
১৯৯০ সালের এক রাতে ব্রাসেলসের রাস্তায় যে গুলিবর্ষণ হয়েছিল, তা শুধু একজন বিজ্ঞানীর মৃত্যু ছিল ন। এটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার এক নীরব যুদ্ধ। ইতিহাসে অনেক রাজা-বাদশাহর গল্প আছে যারা অসম্ভব স্বপ্ন দেখেছেন। কেউ পিরামিড বানিয়েছেন, কেউ দেয়াল তুলেছেন। কিন্তু সাদ্দাম হুসেইনের স্বপ্ন ছিল আরও ভয়ংকর: একটি দানবীয় কামান, যা শত্রুদের ভূমিতে মৃত্যু বর্ষণ করবে। কীভাবে একটি বৈজ্ঞানিক স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক দুঃস্বপ্ন এবং কেনইবা একটি সুপারগানের জন্য একজন নিরীহ বিজ্ঞানীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ?
১৯৮১ সালে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো ইরাকের পারমাণবিক চুল্লি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। সাদ্দাম হুসেইন তখন বুঝতে পারেন, প্রচলিত অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তিনি তার উপদেষ্টাদের বলেন, "আমার এমন কিছু চাই যা ইসরায়েলের গভীরে গিয়ে আঘাত করতে পারবে, কিন্তু তারা আটকাতে পারবে না।" তখনই তার কাছে এক অদ্ভুত প্রস্তাব আসে: একজন কানাডীয় বিজ্ঞানী এমন একটি কামান বানাতে পারেন, যার গোলা ১০০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়বে। শুনতে পাগলামি মনে হলেও সাদ্দাম আগ্রহী হন। তাকে জানানো হয়, এই কামানটি হবে প্রায় ১৫৬ মিটার লম্বা, যা একটি ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়। এই ছিল তার খোঁজা সমাধান।
জেরাল্ড বুল ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম ছিলেন। তিনি জুল ভার্নের "From the Earth to the Moon" বইটি পড়ে স্বপ্ন দেখতেন যে রকেটের চেয়ে কামান দিয়েই সহজে মহাকাশে পৌঁছানো যাবে। ১৯৬০-এর দশকে তার একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প রাজনৈতিক কারণে বন্ধ হয়ে যায়, যা তাকে হতাশ করে। তবে তিনি জানতেন, একদিন সুযোগ আসবে। সেই সুযোগ আসে ১৯৮৮ সালে, যখন সাদ্দামের প্রতিনিধিরা তার কাছে এক অভূতপূর্ব প্রস্তাব নিয়ে আসেন যেখানে অসীম অর্থ এবং সর্বোচ্চ গোপনীয়তার বিনিময়ে এমন একটি কামান বানাতে হবে যা ইসরায়েলকে আঘাত করতে পারবে। বুল রাজি হয়ে গেলেন, কারণ এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ।
প্রকল্পটি দুটি ধাপে শুরু হয়: পরীক্ষামূলক বেবি ব্যাবিলন এবং আসল দানব বিগ ব্যাবিলন। বিগ ব্যাবিলন ছিল ১৫৬ মিটার লম্বা, ১ মিটার ব্যাসের এবং ২১০০ টন ওজনের একটি বিশাল কামান, যার পরিসর ছিল ১০০০+ কিলোমিটার। এত বড় কামানের যন্ত্রাংশ কেনা সহজ ছিল না। বুল একটি জটিল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন এবং ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে 'শিল্প যন্ত্রাংশ' হিসেবে কামানের অংশগুলো গোপনে অর্ডার করেন। কিন্তু ১৫৬ মিটার লম্বা একটি কামান লুকিয়ে রাখা অসম্ভব ছিল। ইরাক দাবি করে এটি 'মহাকাশ গবেষণা প্রকল্প' হলেও, গোয়েন্দারা বোকা ছিলেন না।
ইউরোপীয় কাস্টমস কর্মকর্তারা সন্দেহজনক চালানগুলো লক্ষ্য করেন। একই সময়ে, সৌদি ঠিকাদার মোহাম্মদ বিন আওয়াদ বিন লাদেন (ওসামা বিন লাদেনের বাবা ) ইরাক-সৌদি সীমান্তে এই গোপন প্রকল্পের কথা জানতে পারেন। তিনি এই তথ্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কে দেন। ইসরায়েলের জন্য এটি ছিল জাতীয় নিরাপত্তার এক বিশাল হুমকি, কারণ এই কামান ১০০০ কিলোমিটার দূর থেকে ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায় রাসায়নিক অস্ত্র বহনকারী ২ টনের গোলা নিক্ষেপ করতে পারত।
মোসাদ প্রথমে বুলকে সতর্ক করার চেষ্টা করে, কিন্তু তিনি এ সব উপেক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত মোসাদ তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং 'অপারেশন বিগ পিনেস' শুরু করে। ১৯৯০ সালের ২২শে মার্চ, বুল নিজের ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছালে পেছন থেকে একটা ছায়া এগিয়ে এল। তার সাথে ছিলো সাইলেন্সার লাগানো ৭.৬৫ মিমি পিস্তল। মাথায় তিনটি, গলায় দুটি গুলি। তাৎক্ষণিক মৃত্যু। হত্যাকারী নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। পুলিশ এসে দেখল: ব্রিফকেসে ২০,০০০ ডলারের বেশি অর্থ অক্ষত, কোনো ডাকাতির চিহ্ন নেই এবং কোনো আঙুলের ছাপও নেই। এটা স্পষ্টত একটি পেশাদার হত্যাকাণ্ড।
সুপারগানের কিছু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ছিল, যেমন: এটি একবার বসালে সরানো যেত না, নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারত না এবং লোড করতে অনেক সময় লাগত। তবে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল রাজনৈতিক বাস্তবতা। এত বড় একটি প্রকল্প সম্পূর্ণ গোপন রাখা সম্ভব ছিল না। আওয়াদ বিন লাদেনের তথ্য ফাঁস, ইউরোপীয় কাস্টমসের সন্দেহ এবং মোসাদের সতর্ক নজরদারি সব মিলে প্রকল্পটি ব্যর্থ হতে বাধ্য ছিল।
বুলের মৃত্যুর পর ইরাকি কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন যে প্রকল্পটি এখন অসম্ভব। এর কয়েক মাস পর, ব্রিটিশ কাস্টমস বিগ ব্যাবিলনের মূল অংশগুলো আটক করে। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর জাতিসংঘের পরিদর্শকরা ইরাকে গিয়ে প্রজেক্ট ব্যাবিলনের সব অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করে দেন। সাদ্দামের স্বপ্নের সুপারগান কখনোই গুলি করেনি, কিন্তু এর জন্য যে মূল্য চোকাতে হয়েছিল, তা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল থেকে যাবে।
তথ্যসূত্র: Arms and the Man: Dr. Gerald Bull, Iraq, and the Supergun by William Lowther/ Bull's Eye: The Assassination and Life of Supergun Inventor Gerald Bull by James Adams/PBS FRONTLINE: "The Man Who Made the Supergun'' ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



