান, অর্জুন ছবর সহ আরো অনেকেই ছিলেন সে শহীদদের মধ্যে।

তেলিয়াপাড়া চা বাগানের কিছুদিন পরই পাকিরাআক্রমন করে সুরমা চা বাগান। আগুন লাগিয়ে দেয় শ্রমিকদের বাসস্থানে। অত্যাচার করা হয় বহু শ্রমিককে। এই বাগানে বিহারী অন্তরায়, প্রেম সিংহ, চান্দামুন্ডা, বিদ্যাচারণবাগচী, বলিগোর, চুনুসাওতাল কে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে বলিগোরকেহতযা করা হয় বাজার থেকে ফিরে আসার পথে। রাস্থায়হাটার সময় গুলি করে হত্যা করা হয় চুনুসাওতালকে।

নারী নির্যাতনঃ

সিলেটের প্রতিটা চা বাগানে গনহত্যার পাশাপাশি চালানো হয় ব্যাপক নারী নির্যাতন। তারাপুর চা বাগানে গনহত্যা চালানোর পর আর্মি এসে তুলে নিয়ে যায় বাগানের মালিক রাজেন্দ্রলাল গুপ্তের তিন মেয়েকে। ক্ষত বিক্ষত দেহে পরে তিন বোনকে নামিয়ে দিয়ে যায়। খাদিম নগর চা বাগানে ধর্ষিত হয় অসংখ্য চা শ্রমিক। নির্যাতিত বাতাসিয়া রুহিদাসহ বহু মহিলাই চলে গেছেন দেশ ছেড়ে।

চা শ্রমিকরা ধর্ষনকে "বেইজ্জত" বলে। পার্বতী বুনারজী তখন কালাগুল চা বাগানে স্বামী সন্তান সহ সবাইকে নিয়ে কাজ করতেন। এক মধ্যরাতেপাকিআর্মিরা তাদের ঘরে ঢুকে। "সে রাতে একজন আর্মিই আমার ঘরে ঢুকেছিল। সে ঢুকেই ঘরের দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিয়েছিল। ... আমার স্বামীর সঙ্গে ঐ মিলিটারির খুব দস্তাদস্তি হয়। ...শেষ পর্যন্ত আমার স্বামী আমার শরীরের ওপর শুয়ে পড়ে আমাকে আগলাতে চেষ্ট করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। ওরা জোর করে আমাকে নির্যাতন করেছে।"

"আমাকে ছাড়াও কালাগুল চা বাগানের আরও অনেক মহিলাকে পাকিআর্মিরা সে সময় নির্যাতন করেছিল। আমার সামনের ঘরের এক মহিলাকেও তারা বেইজ্জত করেছিল। দুটো বউ ছিল ঐ বাড়িতে। একজন তো ভয়ে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে নিজের ইজ্জত রক্ষা করেছে। আর একজনকে তারা ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে নির্যাতন করেছে...।"

শ্রীমঙ্গল চা বাগানের পুণ্যবতী ঘাসী বলেছিলেন, "নির্যাতনের কিছু বাকী রেখেছে নাকি? দশটার সময় তো আমাকে আটকালো। আর বারোটার দিকে একজন আর্মি ঘরে ঢুকে আমাকে ধর্ষন করল। তখন বাইরে আরো দশ বারোজন আর্মি দাঁড়িয়েছিল।... তাদের কোন কথা বার্তা লাগত না। তারা ধরবে, পটাকবে (ফেলে দিবে) তারপর ইজ্জত সম্মান মেরে যাবে। খেজুরছড়ারলক্ষী নামের একটা মেয়েকে আকেবারে আমার চোখের সামনে নির্যাতন করে শেষ করে দিল।"

চুনারুঘাটের সুপ্রিয়া নায়েক তখন লষ্করপুর বাগানের থাকতেন। ৭১ এ তার বয়স হিল ১৬ বছর। পাকি জানোয়াররা তাদের বাড়িতে ঢুকে তাকে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। বাগানের ফ্যাক্টরী তখন পাকিদের ক্যাম্প। সেখান থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে তাকে নিয়ে যাওয়া হত। চানপুর বাগানের চন্ডীরকীনারবাংলোতে তারা অনেক মেয়েকে আটকে রেখেছিল। " বিভিন্ন ক্যাম্পের আর্মি অফিসাররা এই বাংলোর ক্যাম্পে এসে আমাকে ধর্ষন করতো। প্রতিরাতে চার পাচ জন করে পাকি আর্মি আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষন করেছে। কোন রাতেই তারা আমাকে নিষ্কৃতি দেয় নি।"

ভাড়াউড়া চা বাগানের ভয়ংকর নারী নির্যাতন চালানো হয়। ৫০ জনের অধিক শ্রমিক এই বাগানে চালানো গনত্যায় শহীদ হওয়ার পর শুধুমাত্র এই চা বাগানেই ৪৫ জন নারী আর্মিদের ধর্ষনের শিকার হন। সেই ধর্ষনের বিভৎসতা ফুটে উঠে গনহত্যা থেকে সৌভাগ্যক্রমেবেচে যাওয়া কেদারলাল হাজরার কথায়, "এমনকি ৫০-৬০ বছরের বৃদ্ধাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি।"

ফুলছড়া চা বাগানের মুটারী নামক একটা দেশোয়ালী মেয়েকে বাগানের ভেতরের দিকে নিয়ে গিয়ে তিন জন আর্মি পালাক্রমে ধর্ষন করেছিল। সেখানে বাগান থেকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করা হত মেয়েদের। কুমারী মৃধা জানান, " শিশিরবাড়ি বাগানের এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বেশি। আর্মিদের অত্যাচারে সেখানকার একজন মেয়ে মারা গিয়েছিল। বাগানের লোকজনের সামনেই তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল।"

আমার মা বোনদের উপর চালানো এই নির্যাতনের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

‘আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা পুতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গণহত্যা করেছে
শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।’


[শামসুর রাহমানের ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতার অংশ বিশেষ]



তথ্যসূত্রঃ
১) সিলেটে গনহত্যা–তাজুল মোহাম্মদ
২) সিলেটের যুদ্ধকথা - তাজুল মোহাম্মদ
৩) যুদ্ধ ও নারী – ড এম এ হাসান
৪) মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ–বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ



সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩২
১১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×