somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গণতন্ত্র ও নির্বাচিত শব্দের নয়া ব্যাখ্যা দিলেন ফরিদা-মজহার দম্পতি !

১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুটা ছিল জনতার কণ্ঠে, এখন সেটা রূপ নিচ্ছে কিছু নির্দিষ্ট গলার একচেটিয়া লোকের তর্জন-গর্জনে । শুরুর দিকে বলা হয়েছিল, এটা অস্থায়ী সরকার—জনগণের দাবিতে, জনগণের জন্য। এখন সেই সরকারই জনগণের প্রশ্ন শুনলে কান বন্ধ করে রাখে, এবং ভোটের প্রসঙ্গ এলেই ‘কমিউনিটি’ আর ‘স্মৃতি’র নাম করে রাষ্ট্রচিন্তার নতুন তত্ত্ব হাজির করে। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা শুনতে পাই ফরহাদ মজহারের মতো কবি ও রাষ্ট্রচিন্তকের বক্তব্য—“ভোটে গণতন্ত্র আসে না, কমিউনিটি দাঁড়ালে গণতন্ত্র আসে।” এ যেন এক কবিত্বপূর্ণ অভিজ্ঞান, যেখানে নাগরিক মতামতের দরকার নেই , দরকার সোশ্যাল মিডিয়ায় যাদের আধিপত্য চলে সেই বট বাহিনীর মৌখিক সম্মতি।

কমিউনিটি শব্দটা এখন একধরনের ছদ্মনাম হয়ে গেছে—এটা যেন নির্দিষ্ট রাজনীতি, নির্দিষ্ট বিশ্বাস, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর একরকম সাংস্কৃতিক জোন, যেখানে সিদ্ধান্ত হয় চা খেতে খেতে, গান শুনতে শুনতে, কিংবা ফেইসবুকিং করতে করতে । কিন্তু তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কোথায় ? যে পরিবারগুলো শহীদ হয়েছে, যারা আহত হয়েছেন, যারা এখনো মামলার শুনানিতে হেনস্তা হন—তারা কি এই কমিউনিটির সদস্য, নাকি কেবল রাজনৈতিক আলংকারিকতা ?

ফরহাদ মজহারের বক্তব্যের পেছনে আরেকটি বাস্তবতা আছে, যেটা এড়িয়ে গেলে লেখাটাই অসম্পূর্ণ থাকে। তার স্ত্রী ফরিদা আখতার এই অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা। এবং তিনিও সগর্বে বলছেন, “আমরা অনির্বাচিত—এটা কে বলল?” এই প্রশ্নটি এমন একজন করছেন, যিনি স্বয়ং কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ না নিয়েই রাষ্ট্রশক্তির ঘনিষ্ঠতম বৃত্তে বসে আছেন। তারা বলছেন, ছাত্র-জনতা তাদের নির্বাচিত করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ছাত্ররা কি তাদের ভোট দিয়েছিল ? নাকি তারা আন্দোলনের ঢেউয়ে চেপে এসেছেন, এখন সেই ঢেউকে পাথরে বেঁধে রাখতে চাইছেন ?

এখানে একটা মৌলিক অসততা কাজ করছে। প্রথমে গণঅভ্যুত্থানের ঘোড়ায় চড়ে সরকারে আসা, তারপর সেই সরকারের আসল কর্তব্য ও দায় এড়িয়ে কমিউনিটির নামে তার চারপাশে এক ধরণের আবেগতাড়িত অদৃশ্য গোষ্ঠী তৈরি করা। এই গোষ্ঠী অন্ধের মতো সরকারের সকল কাজকে সাপোর্ট দিয়ে যাবে এবং কোনো প্রশ্ন করবে না। সরকার বারবার কমিউনিটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতবাদ হিসাবে প্রচার করে সংস্কারের নামে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করবে। আর ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে থাকবে 'অল্প পরিসরে সংস্কার' ও 'বেশি পরিসরে সংস্কার ' নামক মূলা।

এই নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্রেমওয়ার্কে ভোটকে তাচ্ছিল্য করা হয় এক ধরনের নোংরা ব্যবসা হিসেবে, যেন সেটি কেবল মাফিয়া শ্রেণির খেলা। অথচ বাস্তবতা হলো—ভোটহীন রাষ্ট্রেও একই শ্রেণিই টিকে থাকে, শুধু তারা তখন ‘কমিউনিটি প্রতিনিধি’, ‘আন্দোলনের উত্তরাধিকারী’, ‘স্মৃতির ভারবাহী’ ইত্যাদি অদ্ভুত অভিধায় নিজেকে বৈধ করে। আর এখানেই ‘কমিউনিটি’ শব্দটি হয়ে পড়ে একধরনের কৌশলী স্বৈরতন্ত্র ।

এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র তৈরি হয় জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া, কিন্তু জনগণের নামেই। একদিকে মবতন্ত্র যার জ্বালায় অতিষ্ঠ মানুষ , অন্যদিকে স্মৃতির রাজনীতি—সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হতে যাচ্ছে এমন এক পরিবেশ, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের প্রশ্ন করতে মানুষ ভয় পাবে। আর এই ভয়ের কারণ 'কমিউনিটি'র আবেগ । আর আবেগকে প্রশ্ন করা মানেই হয় রাষ্ট্রদ্রোহ, নয়তো শহীদের অসম্মান।

এই সমস্ত রাজনৈতিক ইনসেনটিভের কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতার গভীরতম মেরুকরণ, যেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, দাম্পত্য জুটি, এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ একধরনের অলিখিত চুক্তিতে বাঁধা পড়েছে। জনগণ এখানে শুধু শ্রোতা, বক্তা নয়। তারা শুনবে শহীদের গল্প, তাদের রক্তের ইতিহাস, কিন্তু প্রশ্ন করতে পারবে না—“আমার ভোটের অধিকার কবে ফেরত পাবো ?”

এই অবস্থা চলতে থাকলে, আরেকটি স্বৈরতন্ত্রের জন্ম হবে, যার নাম গণতন্ত্র হবে ঠিকই, কিন্তু সেটা হবে “কমিউনিটির অভিমত-ভিত্তিক ভোটবিহীন জনগণের সরকার”। শহীদ পরিবারগুলোর ত্যাগ সেখানে হবে ‘আবেগী স্থাপত্য’, তাদের জীবন হবে ভিজ্যুয়াল ইনস্টলেশন, এবং তাদের রক্ত হবে রাষ্ট্রীয় পোস্টারে ছাপা একধরনের পবিত্র কালি।



সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১২:০১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প- ৯৩

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:২৮




দুই ভাইবোন। আপন দুই ভাইবোন।
ভাই-বোন দু'জন আলাদা হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। কথাবার্তা নেই। একজন যেন আরেকজনের শত্রু। বাপের সম্পত্তির কারণে আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইচ্ছে করে ঘুরে বেড়াই=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:১২


এই উষ্ণতায় ইচ্ছে করে ঘুরে বেড়াই নদীতে সমুদ্দুরে
বালুচরে হেঁটে বেড়াই,
ঢেউয়ে থাকি বসে, জল এসে ছুঁয়ে দিক আমায়,
হিম হাওয়া এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাক সুখের সপ্ত আসমানে।

এই বৈশাখে ইচ্ছে করে পুকুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি শেষ কবে একটি বই পড়েছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২২


আজ ২৩ এপ্রিল, বিশ্ব বই দিবস। অনেকেই একে বলেন ‘বিশ্ব গ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস’। ইউনেসকোর উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে দিনটি পালিত হয়ে আসছে বই, লেখক এবং কপিরাইট রক্ষার বার্তা নিয়ে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেমিট্যান্সযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:১৫

টাকা পাচারকারীদের ধরা খুব মুশকিল বলে উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী বলেছেন, টাকা পাচারকারীদের যদি কোনোভাবে ধরতে পারেন, তাহলে ছাড় দেবেন না। আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিশুদের গুড টাচ ব্যাড টাচ শেখানো আপনার দায়িত্ব

লিখেছেন অপলক , ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১১:৩৪

বর্তমানে বাংলাদেশে একক পরিবার বেশি। আগের যুগে যৌথ পরিবারে শিশুরা বয়োজৈষ্ঠ্যদের কাছে অনেক কিছু শিখত, নিরাপত্তা পেত। এখন সে সুযোগ অনেকটাই কম। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ৫ বছরের শিশুও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×