somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু – স্লোগান নয়, রক্তের সত্য

১৪ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১৪ জুন, ১৯২৮। আর্জেন্টিনার রোস্যারিও শহরে জন্ম নেয় এক শিশু, যে ছিল ভবিষ্যতের সবচেয়ে অস্থির প্রশ্নগুলোর উত্তর। তার নাম—আর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না । কিন্তু ইতিহাস তাকে চিনেছে এক ছোট ডাকনামে: চে। এই ডাকনামটাই একদিন পরিণত হবে নিপীড়িত মানুষের কান্নার প্রতিধ্বনিতে, দুনিয়াজোড়া শোষণের বিরুদ্ধে এক গেরিলা শ্লোগানে।

চে ছিলেন উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। কিন্তু তাঁর হৃদয় কাঁদতো নিপীড়িত মানুষের জন্য । মেডিকেল পড়ার ফাঁকে তিনি মোটরবাইকে ঘুরে দেখলেন গোটা লাতিন আমেরিকা। সেখানে তিনি দেখলেন: মেডিসিন নয়, প্রয়োজন ন্যায়বিচার। হাসপাতাল নয়, দরকার বিপ্লব। চিকিৎসার জন্য স্টেথোস্কোপ ছাড়লেন, হাতে তুলে নিলেন বন্দুক, পকেটে নিলেন কবিতা।

১৯৫৫ সালে মেক্সিকোতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ফিদেল কাস্ত্রোর। তখন থেকেই শুরু হয় দুজনের মিলিত যাত্রা: কিউবার বাতিস্তা সরকারের পতনের লক্ষ্যে গেরিলা যুদ্ধ । জঙ্গলে যুদ্ধ করতেন, আবার রাতে রোগীর সেবা করতেন। সৈন্যদের শেখাতেন কিভাবে গুলি চালাতে হয়, আবার শেখাতেন পত্রিকা পড়া। চে বিশ্বাস করতেন—বিপ্লব মানে শুধুই বন্দুক নয়, বিপ্লব মানে চিন্তা। বিপ্লব মানে—আত্মত্যাগ।

চে বিশ্বাস করতেন, শোষণ কখনো এক দেশে সীমাবদ্ধ থাকে না—এটা বিশ্বব্যাপী ছড়ানো ভাইরাস। তাই কিউবার বিজয়ের পর তিনি চলে গেলেন আফ্রিকায়, সেখান থেকে বলিভিয়া। তাঁর লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক বিপ্লব। তাঁর উপস্থিতি মানেই ছিল—একটি দেশের অভ্যন্তরে আগুন জ্বালানো, সাম্রাজ্যবাদের দম্ভকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। সিআইএ তখন চে-কে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তাঁকে নিয়ে ছড়ানো হয় অপপ্রচার। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, চে কে হত্যা করা যায়, থামানো যায় না।

১৯৬৭ সালের অক্টোবরে বলিভিয়ার জঙ্গলে ধরা পড়েন চে। বন্দি অবস্থায় শেষবারের মতো বলেছিলেন: “আমি জানি তোমরা আমাকে মারবে। কিন্তু একজন মানুষকে মারা যায়, আদর্শকে নয়।” তাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়, কিন্তু তখনই তিনি ইতিহাসে ঢুকে পড়েন। তাঁর মৃত্যু ছিল না; সেটা ছিল রূপান্তর। চে পরিণত হলেন এক প্রতীকে—যা কখনো ফুরোয় না, নিভে না, ভোলে না।

আজ, ২০২৫ সালের ১৪ জুনে দাঁড়িয়ে, চে-র মুখ এখনো দেয়ালে, টিশার্টে, আন্দোলনের মিছিলে। কিন্তু বড় প্রশ্ন – আমরা কি সত্যিই চে-কে ধারণ করি, নাকি আমরা তাঁকে পণ্য করে ফেলেছি ? চে গেভারাকে স্মরণ মানে কেবল তাঁর মুখ আঁকা গেঞ্জি পরা নয়। তাঁকে মানে বোঝা – তার মত অপরাজেয় নৈতিক শক্তিকে আঁকড়ে ধরা, যখন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও লোভ মানবতাকে গিলে খেতে চায়। চে ছিলেন বিপ্লবের কবি, গেরিলা চিকিৎসক, বৈশ্বিক সাম্যবাদের প্রতীক – এমন এক মানুষ যিনি নিজের সমস্ত আরাম, শিক্ষা, পরিচয় ছেড়ে দিয়ে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। চে বলেছিলেন: “If you tremble with indignation at every injustice, then you are a comrade of mine.” ("তুমি যদি প্রতিটি অন্যায়ে কেঁপে ওঠো, তবে তুমি আমার সহযোদ্ধা।”)। তাঁকে ধারণ করতে হলে চাই সাহস, ঘৃণা নয়। চাই প্রেম—শোষিতের জন্য, নিপীড়িতের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য।

চে ছিলেন একধরনের আত্মদাহের মত মানুষ। তিনি জানতেন, হয়তো সফল হবেন না। তবু যুদ্ধে নেমেছিলেন। কারণ তাঁর কাছে পরাজয় মানে ছিল চেষ্টা না করা । চে বলেছিলেন, "The true revolutionary is guided by a great feeling of love." এই ভালোবাসা ছিল শোষিতের প্রতি, নিপীড়িতের প্রতি, ভবিষ্যতের প্রতি। তিনি আছেন কাশ্মীরে অশ্রু মুছতে থাকা তরুণের চোখে, গাজার ধ্বংসস্তূপে হাতড়ানো মায়ের কান্নায়, লাতিন আমেরিকার কৃষকের বিক্ষোভে, অথবা একজন বাংলার সাহসী ছাত্রের কণ্ঠে, যে বলে; “এই দুনিয়া আমাদের নয়, কিন্তু এই দুনিয়ার পরিবর্তন আমাদের দায়িত্ব।”

চে গেভারা কখনো বলেছিলেন, “আমার মৃত্যু যদি তোমার হৃদয়ে আগুন জ্বালায়, তবে আমি মৃত্যুকে স্বাগত জানাই"। চে গেভারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন—বিপ্লব মানে কেবল ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়ানো নয়, তা নিজেকে প্রশ্ন করাও। আপনি চে-কে ভালোবাসতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন, কিন্তু অবজ্ঞা করতে পারবেন না। কারণ চে একবার বলেছিলেন: “Shoot, coward! You are only going to kill a man.”

আমরা জানি, সে দিন এক মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু জন্ম নিয়েছিল এক আগুন।


সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২৫ রাত ১০:০৬
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৩৬ জুলাই আন্দোলনে সাবেক আর্মি অফিসারদের অবদান

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২৩

ফাছিহ তখন সিলেটে মুভ করছে, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। আহত আন্দোলনকারীদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঠিক তখন, তার মুঠোফোনে কল আসে আর্মির একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মোবাইলফোন থেকে। তিনি বললেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চীন সফরের রাজনীতি ও বাংলাদেশের দ্বিধাদ্বন্দ্ব: বিএনপি-জামায়াত কী খুঁজছে চীনে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:০৫


বাংলাদেশের রাজনীতি যখন নির্বাচনী অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের নিচে পিষ্ট, তখন একের পর এক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চীন সফর এক ধরনের কৌশলগত স্পর্ধার ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি ইতোমধ্যে চারবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আঠারো শতকে বাংলায় ইহুদি বণিক: এক বিস্মৃত অধ্যায়

লিখেছেন কিরকুট, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ১০:২৪





বাংলার ইতিহাসে মুসলিম, হিন্দু, ইংরেজ এবং আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি নিয়ে বহু আলোচনা হলেও, একটি স্বল্পপরিচিত গোষ্ঠী — ইহুদি বণিকরা — প্রায় নজরের বাইরে থেকে গেছে। ১৮শ শতকে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জরিপঃ আপনি কি চান ব্লগার ওমর খাইয়াম আপনার পোস্টে কমেন্ট করুন?

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১০ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ১২:২৪



ব্লগার ওমর খাইয়াম একটু কঠিন মন্তব্য করেন। অনেকের পক্ষেই তা সহ্য করা সম্ভব হয় না। কেউ তাকে ব্যান করেন, আবার কেউবা রিপোর্ট করেন। আপনি যদি তাকে কখনো বলেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ পরিচালনায় জামায়াত কতটা দক্ষতা দেখাতে পারে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১০ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:০৭



জামায়াত শিবির একটি সুসংগঠিত সংগঠন। সেই তুলনায় বিএনপি, জাতীয়পার্টি এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত আম্লিগ সুসংগঠিত নয়। জামায়তের সংগে বিএনপি, জাতীয়পার্টি এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত আম্লিগের বিশাল ফারাক লক্ষ করা যায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×