''এ যাত্রায় মোদি’র ভারত আর ধোনি’র ভারত এক হতে পারেনি। মোদি যেভাবে যতটুকু নিয়ে গেছেন, ঠিক সেভাবে ততটুকু কিংবা তার চেয়েও বেশি খুইয়েছেন টিম ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন ধোনি। তবে শেষতক তাদের জন্য সান্ত্বনার প্রাপ্তি একটাই– বাংলাওয়াশ হতে হয়নি। অন্তত একটা জয় নিয়ে দেশে ফেরার মওকা জুটেছে। সুতরাং এই সফরের সারাংশ: ধোনি এলেন, কিছু নিলেন, অনেক কিছু দিলেন এবং পরাজিত হয়ে ফিরে গেলেন।''
[লেখাটি বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সিরিজ বিজয়ের পর লেখা।]
বিদ্যুত খোশনবীশ
এ সপ্তাহে দেশে কোন রাজনৈতিক ইস্যু নেই। বললে ভুল হবে না, গোটা দেশেই এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক বাংলাদেশের মেরু এখন একটাই। আওয়ামী লীগ। যে মেরুটা উবে গেছে তার নাম ছিল বিএনপি। বোকামি, জেদ ও ভুল কৌশল রাজনীতি থেকে ছুঁড়ে ফেলেছে বিএনপিকে, পরাস্ত করেছে জটিল মেরুকরণের প্রতিযোগিতায়। বিএনপির এই অবস্থা কতদিন স্থায়ী হবে তা বলা যাচ্ছে না, তবে সাময়িক সত্য এটাই– বিএনপি এখন আর রাজনীতিতে নেই, কূটনীতিতেও নেই। যতটুকু অস্তিত্ব, তা ঐ ইফতার মাহফিলেই।
তবে রাজনীতির শূন্যতা কিংবা রাজনৈতিক ইস্যু না থাকলেও উত্তেজনার অভাব নেই দেশে। উত্তেজনার প্রাচুর্য চলছে ফতুল্লা আর মিরপুরে। এই উত্তেজনা ক্রিকেটের, এই উত্তেজনা ক্রিকেট দুনিয়ার। ১৯ বছরের একজন মুস্তাফিজ তছনছ করে দিয়েছে টিম ইন্ডিয়ার মজবুত শিবির। তবে এ বিষয়ে পরে আসছি, চলে যাই আরো আগে, জুনের পহেলা সপ্তাহে।
জুনের ৬-৭ তারিখে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন, মাত করে গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গুজরাটের ‘সাম্প্রদায়িক’ মুখ্যমন্ত্রী থেকে ভূমিধস বিজয় নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পরে পুরো বিশ্বকে মাত করে একজন ক্যারিশমেটিক বিশ্বনেতা হয়ে তার এই বাংলাদেশ সফর। মোদি’র সফরে ভারতের সাথে বাংলাদেশের গোটা বিশেক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য পাকাপোক্ত হয়েছে ২০০ কোটি ডলার ঋণ ও বিদ্যুত খাতে ৫০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। স্বাক্ষরিত এইসব চুক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সড়ক, রেল ও সমুদ্র যোগাযোগ নতুন মাত্রা পেয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার ও সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে ভারতের কৌশলগত আকাক্সক্ষা স্পষ্ট হয়েছে ও বাংলাদেশের ট্রানজিট ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা দমনের সুযোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সফরে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত যে লেনদেন হয়েছে তাতে কেউ বেশি পেয়েছে, কেউ পেয়েছে কম। হিসেবপত্র অনুযায়ী এই কমের ভাগীদার বাংলাদেশ-ই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি’র এই সফর একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর গতানুগতিক কোন সফর ছিল না। কারণ সৌহার্দ্য বলে যে একটা ব্যাপার আছে, যার অস্তিত্ব এদেশে এতদিন খুব একটা অনুভূত হয়নি, সেটা এইবার অকৃত্রিম হয়ে দেখা দিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি’র সফর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নতুন জানালা খুলে দিয়ে গেছে। এ জানালা দক্ষিণমুখী। দখিনা হাওয়ার পরশ ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ ও তার সরকার উপভোগ করতে শুরু করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সবটুকু প্রত্যাশা প্রাপ্তি হয়ে ধরা দেয়নি ঠিকই কিন্তু যতটুকু প্রাপ্তি তা অতীতকে অতিক্রম করে ঐতিহাসিক রূপ নিয়েছে। দীর্ঘদিনের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাঁধা অতিক্রম করে বাংলাদেশ এখন ভারতের সেরা দক্ষিণ-এশিয় বন্ধু। ফলে, মোদি’র ঢাকা সফর ২০১৫-তে ইতিহাস হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা। শুধু প্রধানন্ত্রী হিসেবে নয়, ব্যক্তি হিসেবেও। কারণ এই সফরে বাংলাদেশের যতটুকু প্রাপ্তি তার পেছনে দুই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সদিচ্ছা ও উদ্যোগ অনেক বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
২০১৪ সালে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে মোদি’র বিজয় ঝড়ো হাওয়া হয়ে আঘাত করেছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ক্ষমতা ধরে রাখা ও ক্ষমতায় যাবার পথ প্রশস্ত করতে সে সময় মোদি বন্দনা ও মোদি’র জন্য প্রার্থনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলই। ফলে প্রধানমন্ত্রী মোদি’র টেবিলে বাংলাদেশ সফরের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল বেশ ত্বরিত গতিতেই। সে দাওয়াত তিনি কবুল করলেও বাংলাদেশে আসতে তাড়াহুড়ো করেননি মোটেও। সময় নিয়েছেন পুরো এক বছর। বাংলাদেশের আগে গত এক বছরে ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানী ও চীনসহ ১৮টি দেশ সফর করেছেন তিনি। এ বছরই আরো ১২টি দেশ সফর করার কথা রয়েছে তার। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক ও বিশ্বনেতা হবার আকাক্সক্ষা থেকেই তিনি চেয়েছিলেন, অতীতকে বদলে দিয়ে তার বাংলাদেশ সফরকে ফলপ্রসু করতে। সে লক্ষ্যেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের জন্য মূল্যবান উপহার নিয়েই হাজির হতে। তার সে উপহারটি ছিল সুদীর্ঘ ৪১ বছর ধরে লোকসভায় ঝুলে থাকা মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তির অনুমোদন। তবে এই চুক্তির অনুমোদনকে ভারত উপহার ভাবলেও আমরা তা ভাবি না। এটা দীর্ঘ দিনের বকেয়া, এটা আমাদের পাওনা। ন্যায্য প্রাপ্য কখনও উপহার হতে পারে না। তাই, মূলত এই চুক্তির অনুমোদন দিয়ে ভারত ঋণমুক্ত হয়েছে। আর অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচয় জুটেছে শত শত নিরীহ ও রাষ্ট্রহীন মানুষের কপালে। বিচ্ছিন্ন ছিটমহলগুলো এখন বাংলাদেশ। রাষ্ট্রপরিচয়হীন বিপন্ন মানুষগুলো এখন বাংলাদেশি, নিখাদ বাংলাদেশি। মোদিকে সাধুবাদ, সাধুবাদ শেখ হাসিনাকেও।
তবে নরেন্দ্র মোদির এই ঐতিহাসিক লেনদেনের সফরেও পুরোপুরি ঋণমুক্ত হতে পারেনি ভারত-রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তার প্রাপ্য তিস্তার জল পায়নি। কবে পাওয়া যাবে তাও কেউ বলেননি, কারণ বলতে পারেননি। যিনি বলতে পারেন তিনি পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি এসেও ছিলেন, হেসেও ছিলেন কিন্তু কিছুই বলেননি। বাংলাদেশের জলের ইলিশ খেয়ে চলে গেছেন নিমর্ম বেগে। আগের বার যদিও তার আশ্বাস মিলেছিল কিন্তু এবার হাসি ছাড়া আর কিছুই মিলেনি। বলা চলে, তিস্তার জল এখন তিস্তারও নয়, মোদিরও নয়। এ জল শুধুই মমতার।
এজন্যই হয়তো তিস্তা চুক্তি নিয়ে কিছুই করার ছিলো না নরেন্দ্র মোদি কিংবা শেখ হাসিনার। ফলে তিস্তার জল দিতে না পারলেও মোদি নিয়ে গেছেন অনেক কিছু। স্থল, রেল ও সমুদ্র ট্রানজিট, সেভেন সিসটার্স রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ দমনের সহজ-সরল পথ ও সেই সাথে চীনের ‘মুক্তার মালা’ থেকে একটি মুক্তা। সেই মুক্তার নাম বাংলাদেশ। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রভাবশালী সাময়িকী দি ডিপ্লম্যাট-এর বিশ্লেষণে এ কথাটিই ফুটে ওঠেছে। চীন তার মূল ভূখন্ড থেকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ হয়ে পোর্ট সুদান পর্যন্ত সামরিক ও বাণিজ্যিক ঘাটি স্থাপন করে যে ‘মুক্তার মালা’ তৈরি করতে চলেছে তা অনেকটাই গুড়েবালি হয়ে গেছে মোদি’র এই সৌহার্দ্য ও আস্থা সৃষ্টির সফরে। শুধু চীনের নয়, জাপানের ভাগ্যেও হাত দিয়েছেন তিনি। কারণ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন যে উচ্চতায় পৌঁছেছে তাতে খুব সম্ভবত ২০১৭ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য নির্বাচনে বাংলাদেশের মূল্যবান ভোটটিও পাকাপোক্তভাবে এখন ভারতের। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অপরিহার্য উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বশক্তি চীন ও জাপানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের ২০৪১ মিশনের সাথে ভারত যে জড়িয়ে গেছে তা এখন আর গোপন কিছু নয়, নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যে এই সম্পৃক্ততা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মোদি’র জন্য এক বছর আগের প্রার্থনা সুফল বয়ে এনেছে আওয়ামী লীগ সরকার, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার জন্য। এসব বিবেচনায় ৩৬ ঘন্টার এই সফরের সারাংশ দাঁড়ায়: মোদি এলেন, কিছু দিলেন, অনেক কিছু নিলেন এবং বিজয়ীর বেশে ফিরে গেলেন।
২.
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বীরবেশে দেশে ফেরার পর বাংলাদেশ সফর করে গেল মহেন্দ্র সিং ধোনি’র নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দল। উদ্দেশ্য ছিল, একটি টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা। গেল ফেব্রুয়ারির বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বিতর্কিত কোয়ার্টার ফাইনালের পর এই প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশ। খেলা মাঠে গড়ালো, কিন্তু এমন খেলা নিকট অতীতে দুনিয়া আর দেখেনি। বৃষ্টিবিঘিœত একমাত্র টেস্ট ড্র হবার পর তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে শোচনীয় পরাজয়ে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হতে হল টিম ইন্ডিয়াকে। ক্রিকেট বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর দল হওয়া সত্বেও টাইগার বাহিনীর কাছে যেভাবে নাকাল হতে হলো তা অবিশ্বাস্যই ছিল বটে। এই পরাজয় অসহনীয় লজ্জার কারণ হয়েছে গোটা ভারতের জন্য। কারণ, বাংলাদেশের প্রতি তাদের অভ্যাসগত তাচ্ছিল্য।
প্রথম ম্যাচে মুস্তাফিজ ঝড়ে শোচনীয় পরাজয়ের পর ভারতীয় দর্শক-সমর্থকরা সিরিজ হারের শঙ্কায় এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল যে খেলা বন্ধের জন্য তারা প্রার্থনা করেছে। ফেসবুক-টুইটার আলোড়িত হয়েছে ‘বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা’র বাণীতে। কিন্তু ভাগ্যদেবী সহায় হননি। খেলা বিঘিœত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দুঃস্বপ্নের সিরিজ-পরাজয় থেকে রক্ষা মিলেনি। ফলে ধোনি কেঁদেছেন, টিম ইন্ডিয়া কেঁদেছে, কেঁদেছে গোটা ভারত। বিপরীতে, হেসেছে টিম বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের প্রাপ্তি যে অনেক! যে জয়টা ফেব্রুয়ারিতে মেলবোর্নে হতে পারতো সেই জয় হয়েছে ঘরের মাটিতে, জুনে। বাংলাদেশ প্রমাণ করতে পেরেছে পক্ষপাতমুক্ত খেলা হলে তারাও জেতার ক্ষমতা রাখে, হারাতে পারে যে কাউকে। হোক সে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান কিংবা ভারত। পাশাপাশি বিস্ময়বালক মুস্তাফিজের উত্থান, ক্রিকেট র্যাঙ্কিং-এ সাতের ঘর ছোঁয়া, ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে খেলার সুযোগ আর বেশ কয়েকটি বিশ্ব রেকর্ড– এসবই টাইগারদের সুখের প্রাপ্তি। বাংলাদেশের এত প্রাপ্তিতে মুগ্ধ হয়েছে গোটা ক্রিকেট বিশ্বও। এই মুগ্ধতার নায়ক লিটল বয় মুস্তাফিজ। অভিনন্দন মুস্তাফিজ।
কিন্তু এ যাত্রায় মোদি’র ভারত আর ধোনি’র ভারত এক হতে পারেনি। মোদি যেভাবে যতটুকু নিয়ে গেছেন, ঠিক সেভাবে ততটুকু কিংবা তার চেয়েও বেশি খুইয়েছেন টিম ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন ধোনি। তবে শেষতক তাদের জন্য সান্ত্বনার প্রাপ্তি একটাই– বাংলাওয়াশ হতে হয়নি। অন্তত একটা জয় নিয়ে দেশে ফেরার মওকা জুটেছে। সুতরাং এই সফরের সারাংশ: ধোনি এলেন, কিছু নিলেন, অনেক কিছু দিলেন এবং পরাজিত হয়ে ফিরে গেলেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:৫৭