
একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে নিঃশব্দ অথচ গভীর যুদ্ধ চলে তার ইন্টেলেকচুয়াল সেক্টরে। গোলা-বারুদের বদলে এখানে অস্ত্র হয় কলম, টকশো, নাটক, পাঠ্যবই, এবং ইউটিউব। বাংলাদেশে এই হেজেমনি বহুদিন ছিল প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও কিছু তথাকথিত ‘লিবারেল’ প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে—যারা একদা মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নাম করে বুদ্ধিবৃত্তিক স্পেস গড়ে তোলে। তারা সংস্কৃতির অভিভাবক হয়ে ওঠে, কিন্তু সমস্যা হলো, অভিভাবকত্বই যখন একচেটিয়া হয়ে যায়, তখনই সেখানে কাউন্টার হেজেমনির জন্ম নেয় ।
বর্তমানে একদল তথাকথিত “ডানপন্থী” ইউটিউবার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট তিন বছরের সাংস্কৃতিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে—উদ্দেশ্য: প্রথম আলো-ডেইলি স্টারকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা, এবং নিজেদের মতাদর্শ দিয়ে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী-বিন্যাস দাঁড় করানো। তারা কখনো পত্রিকা অফিসের সামনে জিয়াফতের মাধ্যমে হুমকি দেয়, কখনো ডানপন্থী চরমপন্থীদের মাঠে নামায়। তারা মনে করে, এই মিডিয়াগুলো ধার্মিক মানুষদের অসম্মান করে। অথচ নিজেদের অবস্থান থেকেই তারা এক ধরনের ইন্টেলেকচুয়াল ইনকুইজিশন কায়েম করছে, যেখানে মুক্তচিন্তা নয়, বরং ভাবধারাগত নৈরাজ্যই নায়ক হয়ে ওঠে।
ইন্টারিম সরকার যখন নারী অধিকার সংস্কার কমিশনে নারী ও পুরুষের সমান সম্পত্তির সুপারিশ(ঐচ্ছিক) করে, তখন সেই সুপারিশকেই ‘ধর্মবিরোধী ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাস্তায় নামে একদল ডানপন্থী নারী। তারা ধর্মীয় আবরণে নারী-বিরোধী ব্যাখ্যাকে রাজনীতিকরণ করে। অথচ এই সংস্কার কোনো আইন নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রস্তাব, যা সমাজের অংশীজনের মতামত ছাড়া বাস্তবায়িত হবে না। কিন্তু এখানে যে প্রবণতাটি ভয়ঙ্কর, তা হলো : উগ্র ডানপন্থীরা এখন তাদের নিজস্ব নারীবাহিনী তৈরি করছে , যারা নারীর অধিকারের নামে পিতৃতন্ত্রের বর্ম হয়ে দাঁড়ায়। তাদের চোখে নারী অধিকার মানে গৃহবন্দি শান্ত নারী, যে প্রশ্ন তোলে না।
নতুন আরেকটি ইস্যু: এনআইডি কার্ডে ছবি না দেওয়ার দাবী। কিছু ডানপন্থী নারী শুধু ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিচয় দিতে চান। তারা মনে করেন, পুরুষের দৃষ্টিতে প্রকাশিত হওয়াই নারীত্বের অবমাননা। একদিকে তারা প্রযুক্তিকে গ্রহণ করছেন, অন্যদিকে নারীর নিজস্ব পরিচয়কে দৃশ্যপট থেকে মুছে দিতে চাচ্ছেন। এটি এক ধরনের ডিজিটাল শরম সংস্কৃতি, যেখানে নারীর অস্তিত্ব নয়, পুরুষ-ভীতির রাজনৈতিক বিন্যাস গুরুত্ব পায়।
বর্তমানে উগ্র ডানপন্থীরা একটি রাষ্ট্রায়িত নারী মডেল দাঁড় করাচ্ছে—যারা ধর্মীয় পোশাক পরে, বাইরে কাজ করে, কিন্তু আদর্শ স্ত্রী, আনুগত্যশীল মেয়ে এবং পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিতে সুশোভিত মুখপাত্র। তারা নারীদের বিদেশিদের সাথে পরিচয় করাচ্ছে , মঞ্চে তুলে দেখাচ্ছে, “দেখো, আমাদের নারীরাও সফল।” এটি একধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘ফেমিনিজম’ , যা নারীর আত্মনির্ভরতা নয়, বরং নারীকে একটি জাতীয় প্রকল্পের অংশ বানায়। এই নির্মাণের বিপরীতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নারী ‘সতিত্বহীন’, চাকুরিরত নারী ‘পরকিয়ায় জড়িত’। এসব ধারণা নারীর ব্যক্তিত্বকে এক ধরনের নৈতিক নজরদারির কারাগারে বন্দি করে।
এক সময় শাহবাগ আন্দোলন ছিল স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রজন্মের বিবেক। কিন্তু উহা যে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা কে দীর্ঘায়িত করার কৌশল ছিলো তা সে সময়কার প্রজন্ম বুঝতে পারে নাই। তখন সেই আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে উগ্র ডানপন্থীরা রচনা করেছিলো নতুন ন্যারেটিভ: “তারা নাস্তিক, মুরতাদ, চরিত্রহীন।” এখন সুযোগ পেয়ে তারা শাহবাগ বিরোধী মঞ্চ গড়েছে, যাতে মূলত একাত্তরের পরাজিত তাদের নেতাদের সাজাভোগের প্রতিশোধ চরিতার্থ করা যায় । এখনো কেউ যদি উহাদের নেতাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে বলে এসব ছদ্মবেশি রা তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। এটি নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার এক রাজনৈতিক প্রতিশোধ প্রকল্প , যেখানে ইতিহাস মুছে ফেলে বিকৃতির রাজনীতি কায়েম করা হয়।
বাংলাদেশের এই ডানপন্থী কাউন্টার হেজেমনি আসলে একা দাঁড়ায়নি। এদের অনেক তাত্ত্বিক ভাষ্য এবং সামাজিক প্রকল্প ভারতের হিন্দুত্ববাদী হেজেমনির ছায়ায় অনুপ্রাণিত । একদিকে ভারতে সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করে একজাতিক রাষ্ট্র গঠন চলছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে তদ্রূপ একধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠ উগ্র জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা হচ্ছে, যা একইভাবে নারীর অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে পরিচালিত। দু’পাশেই ‘ধর্ম’ হলো মুখোশ, ভেতরে শুধু ক্ষমতা ও আধিপত্যের যৌথ প্রকল্প ।
প্রথম আলো-ডেইলি স্টার বা গণজাগরণ মঞ্চ নিঃসন্দেহে একধরনের আধিপত্য তৈরি করেছিল। তবে যারা এখন “সাংস্কৃতিক বিপ্লব” ও “জাতীয় আত্মপরিচয়”র নামে নতুন হেজেমনি গড়ছে, তারা আদতে বিকল্প নয়। তারা একই আধিপত্যের উল্টো পিঠ , যেখানে আধুনিকতাবিরোধিতা, নারী বিদ্বেষ এবং ঐতিহাসিক প্রতিশোধবোধ: এই তিনে তৈরি হয় এক সাংস্কৃতিক দানব। এটা আর কেবল মিডিয়া যুদ্ধ নয়—এটা চিন্তার, সত্যের ও ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার যুদ্ধ , যেখানে সত্য নয়, প্রভাব বিস্তার করাই মূল লক্ষ্য ।
হেজেমনি বনাম কাউন্টার হেজেমনি যুদ্ধের মাঝে পড়ে আছে সমাজের সেই শ্রেণি, যারা বিকল্প চায়, কিন্তু আধিপত্য চায় না। তারা বুঝে গেছে: একদল মুখোশ পরা আধুনিকতা, আরেক দল মুখোশ খুলে মুখে জাতীয়তাবাদ, হাতে প্রতিশোধ । প্রশ্ন একটাই: সত্যিই কি আমরা মুক্তির পথ খুঁজছি, না কি শুধু মালিক বদল করছি, শাসন বদলাচ্ছি না ?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০২৫ রাত ১২:৫০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



