somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবাসী শ্রমিক, ও আমজনতার ইংরেজি শিক্ষা

০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাস জীবন শুরুর প্রথম বিমানযাত্রা। বিমানবালা হাতে কি একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেলেন, আমি নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে সেটা হাতেই ধরে রাখলাম। হঠাৎ শুনি পাশ থেকে কেউ খুব কুণ্ঠিত স্বরে বলছে, "আপা, আমার এই ফরোমটা একটু লিখে দেন।" তার হাত থেকে কাগজখানা হাতে নিয়ে দেখলাম ডিসএম্বারকেশন কার্ড। ফ্লাইট নং কি, কোথায় থাকবে, এদেশে আগমনের কারণ এধরনের কিছু সাধারণ প্রশ্নের জবাব চাওয়া হয়েছে। বিরক্ত হয়ে বললাম, "আপনারটা আপনি লিখে ন্যান।" একটু পর উত্তর এল, প্রায় হাহাকারের মত করে, "আমি ইংরাজি পড়তে পারি না আপা।" অবাক হলাম খুব - প্লেনে করে বিদেশ যাচ্ছে অথচ এই সাধারন কয়েকটা কথা পড়তে পারে না! এই লোক বিদেশে যাচ্ছে কি করে আর গিয়ে পরে কি করবে! জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, কোম্পানির চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন, যাবার জন্য পাসপোর্ট বানানো থেকে শুরু করে ভিসা আনা, বিভিন্ন ক্লিয়ারেন্স নেয়া - এইসব কাজ করে দিয়েছ কোম্পানির লোকেরা, তাদের দিতে হয়েছে মোটা অংকের অর্থ। কারণ তিনি বাংলা লিখতে পড়তে জানলেও এসব কাজ করার মত ইংরেজি জানেন না। এখন বিদেশে কোম্পানি যে কাজ দেবে তাই করতে হবে।

সেই আমার প্রথম প্রবাসী শ্রমিক দেখা, সেটা ত্রিশ বছর আগের কথা। সেসময় মধ্যপ্রাচ্যে এদেশের শ্রমিকেরা মাত্রই যেতে শুরু করেছেন, গার্মেন্টস ব্যবসা এদেশে সবে শুরু হয়েছে। এই শ্রমিকরাই তখন দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী ছিলেন। যাহোক, সংগে থাকা কাগজপত্র দেখে আমি সহযাত্রীর কার্ড পূরণ করে দিলাম। ততক্ষণে আমার সামনে, পিছনে, পাশে থেকে অনেকেই তাদের কার্ড বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি বিরক্ত হয়ে কিছু বলব বলে একজনের দিকে তাকাতেই তার চোখ দেখে চমকে গেলাম। কি নেই তার চোখে!! কুণ্ঠা, লজ্জা,অসহায়তা, দুঃখ, আর অপারগতার গ্লানি তার দুচোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিল - সেই চোখই বলে দিচ্ছিল যে এদের সবার কাহিনী আর প্রথম সহযাত্রীর কাহিনী একই। এই একটা কাগজে দুটো কথা লিখার শিক্ষার অভাব এই মানুষগুলোর আত্মপ্রত্যয় কতখানি কমিয়ে দিয়েছে! আমার খুব খারাপ লাগল, আমি কোন কথা না বলেন সবার পাসপোর্ট দেখে তাদের কাগজ পূরন করে দিলাম। তারপর থেকে এই কাজ করা আমার অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেল, কারণ পরের ৫/৬ বছরে আমি অনেকবার দেশে যাতায়াত করেছি। একহাতে বাচ্চাকে ধরে রেখে আরেকহাতে লেখা, আর লেখার সাথে সাথে তাদের জীবনের নানা গল্প শোনা, শুনতে শুনতে গভীর দুঃখবোধে আক্রান্ত হওয়া, এমনটা অনেকবার হয়েছে। তাদের সকলের গল্পই মোটামুটি একই- স্বচ্ছলতার আশায় জায়গাজমি বেচে বা ধারদেনা দালালের মাধ্যমে বিদেশযাত্রা, পরিজন ছেড়ে যাবার দুঃখ, অজানা জীবনে পা বাড়াবার ভয়। সাথে আছে ইংরেজি না বুঝে চুক্তিপত্রে সই করার কারণে অনেকসময় চাকরিক্ষেত্রে অনেক বঞ্চনা,অপমান আর ভোগান্তির শিকার হওয়া, এবং এর থেকে পরিত্রানের কোন উপায় না জানা। আমার নিজের ইংরাজি বিদ্যাও তেমন বেশি না, মাত্র বার ক্লাস অবধি- তবু আমার মনে হত আরো কম ক্লাস অবধি পড়লেও এই মানুষগুলো এইসব চুক্তিপত্র বোঝা, ফর্ম ফিলাপ করা এই কাজগুলো করতে পারতেন! সেসময় মধ্যপ্রাচ্য যেতে ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স নিতে হত- এই ম্যানপাওয়ারের কোন কর্তাব্যক্তি যদি এই মানুষগুলোর শিক্ষার পাওয়ার বাড়ানোর কোন উদ্যোগ নিতেন!! এই যে পাঁচ ছয় বছর - এই সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের বিদেশ যাবার হার অনেকটা বেড়েছিল কিন্তু তাদের শিক্ষার কোন উন্নতি দেখিনি। অশিক্ষার কারণেই কিনা জানি না, এদের আচরণ খুব খারাপ ছিল। আমি যে দু'চার জন বাংলাদেশি শ্রমিকদের চিনতাম(পত্রিকার হকার এবং দোকানে কর্মরত) তাদের আমার মনে আছে কেবল প্রতারক ও অশোভন আচরণকারী হিসাবে। পাশাপাশি আমি অন্য দেশের শ্রমিকদেরও দেখেছি আর তাদের ভদ্র ব্যবহারের কথা এখনো মনে পড়ে। কয়েকবার আমি হাসপাতালে ছিলাম। সেখানে ঘর পরিষ্কার করতে আসতেন শ্রীলংকান ক্লিনার মহিলারা। এরা নিজের কাজ করার সাথে সাথে রোগীদের সাথে কথা বলতেন, দয়ামায়াময় কথা, কখনো সাহায্য দরকার হলে সাহায্য করতেন হাসিমুখে। এদের কতদূর লেখাপড়া? কেবল তাদের দেশের প্রাইমারি স্কুল পাশ। হাসপাতালে যে নার্সরা ছিলেন তারা ছিলেন সুদানী, সোমালিয়ান, লেবানিজ, ভারতীয়, পাকিস্তানি ও শ্রীলঙ্কান। এরা কাজ চালানোর মত ইংরেজি তো জানতেনই, এছাড়াও এদের সাধারণ জ্ঞানও বেশ ভাল ছিল। আমার রুমের এক রোগিণীর নাম ছিল ইন্দিরা বালসুব্রামানিয়াম। একবার এক সোমালিয়ান নার্স তাকে ওষুধ খাওয়াতে এসে তার নাম জানতে চাইল। ইন্দিরা বলতে পারলেও বালসুব্রামানিয়াম আর কিছুতেই উচ্চারন পারে না। শেষমেশ হাসতে হাসতে বল্ল,"Please, say Indira Gandhi." আমি এখনো অবাক হই, সোমালিয়াবাসি সেই নার্স মেয়েটি কতদূর লেখাপড়া করেছিল যে, সুদূর ভারতের প্রয়াত এক প্রধানমন্ত্রীর নাম মনে রাখার মত অসাধারণ সাধারণ জ্ঞান অর্জন করেছিল! ভারতীয়, এমনকি পাকিস্তানি নার্সরা ইংরাজি জানতেন, সেকারণে রোগের বিবরণ শুনে তারা ঠিকমত বর্ণনা লিখতে পারতেন। কিন্তু হাসপাতালে আমি একজন বাংলাদেশি নার্সও দেখিনি- মনে হয় নার্সিংয়ে দক্ষতা থাকা সত্বেও ইংরাজি বলা আর লেখার অদক্ষতার কারণে তাদের চাকরি হত না। তো আমার মাঝেমাঝেই প্লেনের সহযাত্রীদের অসহায়তা, তাদের দুঃখের কথা ভেবে মন খারাপ হত।

তখন আমার তারুণ্যকাল, অনেক রকম স্বপ্ন দেখতাম। একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম- দেশে ফিরে এই বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য একটা স্কুল করব যাতে তারা কাজ চালানোর মত ইংরাজি শিখতে পারেন, বিদেশের মাটিতে হীনমন্যতার জীবন আর কাটাতে না হয়। এই জীবনের আরো অনেক অপূর্ণ স্বপ্নের মত আমার এই স্বপ্নটিও অপূর্ণ রয়েই গেছে, কখনো পূরণ হবেও না। তবু এখনো মাঝে মাঝেই মনে পড়ে সেই হাহাকার, "আপা আমি যে পড়তে জানি না!" তখন এক অপারগতার দুঃখবোধ আমাকে ঘিরে ধরে। আমি ভাবতে থাকি আমাদের আমজনতার ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে। আমজনতা বলতে আমি কেবল দেশের মূলধারার শিক্ষার্থীদের বোঝাচ্ছি, ক্যাডেট কলেজ বা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা এই আমজনতার অন্তর্ভুক্ত নয়। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি। সেই ত্রিশ বছর আগে যে দেখেছিলাম ইংরেজি না জানায় অসহায়তা আর হীনমন্যতায় আক্রান্ত তরুনদের, তারা ছিল অশিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারের সন্তান। অথচ আজ, দেশ যখন নানা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে তখনো কেন এদেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণেরা একটা সহজ ইংরেজি বাক্য বলতে বা লিখতে পারবে না, আর এই না পারার কারণে কেন আজো তারা অসহায়তায় আর হীনমন্যতায় আক্রান্ত হবে? "I am GPA five" বলা তরুনটির অজ্ঞতার দায় কি তার একার?আমাদের সকলের সমালোচনা আর ধিক্কার তাকে লজ্জা আর হীনমন্যতায় ডুবিয়ে দিয়েছিল- কিন্তু যে শিক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে মেধাবীদের( সর্বোচ্চ জিপিএ প্রাপ্ত) ইংরেজি জ্ঞানকে এই স্তরে নামিয়ে এনেছে সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা ধিক্কার জানিয়েছি কি একবারো! আরেক জিপিএ ফাইভকে বলা হয়েছিল আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছি কথাটা ইংরেজিতে বলতে। সে উত্তর দিয়েছিল, "ভাইয়া আমাদের সিলেবাসে ট্রান্সলেশন নাই,তাই এটা বলতে পারব না।" আপনি হয়ত বলবেন ইংরেজিতে ফাইভ পেয়েও এই সাধারণ বাক্য অনুবাদ করতে না পারাটা ছাত্রের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা কিন্তু আমি বলব এটা আমাদের ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা। এই শিক্ষাব্যবস্থা নির্দিষ্ট সিলেবাসের বাইরে কিছু শেখার কোন সুযোগই রাখেনি ছাত্রের জন্য।ই বিদেশী ভাষা জানার জন্য যে সে ভাষায় অনুবাদ করা জানতে হয় তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বানানেওয়ালাদের মাথায় কেন আসল না!!!তাই আমজনতার ইংরেজির আজ কি ভীষণ দৈন্যদশা। আরেকটা উদাহরণ দেই, এটা সংগ্রহীত। (সূত্র:https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/43585) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন ছিল,এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি বাক্য লেখ। পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনকারী একজন শিক্ষক ছাত্রদের খাতায় লেখা উত্তরের কয়েকটি নমুনা দিয়েছেন:
ক) Rajsahee Univercity is vary beautiful
খ) Raishah university is beateful buidling
গ) Rajshahi Univarsity is very beautifull. হলে উপস্থিত শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই সঠিক বাক্য লিখতে পেরেছিল। সূত্র উল্লেখিত লেখা থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি দেই: আর এক শিক্ষার্থী লিখেছে,"I am student of. এটা দেখে শিক্ষক তাকে বললেন,"এরপরে কিছু একটা লেখা দরকার কি না?"সে বলল, "কী লিখব?" তিনি বললেন,"তুমি লিখ, I am a student of something." তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন সে যেন কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম লেখে। ছাত্রটি লিখে শিক্ষককে ডেকে জানতে চাইল হয়েছে কি না। সে লিখেছে, "I am student of something." বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ইচ্ছুক এই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উদ্দেশ্য কোন বিষয়ে বিশেষ এবং উচ্চতর জ্ঞান আহরণের জন্য। এই লেভেলের ইংরেজি জ্ঞান দিয়ে তারা কি ভাবে বিশেষ জ্ঞান আহরণ করবে?
দেখা যাক সেভেন এইট পাস করে কতটুকু ইংরেজিজ্ঞান অর্জিত হয়। যত ড্রাইভার, এপার্টমেন্টের দারোয়ান এরা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সেভেন বা এইট পাশ বলে উল্লেখ করে। অতএব এদের দিয়ে সেভেন/ এইটের ইংরেজি শিক্ষিতদের মান বোঝা যাবে। এরা বানান করে ইংরেজি পড়তে পারে, বিল-চিঠিপত্রর উপর লেখা ঠিকানা ঠিকমত পড়ে বাড়ী বাড়ী পাঠাতে পারে, নিজের নাম, বাবার নাম গ্রামের নাম, ঠিকানা ইত্যাদি ইংরেজিতে লিখতে পারে। কিন্তু এদের ইংরেজি বিদ্যা আর শব্দভাণ্ডার এটুকুই। এরা ইংরেজি অচেনা বাক্য পড়ে অর্থ বুঝতে পারেন না- কোন প্রশ্নের উত্তর করা তো দূরের কথা। এদের যখন কোন ফর্ম ফিলাপ করতে হয় তখন এদের অবস্থা হয় সেই আমার প্রথম বিদেশযাত্রার সহযাত্রীর মত, আজো, এই একুশ শতকেও। একদিন সিটি কর্পোরেশন অফিসে গেছি আমার মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেট বানাতে, দেখি এক লোক,স্ত্রী ও মেয়েসহ গেছেন তার মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেট করতে, মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে এটা প্রয়োজন। এজন্যে নাম, জন্মতারিখ,ঠিকানা ইত্যাদি কিছু সাধারণ তথ্য ইংরেজিতে লিখে ফর্ম ফিলাপ করতে হয় কিন্তু তিনি তা করতে পারেন না। ঐ অফিসের একজন পিয়ন দেখলাম একাজ করেন অর্থের বিনিময়ে, জানালেন তিনি সবসময় এই সার্ভিস দেন কারণ বেশিরভাগ মানুষই নাকি ইংরেজিতে ঠিকমতো লিখতে পারেন না। কথা বলে জানলাম লোকটি সিএনজি চালান আর তার স্ত্রী গার্মেন্টস কর্মী, দুজনেই প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। প্রাইমারি স্কুল পাশ করেও ইংরেজিতে এই সাধারণ কথাগুলো তারা লিখতে পারেন না!

ইংরেজি শেখানোর ইচ্ছাটা মাথায় রয়েই গেছে।তাই ঠিক করলাম আমার সেভেন পাশ ড্রাইভার ছেলেটাকে ইংরেজি শেখাব, কখনো হয়ত তার কোন কাজে আসবে। ও কতটুকু ইংরেজি জানে শুরুতে তার পরীক্ষা নেবার জন্য ওকে বললাম আমি ভাত খাই এই কথাটা ইংরেজিতে বলতে। সে ইংরেজিতে বানান করে বল্ল,"ami vat kai." অবস্থা দেখে মনে হল বেশি কঠিন প্রশ্ন করে ফেলেছি। তাই সহজ করার জন্য এবার জিজ্ঞেস করলাম ইংরেজিতে আমিকে কি বলে- ও বলতে পারল না। ভাত বা খাই কোন শব্দর ইংরেজিই জানে না। সেভেন এইট পাশদের ইংরেজি জ্ঞানের এ অবস্থা হতে পারে হয়ত কেউ বিশ্বাস করতে চাইবেন না। এক্ষেত্রে পরীক্ষা প্রার্থনীয়। পারলে একবার পাসপোর্ট অফিসের সামনে যান, সেখানে বিদেশগামী অনেকেরই দেখা পাবেন যারা এসএসসি পর্যন্তও পড়েছেন কিন্তু পাসপোর্ট করার জন্য ফর্ম ফিলাপ করতে পারেন না, শুধু এই কাজের জন্য দালাল ধরতে হয়। এই হল অবস্থা।

কিন্তু কি ব্যবস্থার ফলে আমাদের আমজনতার ইংরেজি শিক্ষার এই অবস্থা করা হল? ব্যবস্থাটা করা হয় আশির দশকের শেষে বা নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে। ঠিক জানিনা কি উদ্দেশ্যে সেসময় ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা বদলে দেয়া হল। শুনেছি সেই সময়ের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত জনশক্তি রপ্তানিকে উন্নততর করতেই এই ব্যবস্থা যাতে বিদেশগামী জনগন ইংরেজি তে কথা বলার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। এই ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার নাম Learning communicative English. কম্যুনিকেটিভ পদ্ধতি বিদেশি ভাষা শেখার একটি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয় যে একজন শিক্ষার্থী বিদেশি ভাষা কেবল পড়া আর বোঝা নয় বরং বলা ও লেখাতেও পারদর্শিতা অর্জন করতে পারেন। [সূত্র : ১) Click This Link ২) Click This Link কম্যুনিকেটিভ ইংলিশ এমন এক শিখন পদ্ধতি যেখানে ছাত্র আর শিক্ষকের মধ্যে ক্রমাগত নানা বিষয়ে আলাপচারীতা চলবে,শুধুই ইংরেজিতে। শিক্ষকের সক্ষমতা থাকতে হবে শিক্ষণীয় বিষয়টি ছাত্রদের কাছে সহজবোধ্য করে তুলতে, কিন্তু তিনি শিক্ষণীয় বিষয় ছাত্রদের ইংরেজিতেই বোঝাবেন, এটাকে মাতৃভাষায় অনুবাদ করে বোঝাতে পারবেন না। কম্যুনিকেটিভ ইংলিশ পাঠ্যবইয়ে এমন বিষয়ে অনুচ্ছেদ লেখা থাকে যা ছাত্রদের পরিচিত- যেমন কোন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, জায়গা বা ঘটনা নিয়ে। যাতে করে শিক্ষার্থী সহজেই তা উপলব্ধি (Comprehension) করতে পারে, এ বিষয় সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। একেকটি অনুচ্ছেদ পড়াবার পর শিক্ষার্থীদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে দেবেন শিক্ষক, তারপর অনুচ্ছেদের কোন বাক্য বা কোটেশন বা অন্যকিছু নিয়ে দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আলোচনা করতে দেবেন। সময় শেষে শিক্ষক একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করতে পারেন সে তার সহপাঠীর থেকে নতুন এবং ইন্টারেস্টিং কি শিখেছে। এই পদ্ধতি যদি যথাযথ ভাবে অনুসৃত হয় তবে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বোঝার, শোনার, লেখার এবং বলার ক্ষমতা বাড়ার কথা। বারো ক্লাস অবধি এই পদ্ধতিতে ইংরেজি শিখলে ইংরেজি লিখা, পড়া ও বলায় পারদর্শী হয়ে ওঠার কথা। তবে কেন তা হল না?এর কারণ কম্যুনিকেটিভ ইংলিশের বৈশিষ্ট্য যে আলাপচারীতার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া আমাদের শিক্ষকেরা তা জানেনই না, অথবা এই পদ্ধতিতে পড়াবার ট্রেনিংই তারা কখনো পান নি, ঠিক যেমন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পড়াবার ট্রেনিং শিক্ষকদের দেয়া হয় নি। তারা কেবল অনুচ্ছেদগুলো এমনভাবে পড়িয়ে যান যেন ছাত্ররা এইসব পড়ে গৎবাঁধা কিছু প্রশ্নোত্তর ঠিকঠাক পরীক্ষার খাতায় লিখে ইংরেজিতে ফাইভ পায়। ফলে ইংরেজীতে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েও ছাত্ররা ইংরেজিতে পারদর্শী হতে পারে না, ইংরেজি শেখাবার একটা ভাল পদ্ধতি থাকা সত্বেও, ঠিক যেভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি ছাত্রদের শেখার দক্ষতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। এই কম্যুনিকেটিভ ইংলিশ শেখানো হয় ইংরেজি প্রথম পত্রে। এখানে প্রথম আটটা প্রশ্ন হয়। comprehension- প্রশ্নোত্তর, শূন্যস্থান পূরণ, সত্য-মিথ্যা নির্ণয় এসব। থাকে re-arrange নামক এক প্রশ্ন। এখানে দশটা ইংরেজি বাক্য এলোমেলো ভাবে দেয়া থাকে, এগুলোকে সাজিয়ে একটা অর্থবোধক অনুচ্ছেদ করতে হবে। থাকে সূত্র অনুসরণ করে কোন বিষয়ের উপর প্যারাগ্রাফ লেখা। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে রচনা, চিঠি, গ্রামার এসব থাকে কিন্তু কোন ট্রান্সলেশন থাকে না। তাই দেখা যায় নির্দিষ্ট ধারা অনুসরণ করে পড়লেই ইংরেজিতে গ্রেড পয়েন্ট ৫ নিশ্চিত হয় কিন্তু এর বাইরে ছাত্ররা আর কিছু শিখতে পারে না। এই ছাত্ররা পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়, পাশও করে কিন্তু ইংরেজিতে শুদ্ধ করে দুই পাতা লেখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আজকাল প্রায়ই শুনি যারা উচ্চতর শিক্ষায় যান তাদের থিসিস লিখতে হয় ইংরেজিতে আর তারা তাতে অজস্র ভুল করেন।

আমজনতার জন্য উন্নততর ইংরেজি শেখার নামে আরেক শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে বছর পনের ধরে, যার নাম ইংলিশ ভার্শন - এখানে সব বিষয়ের বই ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়ানো হয়, কেবল ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষায় বাংলা মাধ্যমের সাথে কোন তফাৎ থাকে না। ফলে এই ভার্শনের ইংরেজি হয় আরো জগাখিচুড়ী। ঢাকার কিছু স্কুল কলেজ আছে যেখানকার ছাত্ররা কিছু ভাল ইংরেজি শেখে বলে বলা হয়। এইভাবে পড়ানোর সিস্টেমে কি করে ভাল ইংরেজি শেখানো সম্ভব সেটা বুঝতাম না। যখন আমার ছেলেমেয়েরা এমন দু'টি স্কুলে পড়তে গেল তখন দেখলাম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তারা দেশি বই না পড়িয়ে অন্য বই পড়ায় । এই যে এমন বই:



এই বইগুলো যেভাবে পড়ানোর নির্দেশনা দেয়া থাকত শিক্ষকেরা সেভাবেই পড়াতেন। নবম শ্রেণি থেকে আবার বোর্ডের বই পড়ানো শুরু হত। এখন পিইসি, জেএসসি চালুর পর এই স্কুলগুলোতে কেবল বোর্ডের বই পড়ানো হয়। একটা ব্যাপার অদ্ভুত লাগত এই যে প্রথমে বাংলা ও ধর্ম আর পরে একে একে সমস্ত বিষয়, এমনকি সকল আপত্তি অগ্রাহ্য করে গণিতকেও সৃজনশীল করা হল কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় তেমন বড় কোন পরিবর্তন আনা হয় নি। কিছু নতুন বিষয় যোগ হয়েছে মাত্র- যেমন ক্লাস সিক্স থেকে এখন বিভিন্ন রকম ফর্ম পূরন করা শিখানো হয়। কি বলব একে- কর্মমুখী ইংরেজি শিক্ষা? এই কর্মমুখী ইংরেজি শিক্ষার আরেকটা নমুনা দেখেছিলাম যখন আমার মেয়ে নাইনে পড়ে তখন। একদিন দেখি সে কিছু একটা শিখতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে। কি শিখছে! শিখছে ইংরেজিতে সিভি লেখা, কম্পিউটার অপারেটর পদের জন্য। এজন্য তাকে কল্পনায় অবগাহী ভাবতে হবে কয়েকমাস আগে অনার্স পাশ করেছে, তারপর সেই কয়েকমাসের চারবছর আগে এইচএসসি, তার থেকে দুই বছর আগে এসএসসি পাশ করেছে, সাথে সাথে প্রতি পরীক্ষার জন্য জিপিএও কল্পনা কতে নিতে হবে। এই বিষম নিয়মে সিভি লেখা শেখানোর পরিকল্পনা কার মাথা থেকে বেড়িয়েছিল জানি না। কিন্তু এটা নিশ্চিত জানি, যে বা যারা এইসব উৎকট শিখন পদ্ধতির পরিকল্পক তাদের ছেলেমেয়েরা আমজনতার শিক্ষালয়ে পড়ে না। দেশের শিক্ষিতজনেরা, যারা বিভিন্ন সভা সমাবেশে, টকশোতে জাতিকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দেবার জন্য বিনিদ্র রাতে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন, তাদের অধিকাংশই কিন্তু সন্তানদের পড়াশোনার জন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলই বেছে নেন। সুতরাং আমরা একথা ভেবে।আনন্দিত তো হতেই পারি, আমরা আমজনতা ইংরেজি না শিখতে পারলে কি হবে, অনেকেই কিন্তু ভাল ইংরেজি শিখছেন। এতই ভাল শিখছেন যে, কিছু স্কুল আছে যেখানে অনেক বাংগালী শিক্ষার্থী বাংলায় কথা বলতে পর্যন্ত জানে না। অবশ্য এসব স্কুলের কেজি ক্লাসের মাসিক বেতনই প্রায় দেড় লক্ষ টাকা, প্লে গ্রুপ থেকে বারো ক্লাস অবধি পড়তে খরচ হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। https://www.isdbd.org/admission/tuition-fees/ বোঝাই যাচ্ছে, যারা এসব স্কুলে পড়ে তারা উঁচুতলার অধিবাসী, আমজনতা নয়। এমনটাও হতে পারে, ইচ্ছা করেই ইংরেজি শিক্ষার এই বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। এর ফলাফল দেখতে আমাদের আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।


সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:১৬
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×