

জুলাই অভ্যুত্থান নিসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। একটি মাফিয়া দলের নিকট দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছিল। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা মাফিয়া আওয়ামী লীগ রেজিমের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসে অভ্যুত্থান ঘটায়। অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেমন হবে, দলগুলোর নিজেদের মধ্যে কিভাবে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। উপরের দুইটি ছবি লক্ষ্য করুন ভালোভাবে। জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহনকারী বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান তার একটি নমুন রেখে গিয়েছেন দেয়ালের পোস্টারে। একপক্ষ চাচ্ছেন সেক্যুলার বাংলাদেশ অন্য পক্ষ চান ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ। দুইটি ধারণা কি পরস্পরবিরোধী নাকি একটি অন্যটির সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হলেও এখানে নানা মতের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এক সাথে বসবাস করে যাচ্ছেন। ধর্ম বা ভিন্ন মত কখনোই এখানে একে অপরের প্রতিপক্ষ হতে দেখা যায় নি। এমন একটি দেশের শাসন ব্যবস্থা হিসাবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কে সর্বাপেক্ষা উন্নত হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে মূলত ধর্ম নিরপেক্ষতা বা কোন মতের নিরপেক্ষতা হিসাবে মনে করে মানুষকে ক্ষমতার কেন্দ্রে চিন্তা করা হয়। এতে সমাজের সকল মতের মানুষের অধিকার যেমন সুরক্ষিত থাকে সেই সাথে প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে জীবন যাপনের অধিকার রাষ্ট্র কতৃক নিশ্চয়তা দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় অনেকে এই সেক্যুলার ব্যবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন নি। অনেকে মানুষ কে ক্ষমতার কেন্দ্রে স্থান দেয়া মেনে নিতে প্রস্তুত নন। তাদের মত হলো ধর্মকে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলে সমাজে প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হবে। তাছাড়া মানুষের ইচ্ছামতো জীবন যাপনের একটি নিদিষ্ট সীমারেখা থাকা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। এই জন্য তারা সেক্যুলার রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চান না। তারা ইনক্লুসিভ তথা সকলের অংশগ্রহন ও মতামত কে প্রাধান্য দিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে চান। জুলাই অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেক হোল্ডার হিসাবে তাদের এই মনোভাব ইগনোর করার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক দল রয়েছে। সেক্যুলার ও বামপন্থী দল, জাতীয়তাবাদী দল, ইসলামিক দল সহ আরো অনেক মতের দল আছে। রাজনৈতিক দলগুলো কি ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রস্তুত? সাধারণত গণতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবস্থায় জনগণের ভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে কতটা ইনক্লুসিভ বা অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা প্রচলন আছে তা নিয়ে ভাবতে হবে। তবে তারও আগে ইনক্লুসিভ বা অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ও সামাজিক নয়া বন্দোবস্তর রূপরেখা বোঝা জরুরি।
ইনক্লুসিভ বা অংশগ্রহণমূলক সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলতে মূলত সকল কাজে সমাজের সকল শ্রেণির সমান অংশগ্রহণ করাকে বোঝায়। সমাজের দুইটি বিপরীতমুখী শ্রেণির মানুষ একই রকম সুযোগ সুবিধা ও মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবেন। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সবাই এক। কারো মধ্যে ভেদাভেদ করা যাবে না। যোগ্যতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবাই সমাজে নিজ নিজ স্থান অর্জন করবেন। এতে অন্য কোন পক্ষের কোনরূপ অসন্তুষ্টি দেখানো চলবে না। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে উন্নত দেশগুলোর সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ঠিক এরকম। আর উন্নত বিশ্বে এই সমাজ ব্যবস্থাকে সেক্যুলার ব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাহলে বাংলাদেশ ইনক্লুসিভ এবং সেক্যুলারের দুইটি ভিন্ন অর্থ কেন দেখা যাচ্ছে?
বাংলাদেশের বড়ো দুইটি রাজনৈতিক দল হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এই দলগুলোতে কি সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের সমান অংশগ্রহণ রয়েছে? উত্তর হচ্ছে না! এই দুইটি দলের ক্ষমতায় দীর্ঘদিন ধরে একটি নিদিষ্ট পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন। এতে দলগুলোর মধ্যে সকল শ্রেণির মানুষের সমান অংশগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। এতে দল দুইটির ক্ষমতার কেন্দ্রে কখনো মুচি বা মেথরের ছেলে হতে পারবেন না। রাজার পর রাজার ছেলে/মেয়ে যেমন সিংহাসনে বসেন ঠিক তেমনি এখানেও নেতার পর তার সন্তান-সন্ততি ক্ষমতায় যাবেন। সাধারণ মানুষের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ কোনদিন পাবেন না। তাই দলগুলোর মধ্যে ইনক্লুসিভ বা সবার অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক চর্চা সম্ভব নয়। অন্যদিকে নামে মাত্র ক্ষমতার পালাবদল কে গণতন্ত্র বলে দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বামদলগুলো সবার অংশগ্রহণে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাইলেও তাদের দলের মধ্যে সেটার চর্চা নাই। একটি বামদলের নেতৃত্ব কখনো কোন মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ নাই। কারণ বামদলগুলোতে কোন নিদিষ্ট ধর্মের মতাদর্শ অনুসারী ব্যক্তির স্থান তেমন শক্তিশালী নয়।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ন্যায় ও সাম্যের কথা বললেও মূলত অংশগ্রহণ মূলক রাজনীতি তাদের পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় মতাদর্শ এই কাজে তাদের সমর্থন দিবে না। তাই ভিন্ন ধর্মের কারো ন্যায় ও যোগ্যতা থাকলেও ইসলামিক দলের প্রধান হতে পারবেন না। তাছাড়া সমাজের অনগ্রসর ব্যক্তিও এসব দলগুলোর দলের প্রধান হতে পারবেন না। তাই এসব দল ক্ষমতায় গেলেও রাজনীতিতে সমান অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে আপাত দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক ও ইনক্লুসিভ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এক সাথে পুরোপুরি সম্ভব নয়। এখানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোতে বিভিন্ন মতের দল রাজনীতি করে ক্ষমতায় যেতে চায়। অথচ প্রকৃত গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এধরণের কোন সুযোগ নেই। প্রতিটি দল যে মতাদর্শ অনুসরণ করুক না কেন তাদের দলকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কে স্বীকৃতি দিয়ে তবেই রাজনীতি করতে হবে। তাই উন্নত বিশ্বে আমরা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি দেখতে পেলেও বাংলাদেশে তা দেখা যাচ্ছে না। শুধু মুখে মুখে আমার দলে সবচাইতে বেশি গণতন্ত্র চর্চা হয় এই কথা বলে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ইনক্লুসিভ বা অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাইলে লাভ হবে না।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।

