
গত বছর নভেম্বর মাসে দীর্ঘ ২০ বছর পর ঢাকা ত্যাগ করেছিলাম। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় নিজ জমিতে বাড়ি করার উদ্দেশ্য মূলত ঢাকা ছাড়া হয়েছিল। ঢাকা ছাড়ার আগে পরিবারের প্লান ছিলো ঢাকার মিরপুরে ক্রয়করা নিজের জমির উপর টিনশেড বাড়ি করার । কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আওয়ামী লীগের এক এমপির আমাদের সম্পত্তির উপর বদনজর পড়ে। মিরপুরে জমি ক্রয়ের পর থেকেই স্থানীয় এমপির সাথে আমাদের ঝামেলা শুরু হয়। আশেপাশের সব জায়গা এমপি সাহেব ছলচাতুরি করে নিয়ে ফেললেও আমাদের টা হজম করতে পারছিল না। অবশেষে দীর্ঘদিন আইনি লড়াইয়ের পর আমাদের হাত থেকে জমি হাতছাড়া হয় ২০২০ সালে করোনা আসার ২ মাস আগে। এরপর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকায় থাকলেও পরে পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জে বাড়ির কাজ শুরু করা হবে। সে কারণে নারায়ণগঞ্জ থাকার জন্য বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার চাকুরি সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে জুন মাস পর্যন্ত বাড়ির কাজে হাত দিতে পারেনি। জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আবার বাড়ির কাজ শুরু করার তারিখ পিছিয়ে যায়। নভেম্বর মাসে বাড়ির কাজ হাতে দিবো এমন সময় মিরপুর থেকে খবর আসে এমপি সাহেবের দখল করা জমি নাকি মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের জমি পুনরায় ফিরে পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা! পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত হয় মিরপুরের মতো ফরোয়ার্ড এলাকায় জমি ফেরত পেলে সেখানে বাড়ির কাজ করা বেশি লাভজনক হবে। এখন ঢাকার মিরপুরে নতুন করে ভাড়া বাসা নিতে হবে।
বিভিন্ন এলাকায় বাসা দেখতে শুরু করলাম ছুটির দিন গুলোতে। ভাড়া বাসার বর্তমান যে কন্ডিশন তা রীতিমতো আতঙ্কের বিষয়। ছোট ফ্যামিলির জন্য যে সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া হতো সেখানে এখন ফ্ল্যাটের প্রতি রুমে সাবলেট ভাড়া দেয়া শুরু করেছে ঢাকার বাড়িওয়ালারা। শুধুমাত্র অতিরিক্ত লাভের জন্য তারা এমন কাজ শুরু করেছে। দুই বেডের বাসা মিরপুরে বর্তমানে ১৪-১৮ হাজার টাকা। কিন্তু সাবলেট দিলে বাড়িওয়ালার লাভ বেশি। রুম প্রতি ৬-১০ হাজার টাকায় সাবলেট ভাড়া দেয়া হচ্ছে। এতে ছোট ফ্যামিলির জন্য একটি পুরো ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে । এইজন্য অনেকে দুই ফ্যামিলি একসাথে বাসা নিতে বাধ্য হচ্ছে। আজকাল ঢাকার বাড়িওয়ালারা সবাই কর্মজীবী নারী পুরুষ, স্বামী স্ত্রী চাকুরিজীবী এই ধরণের মানুষের কাছে রুম দিতে বেশি পছন্দ করে। পরিবারে কেউ গৃহিনী বা বয়স্ক থাকলে বাসায় রান্নাবান্না করবেন, নামায পড়ার জন্য ওযু করবেন ফলে পানি খরচ হবে বেশি, বারবার পানি তোলার জন্য মোটর ব্যবহার করলে বাড়িওয়ালার বেশি বিদ্যুৎ খরচ হবে। অথচ এলাকা ভেদে ৫০০-১০০০ টাকা পানির বিল ঠিকই আদায় করছে বাড়িওয়ালা। ঢাকা শহরে বাড়িওয়ালাদের এখন ছোট ফ্যামিলিকে বাসা দিতে না চাওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাঙের ছাতার মতো মাদরাসা ও স্কুল গড়ে ওঠা। আজ বাসা খুঁজতে গিয়ে এমন এক রোডে গিয়েছিলাম যেখানে ছয়টি মাদরাসা ও তিনটি প্রাইভেট স্কুল রয়েছে। মাথা পুরোই হ্যাং হয়ে গেছে। দেশে কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট চলছে অন্যদিকে গণহারে মাদরাসা ও প্রাইভেট স্কুল খোলা হচ্ছে। এসব মাদরাসা ও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতারা বেশিরভাগ নিজেরা চাকুরি না পেয়ে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এক ছোট ভাই নর্থ সাউথের মতো ভার্সিটি থেকে EEE তে পড়ে কোচিং সেন্টার দিয়েছে। ১০/১২ লাখ টাকা খরচ করে পড়াশোনা করে সে এখন একটি প্রাইভেট স্কুল কাম কোচিং সেন্টারের মালিক। আপনি যদি মনে করে থাকেন যে মাদরাসা ও প্রাইভেট স্কুল বেকাদের তৈরি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আপনি মোটেই ভুল করবেন না। যারা এখানে পড়ান তারা নিজেরাও ফিউচারে চাকুরি পাওয়ার সম্ভাবনা কম এবং যারা কোচিং সেন্টারে পড়ে তারা ভবিষ্যতের বেকার!
বাড়ির মালিকেরা এসব মাদরাসা ও কোচিং সেন্টার থেকে অধিক ভাড়া পেয়ে থাকেন। তাই দেখা যায় পাশাপাশি দুইটা ছোট ফ্ল্যাট ছোট পরিবারকে ভাড়া দেয়ার পরিবর্তে কোচিং বা মাদরাসা কে ভাড়া দিলে ডাবল ভাড়া পাওয়া যায়। কে এমন সুযোগ হাতছাড়া করবে? বেশিরভাগ বাড়িতে তাই ৫/৬/৭ তলা খালি পাওয়া যায়। কিন্তু ছোট পরিবার গুলোতে অধিকাংশ সময় ৫০/৬০ বছর বা বেশি বয়সী পিতা-মাতা ও অনার্স পড়ুয়া ছেলে/মেয়ে অথবা চাকুরি প্রত্যাশীদের নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো হয়ে থাকে। বাবা-মার পায়ে সমস্যা থাকে তাই লিফট ছাড়া বাসায় ৫/৬/৭ তলায় ওঠা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে আর্থিক ভাবে ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী না হওয়াতে লিফট সিস্টেমের ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিতে চায় না ৷সার্ভিস চার্জ নিয়েও বাড়ির মালিকদের দুই ছলচাতুরী এখন স্বাভাবিক ঘটনা। ২-৬ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ হয় এলাকা/ বাসা ভেদে।
বাড়ির মালিকদের এখন ভাড়াটিয়ার নিকট আত্নীয়- স্বজন বেড়াতে আসা পছন্দনীয় নয়। অনেকে বাসা ভাড়ার শুরুর দিকে মেহমান কতদিন থাকতে পারবেন তা ঠিক করে দেন । বাসায় সদস্য আসলে কতজন থাকছে তা জানার জন্য বাসার বাইরে কয় জোড়া জুতা রাখা আছে তা গণনা করা, মেহমান বেশদিন থাকলে রেগুলার ট্যাংকিতে পানি না তোলা, গ্যাসের রাইজার হালকা বন্ধ করে গ্যাস সরবরাহে বিঘ্নিত করা তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
করোনার সময় থেকেই ছোট পরিবারগুলোর অনেকে কাজ হারিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে গিয়েছে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ সহ ঢাকার আশেপাশের জেলায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকায় ছোট ফ্যামিলির তথা মধ্যবিত্তদের তীব্র বাসস্থানের সংকটে ভুগবে। অন্যদিকে সাবলেট বাসা ভাড়া দেয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণে সমাজে পরকীয়া সহ নানা ধরণের সামাজিক সমস্যা বেড়ে যাবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


