এ অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ নিয়ে লেখার শুরুতে শিয়াল নামক একটা পশু, যিনি পশুকূলের মধ্যে 'ধূর্ত' এবং 'পন্ডিত' নামে খ্যাত, তার একটা গল্প বলছি।
একদা জনৈক শিয়াল মহাশয় শিকারে বের হয়ে, বাড়ীওয়ালার কুকুরের তাড়া খেয়ে পাশ্ববর্তী পুকুরে পড়ে গেল। কুকুররা তাদের কর্ম সম্পাদিত হয়েছে ভেবে প্রস্থান করার পরে, শিয়াল পন্ডিত 'জগৎ গেল' 'জগৎ গেল' বলে চিৎকার আরম্ভ করলো। গ্রামের প্রজ্ঞাবান মাষ্টার মশাই ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। শিয়ালের কান্ড দেখে ওনার হৃদয় পীড়িত হইলো। উনি শিয়াল পন্ডিতের বিপদে সাহায্য করবেন, মনস্থির করলেন। গায়ের চাঁদরখানির একপ্রান্ত পুকুরে নিক্ষেপ করলেন, শিয়াল পন্ডিত চাঁদরের অপর প্রান্ত কামড়ে ধরলে উনি টেনে টেনে শিয়ালটাকে পাড়ে তুললেন। শিয়াল পন্ডিত যারপনাই খুশি, মাষ্টার মশাইয়ের মুরগি জীবনেও শিকার করবেন না শপথ নিয়ে, মাষ্টার মশাইকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রস্থান করতে উদ্যত্ত হলো। মাষ্টার মশাই শিয়ালটির গতিরোধ করে বলল, আমার মুরগির নিরাপত্তার জন্য তোর জীবন বাঁচাইনি। তুই যে, 'জগৎ গেল' 'জগৎ গেল' বলে চিৎকার করতে ছিলি, কিভাবে জগৎ গেল তা জানার জন্য তোকে উদ্ধার করা। শিয়াল তখন বলল, মাষ্টার মশাই সহজ জিনিসটা বুঝলেন না? আমি মরে গেলে জগৎ দিয়ে কি করব? আমি মরে যাওয়া তো জগৎ যাওয়ারই নামান্তর।
এবার আমার বাস্তব দু'টি অভিজ্ঞতার কথা বিনিময় করি। শহরের উপকন্ঠে আমার বাড়ী। ২০০১-০২ সালের কথা। বাড়ীর উঠান ঘেঁষেই একটা কালভার্ট। এ কালভার্টে দখিনা বাতাসের সুমধুর প্রবাহ। শহর ফেরা মানুষরা এখানে একটু গা জিড়িয়ে অতঃপর বাড়ী যান, আজও। কালভার্টটিতে সন্ধ্যার পর থেকে মানুষের আনাগোনা কমে যেত, শুরু হতো তৎকালীন 'আজিম গ্রুপ' নামে খ্যাত সন্ত্রাসীদলের আড্ডা। গভীর রাতে তারা সেখানে অস্ত্র-পরীক্ষা করতো। কত রাত যে গুলি ছোড়াঁর বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেত! বাবা কয়েকবার থানায় অভিযোগও করেছেন, কোন লাভ হয়নি। অতঃপর, ২০০৪-০৫ সালের কোন-একদিন (তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছি না) "আজিম" তার দলবলসহ RAB এবং পুলিশের যৌথ অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল এবং সেই কালভার্টের নিচ হতে প্লাস্টিকের বস্তাবন্দি ০৮-১০ টা দেশী-বিদেশী রাইফেল উদ্ধার করলো। এরপর থেকে আর কখনোই মাঝরাতে বিকট কোন শব্দ শুনিনি।
২০০৪ সালের আগষ্টের একরাতে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসছি 'সুন্দরবন-৬' নামক লঞ্চে, চাকরির প্রথম ইন্টারভিউ দিব, যা ছিলো তার পরের দিন সকাল আটটায়-উত্তরায়। রাত তখন আনুমানিক দুইটা। হঠাৎ লঞ্চের হুইসেল বাঁজল আর আনসার দল মাইকে ঘোষনা করলো যে, লঞ্চে বোমা পাওয়া গেছে। সবাইকে নীচ তলার 'ডেকে' একপ্রকার জোড় করে এনে জড়ো করলো। আমার চিন্তা-চেতনায় শুধুই চাকরির টেনশন। চাকরিটা পেয়ে গেলেই আমার 'বেলা বোস' কে ফোন করে বলতে পারব, চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা সত্যি, হ্যালো ২২৪১১৩৯। লঞ্চ উল্টো বরিশালে যাত্রা করল, আতঙ্কে প্রান ওষ্ঠাগত- সেটা বোম এবং চাকরি, দু'টির জন্যই। অতঃপর, লঞ্চটি বরিশালে এসে পুলিশ-RAB এর বোম ডিসপোস্যাল্ ইউনিট দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবার ঢাকা যাত্রা করলো। যথাস্থানে, পৌঁছতে আমার প্রায় একঘন্টা দেরী হয়েছিলো। অনেক অনুরোধের পর কর্তৃপক্ষ আমার পরীক্ষা নিয়েছিলো এবং ২২৪১১৩৯ ফোনটা করতে পেরেছিলাম।
২০০৪ সালের ২৬ শে মার্চ RAB প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ১৪ ই এপ্রিল কার্যক্রম শুরু করে। এরপরে, ২০০৬-এ অপারেশন সূর্য দীঘল বাড়ী, অপারেশন মুক্তাগাছা, ২০০৭-এ আমিন হুদা আটক, ২০০৮-এ জান্দাল নজরুল, উজ্জল, রফিকুল এবং একজন ইয়াবা সুন্দরী 'চিত্র নায়িকা' আটক, ২০০৯-এ সাইফুল আটক, অতঃপর পিচ্চি হান্নান, জিনের বাদশা, প্রদীপ মারাক গ্রেফতার এবং শিশু পরাগ উদ্ধারসহ শত শত সফলতার পালক লেগেছে RAB এর পাখায়। RAB এ পর্যন্ত প্রায় ১২০০ জঙ্গিকে আটক করেছে এবং শুধু এ বছরই প্রায় ৬০ জন জঙ্গি RAB এর হাতে ধরা পড়েছে।
এক নাগাড়ে তেষষ্ট্রি জেলায় বোমা হামলার পরে, কে বাড়ীতে ফেরার আশায় বাড়ী ছেড়েছিল, বলতে পারবেন? সিনেমা হল, থিয়েটার, বাস, লঞ্চ, ট্রেন সবখানেই চড়তে হলে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে শরীর পরীক্ষা করতে হতো। কে নিশ্চিন্তে ভ্রমন করতে পেরেছেন অথবা সিনেমা উপভোগ করতে পেরেছেন? এই যে, ক্রসফায়ার নিয়ে এতো আপত্তি আমাদের, এটা কি আমাদেরকে কোন স্বস্তি দেয়নি? বিচার ব্যবস্থায় একটা প্রচলিত কথা আছে, 'আইনের ফাঁক গলে একহাজার অপরাধী পার পেয়ে যাক, তবু যেন এক নিরাপরাধী সাঁজা না পায়'। আর, এ সুবিধাটা নিয়ে আমাদের আইনজীবিদের হাত ধরে দাগী আসামীর পার পাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে কবে ঘটেনি? আপনি যদি ভুক্তভোগী হন, তবেই কি আপনাকে বুঝতে হবে? ভুক্তভোগী না হয়ে কি আমরা কিছু বুঝতে পারি না? আমাদের অনুভূতি কি এতোই ভোঁতা হয়ে গেছে?
যারা মানবাধিকারের ঝান্ডা ওড়ান, ওনারা তো নিজের গাড়ীতে চলেন, বাড়ীতে বিলেতি কুকুর পালেন, নিরাপত্তারক্ষী রাখেন, পুলিশ ওনাদের কথামতো ওঠা বসা করে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্ঠের কথা ওনারা বুঝবেন কি করে? ওনারা শক্তিশালী দেশের পক্ষ কবে ত্যাগ করেছেন? যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া একের পর এক কৃষাঙ্গ হত্যায় বা মধ্য প্রাচ্যের বর্বরতায় ওনাদের মুখ খুলতে কে কবে দেখেছে? তাদের সুরে সুর মেলানো আমাদের মতো সাধারণের, অজ্ঞতার নামান্তর। RAB যদি এতো জঙ্গি নিধনে সক্ষম না হতো, তবে ভেবে দেখুন তো আজ দেশের অবস্থা কি হতো? পৃথিবীর কতো শক্তিশালী দেশইতো এসকল জঙ্গিগোষ্ঠির কালো থাবায় আজ বিপর্যস্ত, তার খবর রেখেছেন কি?
এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, বাবা হিসেবে, মা হিসেবে, ভাই হিসেবে, বোন হিসেবে অথবা আপনার কর্মস্থলে আপনি কি শতভাগ সফল হতে পেরেছেন? বা বলতে পারবেন কি, কে কবে নিজ অঙ্গনে শতভাগ সফলতার দেখা পেয়েছে? তেমনি, RAB এর কাছ থেকেও শতভাগ নির্ভূলতা আশা করা কতটা বাস্তব সম্মত। দু-একটা ভুলের জন্য পুরো RAB কে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, কখনোই শুভ বুদ্ধির পরিচায়ক নয়। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, RAB প্রতিটা অপারেশন পরিচালনা করে জীবনের ঝুকি নিয়ে। তারা নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথা ভুলে, শুধু দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভেবে অপারেশন করে। তাছাড়া, RAB সদস্যরা কারা? আপনার আমার মতোই কারো ভাই, কারো বাবা, কারো স্বামী অথবা কারো পুত্র। নারায়ণগঞ্জ ট্রাজেডির পর, পুরো জাতি যেভাবে RAB এর দিকে বিষবাষ্প ছুঁড়তে ছিলো, তাতে মনে হয়েছিল, RAB যেন ভিনদেশ থেকে আগত কোন বাহিনী, যাদের সঙ্গী, জন-রোষানল।
ভবিষ্যৎ সুন্দর বাংলাদেশ বির্নিমাণে RAB এর ভূমিকা অপরিসীম। আমরা আশা করব, একটা অত্যন্ত পেশাদার এবং আধুনিক RAB বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের সরকার আরো আন্তরিক হবে এবং প্রচেষ্টা অব্যহত রাখবে।
সর্বশেষে ইতিহাস থেকে নেয়া একটা উদাহরণ দিচ্ছি। পলাশী যুদ্ধে ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে নবাব সিরাজ মাত্র ০৩ হাজার সৈন্যের ক্লাইভ বাহিনীর কাছে হেরে যায়, যা আমরা সবাই কম-বেশী জানি। আনুমাণিক, ১৭৬৪ সালে লর্ড ক্লাইভকে ভারতে অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তৎকালীন ওয়েষ্টমিনস্টার। সে ট্রায়ালে লর্ড ক্লাইভ আত্মপক্ষ সমর্থণ করে নিজ জবান বন্দিতে বলেছিল, "২৩ শে জুন যে পরিমাণ গ্রামবাসী যুদ্ধ দেখতে এসেছিল, তারা প্রত্যেকে একটা করে ঢিলও যদি ইংরেজ বাহিনীকে লক্ষ্য করে ছুঁড়তো, তাহলে ইংরেজ বাহিনী মাটিতে মিশে যেত"।
আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ছাড়া কোন শক্তির পক্ষেই যুদ্ধ জয় সম্ভব না। তাই আসুন, সবাই মিলে RAB কে সহায়তা করি এবং RAB কে নিয়ে গর্ব করি।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:১৫