somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংরক্ষিত নারী আসন: সংস্কারের নামে চাপিয়ে দেওয়া, না কি গোপন এজেন্ডার বাস্তবায়ন?

১৭ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশে সংস্কারের নামে আজ যে কাণ্ড চলছে, তা দেখে পুরনো প্রবাদটি মনে পড়ে—"অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।" একটি ইন্টেরিম সরকার, যাদের চেয়ারে বসা একটি জটিল ক্ষমতার সমীকরণের ফসল, সেই সরকার এখন পুরো সমাজকে রূপান্তরের আখড়ায় পরিণত করতে চায়। যেন জনগণ তাদেরকে সামাজিক পুনর্গঠনের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দিয়েছে। এই সরকার এখন নারী-সম্পৃক্ত সংস্কার নিয়ে এমন এক একগুঁয়ে অভিযানে নেমেছে, যেখানে কেবল প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল নয়, বরং ধর্মভিত্তিক দলগুলোকেও প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলমের প্রস্তাব—সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০—প্রাথমিকভাবে যতটা প্রগতিশীল শোনায়, বাস্তবে তার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক ও আর্থিক ব্যয়ের দিকটি ততটাই উপেক্ষিত। একটা ছোট ভূখণ্ডের দেশে চারশত সংসদ সদস্য কেন প্রয়োজন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। আর ব্যয় বাড়ার হিসাব কি রাষ্ট্র বহন করতে প্রস্তুত?

নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক তো আরও একধাপ এগিয়ে। পুরুষ ও নারীর জন্য ৩০০ করে সমসংখ্যক আসন চেয়েছেন, যেখানে নারী-পুরুষ সরাসরি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ভাবনাটি “Think outside the box” ধাঁচের হলেও বাস্তবচ্যুত। কারণ একটি দরিদ্র দেশে রাজনৈতিক অতিকাঠামো তৈরি করা মানে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়।

সবচেয়ে বিতর্কিত ইস্যু হলো—এই সংরক্ষিত আসনগুলো বণ্টনের পদ্ধতি কী হবে? ইসলামপন্থী দলগুলো আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে, বিএনপি প্রচলিত নিয়মে বণ্টনের পক্ষে এবং এনসিপি চায় সরাসরি নির্বাচন। অন্যদিকে, সুশীল সমাজ ঘূর্ণায়মান ও মিশ্র পদ্ধতির প্রস্তাব রাখছে।

এই বিতর্কে উঠে এসেছে রাজনৈতিক বাস্তবতার কাঁটাতার—রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এখনো সীমিত, বিশেষ করে ইসলামপন্থী দলগুলোতে। সেখানে নারীর উপস্থিতি কেবল প্রতীকী। ফলে বাধ্যতামূলক কোটা বা মনোনয়ন দেয়ার ‘হার নির্ধারণ’ তাদের জন্য বাস্তবসম্মত নয়।

প্রশ্ন হলো—সংসদে আসন বাড়ালেই কি নারীরা দলে দলে রাজনীতিতে যোগ দেবেন? না, বরং নারী রাজনীতিকদের প্রতি অবজ্ঞা ও যৌন নিপীড়নের রাজনীতি এখনও নির্মম বাস্তবতা। সাম্প্রতিক এক ফোনালাপে এনসিপির এক নেতা প্রকাশ্যে একজন নারী নেত্রীকে “শরীরী লেনদেনের” প্রস্তাব দিতে দেখা গেছে, যা রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের পথকে আরো জটিল করে তুলবে।

এখানে "নৈতিকতা বনাম প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মতি" তর্কে না গিয়েও বলাই যায়—রাজনীতিতে নারীদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয় এসব আপত্তিকর অভিজ্ঞতার জন্যই। সরকারপক্ষ এবং বিরোধী উভয় পক্ষেই নারী নেত্রীদের নিয়ে কুৎসিত প্রচারণা নতুন কিছু নয়। এক সময় বিএনপির নেত্রী রুমিন ফারহানার প্রতি সরকারের প্রেস সচিবের করা মন্তব্য, কিংবা বিরোধী পক্ষের অপপ্রচার—এগুলো একজন নারীর আত্মমর্যাদা বিনষ্ট করার রাজনৈতিক কৌশল মাত্র।

জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া নারী নেত্রীদের একাংশ মনে করছেন—যেহেতু সরকারি চাকরিতে কোটা তুলে দেওয়া হয়েছে, তাই রাজনীতিতেও কোটা থাকা উচিত নয়। কিন্তু এটা একধরণের “False Equivalence”। চাকরি ও রাজনীতি দুটি ভিন্ন বাস্তবতা। একজন সচিবের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য—কোটা না থাকলে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু সুবিধাবঞ্চিত জেলা থেকে আগত নারী-পুরুষদের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে—বাল্যবিবাহ ও অর্থনৈতিক সংকটে নারীদের অংশগ্রহণ হ্রাস পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এইচএসসি পরীক্ষায় প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী অংশ নেবে না, যার বড় অংশ নারী। পড়াশোনার ব্যয়, সামাজিক চাপ, ও পারিবারিক অনুৎসাহ এর বড় কারণ। এই বাস্তবতা উপেক্ষা করে কেবল সংসদে আসন বাড়ালেই নারীর ক্ষমতায়ন হবে—এটা একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা।

সংস্কার তখনই টেকসই হয় যখন তা আসে জাতীয় ঐক্যমত্য থেকে, না যে কোনো ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকারের কল্পনাশ্রয়ী সংস্কার মিশন থেকে। দেশের নারীদের প্রকৃত সমস্যা বুঝতে গণজরিপ চালানো প্রয়োজন। কোন এলাকায় নারী শিক্ষা ও রাজনীতিতে প্রবেশে কী কী বাধা রয়েছে, সেই অনুযায়ী সমাধান খোঁজা উচিত।

এভাবে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার না হয়ে বরং রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য একটি নিরাপদ, সম্মানজনক এবং বাস্তবসম্মত পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। তা না হলে নারী সংরক্ষণের নামে রাষ্ট্র একটি কৃত্রিম ভারসাম্য তৈরি করবে, যা ভবিষ্যতের রাজনীতিতে আরও সংকট ও বৈষম্য ডেকে আনবে।

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৪৮
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রশ্ন করলে ড. ইউনুসকেই করতে হবে, বিএনপিকে নয়!

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:০০


৮ আগস্টের পর থেকে দেশজুড়ে নানা ধরনের অপরাধ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তার জন্য আমি কেনো বিএনপিকে প্রশ্ন করবো? বিএনপি এখন ক্ষমতায় নেই, রাষ্ট্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুলাই গনহত্যা নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদন

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:০৮

বিবিসি ৩৫ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি পাবলিশ করেছে আজ । The Battle for Bangladesh: Fall of Sheikh Hasina এই শিরোনামে। নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন হাসিনা, অডিওর সত্যতা নিশ্চিত করল বিবিসি... ...বাকিটুকু পড়ুন

৩৬ জুলাই আন্দোলনে সাবেক আর্মি অফিসারদের অবদান

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২৩

ফাছিহ তখন সিলেটে মুভ করছে, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। আহত আন্দোলনকারীদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঠিক তখন, তার মুঠোফোনে কল আসে আর্মির একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মোবাইলফোন থেকে। তিনি বললেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চীন সফরের রাজনীতি ও বাংলাদেশের দ্বিধাদ্বন্দ্ব: বিএনপি-জামায়াত কী খুঁজছে চীনে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:০৫


বাংলাদেশের রাজনীতি যখন নির্বাচনী অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের নিচে পিষ্ট, তখন একের পর এক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চীন সফর এক ধরনের কৌশলগত স্পর্ধার ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি ইতোমধ্যে চারবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জরিপঃ আপনি কি চান ব্লগার ওমর খাইয়াম আপনার পোস্টে কমেন্ট করুন?

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১০ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ১২:২৪



ব্লগার ওমর খাইয়াম একটু কঠিন মন্তব্য করেন। অনেকের পক্ষেই তা সহ্য করা সম্ভব হয় না। কেউ তাকে ব্যান করেন, আবার কেউবা রিপোর্ট করেন। আপনি যদি তাকে কখনো বলেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×