
১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর। কায়রোর নাসর সিটি প্যারেড গ্রাউন্ডে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইয়োম কিপুর যুদ্ধের বিজয় উৎসবের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করছিলেন। হঠাৎই সামরিক ইউনিফর্ম পরা একদল ব্যক্তি একটি ট্রাক থেকে নেমে এলোমেলো গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্টসহ ১০ জন নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড কেবল একজন রাষ্ট্রনায়কের জীবনেরই অবসান ঘটায়নি; এটি মিশর এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? এটি কি শুধুই একজন নেতাকে সরানোর জন্য একটি সহিংস অভ্যুত্থান, নাকি এর পেছনে ছিল আরও বৃহত্তর ও গভীরতর একটি লক্ষ্য—মিশরে একটি ইসলামী বিপ্লব প্রতিষ্ঠা ?
আনোয়ার সাদাত ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৭ সালে জেরুজালেম সফর এবং ১৯৭৯ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সাথে শান্তি স্থাপন তাকে আরব বিশ্বে একঘরে করে তোলে। মিশরকে আরব লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অভ্যন্তরীণভাবে, তার 'ইনফিতাহ' অর্থনৈতিক নীতি অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ায় এবং একটি ক্ষুদ্র শ্রেণীকে সমৃদ্ধ করে। একই সাথে, তিনি রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বাড়ান, বিরোধী নেতা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং ইসলামপন্থীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করেন। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ১,৬০০-এরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছিলেন, যা ছিল হত্যাকাণ্ডের মাত্র চার সপ্তাহ আগে।
সাদাত হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয় 'মিশরীয় ইসলামিক জিহাদ' নামক একটি জঙ্গি সংগঠন। হামলার নেতা লেফটেন্যান্ট খালেদ ইসলামবুলি এবং পরিকল্পনাকারী সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবুদ আল-জোমর সহ বেশিরভাগ অভিযুক্তই ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য। তারা ছিল ইসলামের নামে একটি কট্টরপন্থী, বিপ্লবী আদর্শে বিশ্বাসী। তাদের দৃষ্টিতে, সাদাত ছিলেন একজন 'মুরতাদ' (ধর্মত্যাগী) । তিনি ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি করে মুসলিম বিশ্বের সাথে "বিশ্বাসঘাতকতা" করেছিলেন। তিনি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি শরিয়া আইন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করেননি এবং ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিলেন।
হত্যাকারী আবুদ আল-জোমর তার সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেছেন, কেবল সাদাতকে হত্যা করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল না। এটি ছিল একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ। তাদের আসল লক্ষ্য ছিল মিশরে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত করা, সরকার উৎখাত করে একটি খিলাফত-ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তারা ১৯৮৪ সালে এই বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু সাদাতের ব্যাপক গ্রেফতারির কারণে তাদের সময়সূচি তরান্বিত করতে বাধ্য হয়।
হত্যাকাণ্ড সফল হলেও তাদের ইসলামী বিপ্লবের পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। এর প্রধান কারণগুলো ছিল: সাধারণ মিশরীয় জনগণ এই হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গি পদ্ধতিকে সমর্থন করেনি। এটি একটি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ষড়যন্ত্র ছিল। সাদাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক দ্রুত ক্ষমতা দখল করেন এবং সামরিক বাহিনীর বিশাল অংশ তার প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করে। ক্ষমতার রূপান্তর মসৃণ ছিল। মোবারক সরকার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে শত শত মানুষকে গ্রেফতার করে। ইসলামিক জিহাদ-এর নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হয়।
হত্যাকারীদের লক্ষ্য অর্জিত না হলেও এই ঘটনা মিশর ও অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে: মোবারকের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের সূচনা হয়। মিশরে রাজনৈতিক ইসলামী দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন আরও তীব্র হয়, যা পরবর্তীতে আরও চরমপন্থাকে উৎসাহিত করে। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত এক তরুণ চিকিৎসক, আয়মান আল-জাওয়াহিরি, পরে আল-কায়েদার নেতা হয়ে ওঠেন এবং বিশ্বজুড়ে জিহাদি আন্দোলনের একটি প্রধান মতাদর্শগত চালিকাশক্তিতে পরিণত হন। এটি মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার একটি নতুন চক্রের সূচনা করে।
আনোয়ার সাদাতের হত্যাকাণ্ড ছিল একটি আদর্শগত সংঘাতের চূড়ান্ত প্রকাশ। হত্যাকারীরা বিশ্বাস করত যে একজন 'বিশ্বাসঘাতক' নেতাকে হত্যা করাই তাদের দেশকে পুনরুদ্ধার করার এবং আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার পথ। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, তাদের এই সহিংস পথটি ভুল ছিল। এটি মিশরকে গণতন্ত্র ও উদারনীতির পথ থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিল এবং দশকগুলোর জন্য একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সাদাতের হত্যা তাই শুধু একটি রাজনৈতিক assassination নয়; এটি একটি সতর্কবার্তা—কোনো সমাজের গভীর মতাদর্শগত বিভাজন কীভাবে চরম সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত করতে পারে, তার একটি মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



