তাদের অভিনন্দন আর শুভকামনার ঠেলায় শামীম উজ জামানের মনে হতে লাগলো, যেন মনিকা জামান বলে সত্যিই কেউ আছে, শামীম উজ জামান যেন মনিকার প্রাণস্পন্দন অনুভব করতে লাগলেন........
এবার পোস্ট করলেন একটা কবিতা। অনেক মন্তব্য এলো, সবই প্রশংসাসূচক। আরো দু'তিনটা কবিতা পোস্ট হল- একই রকম প্রশংসার বন্যা। এবার অন্যরকম একটা বুদ্ধি এলো শামীম উজ জামানের মাথায়, তার নামে পোস্ট করা সব কবিতা ড্রাফটে নিয়ে প্রথম কবিতাখানা আবার মনিকার নামে পোস্ট করলেন- এবার মন্তব্যকারী ৩৭ জন.......আর মন্তব্যও তেমন! "আপু, আপনার সুকোমল হাতে লেখা বলেই কবিতায় এমন পদ্ম ফুলের শোভা" ........ কিংবা, "আপি, আপনার কবিতার শব্দাবলী তরঙ্গের মতো আমার হৃদয় কে ভাসিয়ে নিয়ে গেল" মন্তব্য পড়তে পড়তে শামীম উজ জামান খুবই বিরক্ত হলেন, "লম্বকর্ণের দল! শামীম উজ জামান নাম ভালো লাগে না, না?"
অবশ্য এটুকু বিরক্ত হলেও, শামীম উজ জামান হামু আর এর ব্লগারদের ভালোবেসে ফেললেন। হামু তার জীবনটা একেবারেই বদলে দিল; ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি এসেই বসে যান ল্যাপটপ নিয়ে। আগের মত অবসর সময়ে ঘুরতে যাওয়া, মুভি দেখা, খেলা দেখা, সব বন্ধ হয়ে গেল। পরের জন্মদিনে আবার বন্ধুবান্ধবরা এলেন, সেই কেক কাটা, খাওয়া- দাওয়া, আড্ডা..... তবে এবার শামীম উজ জামানের মনে হচ্ছিল তার বয়স কয়েক বছর কমে গেছে!! মহা উৎসাহ নিয়ে তিনি টেবিল ভরা খাবার, কেক, ফুল দিয়ে সাজানো ফুলদানি- সব কিছুর ছবি তুলতে লাগলেন; তার মাথায় একটা নতুন আইডিয়া এসেছে, এবার তিনি মনিকা জামানের জন্মদিন পালন নিয়ে একটা পোস্ট দেবেন। এতদিন ব্লগ পড়ে পড়ে বেশ বানিয়ে লেখা শিখে গেছেন, ছবিগুলো ব্যবহার করে বেশ চমৎকার একটা পোস্ট লিখেও পোস্ট করলেন না, মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল; এর সাথে যার জন্মদিন তার একটা ছবি দেয়া দরকার...... কিন্তু এই মায়াকে কায়ায় আনবেন কিভাবে? অবশেষে আইডিয়া পেলেন একখানা!
এক ছুটির দিনে ল্যাপটপ নিয়ে স্টাডিতে বসলেন, তারপর সার্চ দিলেন মালায়ালাম ফিমেল ফিল্মস্টার লিখে। অনেক ছবি এলো, শামীম উজ জামান খুঁজতে লাগলেন মায়াবতী, লাবণ্যময়ী বাঙালি চেহারার মেয়ের ছবি, যাকে সহজেই মনিকা জামান হিসেবে মানিয়ে যাবে। পেয়ে গেলেন তেমন একটি মুখ, অল্প দিন অভিনয় করার পর অভিনয় জগৎকে টা টা জানিয়ে বিয়ে বসেছে, নাম নাভীনা। নাভীনার ছবি দেখে এতটাই পছন্দ হল যে, মনের আনন্দে হেঁড়ে গলায় শামীম উজ জামান গান ধরলেন, "হে নবীনা, প্রতিদিনের পথের ধুলায় যায় না চেনা"......গান ঠিক তখনই নাজনীন কিছু বলার জন্য স্টাডিতে ঢুকলেন। দেখলেন ৩০ বছর ধরে সংসার করা তার সুবোধ স্বামীটি ল্যাপটপে কিছু মেয়ের ছবির দিকে চেয়ে আনন্দে গান গাইছেন! হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নাজনীন চলে গেলেন।
এই সামান্য ব্যাপারে বিচলিত হবার সময় কই শামীম উজ জামানের! তিনি তখন মহানন্দে মনিকা জামানের জন্মদিনের পোস্টে ছবি দিচ্ছেন। নাভীনার ছবি গুলো কপিরাইটের আওতাভুক্ত থাকতে পারে ভেবে তিনি একটা চালাকি করলেন, কোন কোন ছবিতে দু'চোখ কালো করে ঢেকে দিলেন, কোনটাতে থুতনি কেটে পোস্ট করলেন। বেশ হল; সাপও মরল, লাঠিও ভাঙলো না! মনিকা জামানের ছবি দেয়া হলো, কিন্তু এই ছবি নাভীনার বলে কেউ কপিরাইট আইন দেখাতে আসবেনা......
এই পোস্ট দেখে লাইক আর মন্তব্যের যেন জোয়ার এলো! এতদিন সকলে মনিকা জামানের গুণে মুগ্ধ ছিল, এবার ছবি দেখে কতজনের যে "রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল" অবস্থা হল; কেউ কেউ তো মনিকাকে নিয়ে হামুতে কবিতাও লিখে ফেললেন.......
পরদিন বিকেলে বন্ধু ইশতিয়াকের ফোন এলো:
-কিরে শামীম, বুড়ো বয়সে এসব কী শুরু করলি? ভাবির কথা এক বার ভাবলি না!
- কী শুরু করলাম?কী বলছিস?
- তুই নাকি কাজ করছিস বলে স্টাডিতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে কী সব করিস?
- ধুর! এতো হামু ব্লগ!
- হাগু ব্লক! তাহলে ডাক্তারের কাছে যা। স্টাডিতে কী?
- তুই যা ডাক্তারের কাছে!! ব্যাটা কানে শোনে না, কালা কোথাকার!!
বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলেন, বুঝতে পারলেন নাজনীন ইশতিয়াককে কিছু বলেছে..... নাজনীনের উপর রাগ হল না, বরং মনে হল নাজনীনের সাথে তিনি অন্যায় করে চলেছেন, বেচারী খুব একা হয়ে গেছে........ অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে তক্ষুনি বসে "নাজনীন সুলতানা" নাম হামুতে রেজিস্ট্রেশন করলেন।
এবার নাজনীন কে সব খুলে বললেন; ৫৭ তম জন্মদিনের রাতের সেই শূন্যতার অনুভূতি, হামুতে শামীম উজ জামান নাম নিয়ে লিখে ব্যর্থতা, মনিকা জামান নাম নিয়ে সফলতা, অনেক ব্লগারদের সাথে সখ্যতা, মনিকা জামানকে কল্পনা থেকে বাস্তবে আনতে নাভীনার ছবি ব্যবহার- এইসব কথা বলা শেষ করে দেখালেন, নাজনীনের নামেও হামুতে একাউন্ট করে দিয়েছেন।
- এখন থেকে তুমিও লিখো; দেখো, কত ভালো লাগবে।
- আমি কি লিখতে জানি! বরং পোস্ট পড়ব, আর দেখব তোমাকে নতুন কোন আইডিয়া দেয়া যায় কিনা!!
দুদিন পরেই নাজনীন নতুন আইডিয়া নিয়ে এলেন:
- মনিকা জামান তো মেয়ে, সুতরাং রান্না নিয়ে সে পোস্ট দিতেই পারে.........
নাজনীন চাইছিলেন তার কিছু রেসিপি হামুতে দিতে; শামীম উজ জামান ভেবে দেখলেন, আইডিয়াটা ভালোই দিয়েছেন নাজনীন। রান্নার পোস্ট দিলে বেশ একটা চেঞ্জ আসবে.......
শুরু হলো বালুশাইর রেসিপি দিয়ে। নাজনীন যখন বালুশাই বানানো শুরু করলেন, শামীম উজ জামান তার প্রতি ধাপের ছবি তুললেন(অবশ্যই নাজনীনকে বাদ দিয়ে), তারপর ছবির সাথে মিলিয়ে ধাপে ধাপে বর্ণনা। হিট পোস্ট হল; মন্তব্যকারী সকলেই একমত হলেন যে, এমন বালুশাই ঢাকা শহরের কোন দোকানে তারা দেখেন নি। কেউ কেউ মনিকা জামানের বাসার ঠিকানা চাইলেন, বালুশাই খেতে আসবার জন্য; কেউ কেউ আবার পরামর্শ দিলেন মিষ্টির দোকান খুলতে, এমন বালুশাই বেচে মনিকা জামান লাখপতি হয়ে যেতে পারেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি!! এত মন্তব্যের জবাব দিতে দিতে শামীম উজ জামান যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন নাজনীন, মনিকা জামান হয়ে প্রতিমন্তব্য করতে থাকেন। অল্প দিনেই নাজনীন ব্লগারদের আপা, ভাইয়া এসব সম্বোধন করে বেশ একটা সখ্যতার সম্পর্ক গড়ে তুললেন।
ইতিমধ্যে হামুতে তার কবিতার অনুরাগী একদল পাঠক তৈরি হয়েছেন; তারা খুবই জোরাজুরি করতে লাগলেন, এই চমৎকার কবিতা গুলো নিয়ে বই প্রকাশ করার জন্য। শামীম উজ জামানের মাথাতেও বই প্রকাশ করার চিন্তা এসেছে, ইতিমধ্যেই তো বন্ধু আলী রীয়াজের বেশ কয়েক খানা কবিতার বই প্রকাশিত হবার সাথে সাথে তুমুল প্রশংসিত হয়েছে!! কিন্তু সমস্যা একটা আছে- পাঠককুল তো শামীম উজ জামানের কবিতার অনুরাগী নয়, তারা চাইছে মনিকা জামানের কবিতার বই। শামীম উজ জামান কেবল ভাবেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, কোন উপায় বের করতে পারেন না। এদিকে মনিকা জামানের পোস্টে মন্তব্য করে অনেকেই হুমকি দিচ্ছেন, এবার বইমেলায় মনিকা জামানের কবিতার বই না থাকলে তারা মেলা বয়কট করবেন!! হাজার দীর্ঘশ্বাস ফেলার পর অবশেষে শামীম উজ জামান সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি মনিকা জামান নামেই কবিতার বই প্রকাশ করবেন, নাই হলো এ জীবনে নিজের নামে কাব্য খ্যাতি........
বই প্রকাশ করা তেমন কঠিন কিছু না, প্রবাসী বাঙ্গালীদের অনেকেই বই লেখেন, সেসব বই প্রকাশে সাহায্য করেন নিউইয়র্কের কয়েকজন এজেন্ট, তারা ঢাকার প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশ করে দেন। এমন একজন এজেন্টের সাথে কথাবার্তা বলে শামীম উজ জামান সব ঠিক করলেন। প্রচ্ছদ, প্রুফ সব তিনি আমেরিকায় বসেই ঠিক করলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস জড়ানো সেই বইয়ের নাম দিলেন, "স্বপ্নেরা যায় উড়ে...... হায় রে"। হামুতে পোস্ট দিয়ে বইয়ের কথা জানালেন, অনুরাগীকুল খুব উৎসাহ দেখালেন।
বইয়ের ব্যাপারে তিনি নিজেও খুব উৎসাহ বোধ করছিলেন; হোক না ছদ্মনামে লেখা, বইয়ের প্রতিটি শব্দে যে তার ভালোবাসা জড়িয়ে আছে! তাই বই মেলার সময় সাত দিনের ছুটি নিয়ে শামীম উজ জামান ঢাকায় গেলেন। সাত দিনের প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত তার বইয়ের স্টলে বসে তার বইয়ের ক্রেতাদের নজর করেন। বড় ইচ্ছা করে তাদের সাথে আলাপ করতে, কিন্তু ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে সেই ইচ্ছা দমন করেন! কেউ কেউ আবার খোঁজ নেয়, "আচ্ছা, মনিকা জামানকে কবে পাওয়া যাবে? তার একটা অটোগ্রাফ নেবার বড় ইচ্ছা!" কয়েকজনের এমন ইচ্ছার কথা শুনে শামীম উজ জামানের মাথায় একটা বুদ্ধি এল, তিনি বিক্রেতাকে বলে দিলেন, এরপর থেকে কেউ অটোগ্রাফ চাইলে তাকে বলতে হবে, মনিকা জামান অটোগ্রাফসহ বই উপহার হিসেবে পাঠাতে চান, তাই ঠিকানাটা দিতে হবে। নয় জনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেল, শামীম জামান যত্ন করে দু'লাইন শুভেচ্ছা বাণী লিখে অটোগ্রাফ দিলেন প্রতিটি বইয়ে। তারপর একটা স্টেশনারি দোকানে নিজে গিয়ে প্রতিটি বইয়ে সুন্দর করে মোড়ক লাগাতে দিলেন, নিজে সুন্দরবন কুরিয়ার অফিসে গিয়ে বইগুলো ঠিকানা মত পাঠিয়ে দিলেন।
এবার ছুটি....…. রাত তিনটায় ফিরতি ফ্লাইট ধরলেন। তিনি একটুও ক্লান্তি বোধ করছেন না; হামু যেন চমৎকার একটা টনিক- শরীর মনকে তরতাজা করে রাখে! খুব ভালো লাগছিল প্রিয় ব্লগারদের বই গুলো উপহার পাঠাতে পেরে। প্রত্যেকেই নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে তার অটোগ্রাফ সহ বই পেয়ে, বইয়ের রিভিউ নিশ্চয় দেবে হামুতে! ভাবতে শামীম জামানের বেশ ভালো লাগছিল, কিন্তু মনের ভেতর কেন একটা খচখচ করছিল, কিছুতেই কারণটা ধরতে পারছিলেন না তিনি.......
তারপর হঠাৎই খচখচানির কারণটা ধরে ফেললেন- প্রতিটি অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে তিনি মনিকা জামান হয়ে দু'লাইনের শুভেচ্ছা বাণীর লেখার পর যে স্বাক্ষর দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট পড়া যায়, এস ইউ জামান..........
==================================================================================
==================================================================================
Midlife crisis বা মধ্য বয়সের সংকটে পতিত একজন মানুষের গল্প এটা। মধ্য বয়সে এসে অনেকের আত্মপরিচয় সংকট দেখা দেয়; Midlife crisisবিষন্নতায় আক্রান্ত হন, বাস্তবকে এড়িয়ে যাবার জন্য নানারকম কল্পনাবিলাসে মগ্ন হন; যেমনটা ডঃ শামীম উজ জামান হয়েছিলেন। গল্পে বর্ণিত সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক- ডঃ আলী রীয়াজ এবং বুদ্ধ দেব বসু বাদে, এরা বাস্তব চরিত্র।
পুরো গল্পটাই আরেকজন মধ্যবয়সী মানুষের কল্পনা বিলাসে রচিত- তাই এই গল্পের সাথে বাস্তবের কোন কিছুকে না মিলিয়ে রম্য হিসেবে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়!!
ছবি: অন্তর্জাল
আগের পর্ব:view this link
এই লিংকটি দিয়েছেন view this link নীল আকাশ। মন্তব্যগুলো পড়ে হাসতে হাসতে শেষ হয়ে গেছি। নীল আকাশ কে ধন্যবাদ, অসংখ্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৫:৫০