
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে একটি রক্তক্ষয়ী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংঘাত সংঘটিত হয়েছিল যা ইতিহাসে বেরেলভী জিহাদ বা ওয়াহাবী আন্দোলন নামে পরিচিত। এই সংঘাতে একদিকে ছিল সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর নেতৃত্বাধীন ইসলামিক সংস্কারবাদী আন্দোলন, অন্যদিকে ছিল মহারাজা রণজিৎ সিংহের শক্তিশালী শিখ সাম্রাজ্য। এই যুদ্ধের পিছনে জটিল রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণ ছিল যা আজও ঐতিহাসিক বিতর্কের বিষয়।
এই যুদ্ধের মূল যুদ্ধক্ষেত্র ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ যা বর্তমানে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া নামে পরিচিত; বেরেলভীর সময়ে এই অঞ্চলটি ছিল শিখ সাম্রাজ্যের অংশ। পেশোয়ার উপত্যকা ছিল এই অঞ্চলের প্রধান শহর এবং কৌশলগত কেন্দ্র, যেখানে বেরেলভী তার ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ খাইবার গিরিপথের কারণে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, কারণ এটি আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে প্রধান যোগাযোগ পথ হিসেবে কাজ করত। সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে একটি শক্তিশালী ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যা ভবিষ্যতে সমগ্র ভারত বিজয়ের কৌশলগত ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে। তিনি পেশোয়ার উপত্যকায় একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে খাঁটি ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং 'দার উল-হারব' ও 'দার উল-ইসলামের' তত্ত্ব প্রচার করেন, যার মতে অমুসলিম শাসনাধীন যে কোনো এলাকায় জিহাদ ফরজ। যদিও বাহ্যিকভাবে এটি ইসলামিক সংস্কার আন্দোলন হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
বেরেলভী ও তার অনুসারীরা প্রচার করেছিলেন যে শিখ শাসনে মুসলিমরা চরম অত্যাচারের শিকার, যেমন শিখ আইনে একজন হিন্দুর প্রাণের মূল্য ছিল একজন মুসলিমের দ্বিগুণ এবং পাঞ্জাবি মুসলিমরা তাদের আয়ের নব্বই শতাংশ কর দিতে বাধ্য ছিল। কাশ্মীরে মুসলিম-বিরোধী আইন, যেমন গরু জবাইয়ের জন্য মৃত্যুদণ্ড ও আজানের উপর নিষেধাজ্ঞার অভিযোগ করা হতো। তবে অনেক নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক গবেষণায় ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়; মহারাজা রণজিৎ সিংহের দরবারে উচ্চপদে অনেক মুসলিম কর্মকর্তা ছিলেন এবং শিখ সাম্রাজ্যে ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করা হতো। পাঞ্জাবের মুসলিমরা প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর তুলনামূলক শান্তিতেই ছিল। সম্ভবত কিছু স্থানীয় অসন্তোষ ছিল, কিন্তু বেরেলভী ও তার অনুসারীরা এগুলোকে অতিরঞ্জিত করে তাদের জিহাদি আন্দোলনের বৈধতা তৈরি করেছিলেন।
১৮২৬ সালে সৈয়দ আহমদ বেরেলভী তার প্রায় দেড় হাজার অনুসারীদের নিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যান এবং শিখবিরোধী অভিযান শুরু করেন। ১৮২৭ সালের ১১ জানুয়ারি তাকে খলিফা ও ইমাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা অটোমান সাম্রাজ্যের বাইরে খিলাফত দাবির কারণে বিতর্ক সৃষ্টি করে। তিনি স্থানীয় পাঠান উপজাতিদের সাথে জোট গঠন করলেও সকল উপজাতির পূর্ণ সমর্থন পাননি। এই সংঘাতের প্রথম বড় রূপ নেয় আকোড়া খট্টকের যুদ্ধে (১৮২৬), যেখানে বেরেলভীর অনুসারীরা চার হাজার শিখ সৈন্যের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করে। তবে ১৮৩০ সালে পিরসাবাকের যুদ্ধে জেনারেল হরি সিংহ নালওয়ার নেতৃত্বে শিখ সেনাবাহিনীর কাছে ওয়াহাবী বাহিনী মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়, যার ফলে বেরেলভীর শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
চূড়ান্ত পরিণতি আসে ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের যুদ্ধে। এই যুদ্ধের আগে স্থানীয় কিছু নেতার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বেরেলভী ও তার অনুসারীরা বিপাকে পড়েন। রাজকুমার শের সিংহের নেতৃত্বে শিখ বাহিনী আকস্মিক ও সুপরিকল্পিত আক্রমণ চালায় এবং এই যুদ্ধে সৈয়দ আহমদ বেরেলভী, তার প্রধান সহযোগী শাহ ইসমাইল দেহলভী এবং প্রায় ছয়শো মুসলিম যোদ্ধা নিহত হন। এই পরাজয়ের মূল কারণ ছিল রণজিৎ সিংহের খালসা বাহিনীর সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব; এই বাহিনীতে প্রায় আশি হাজার নিয়মিত সৈন্য ছিল, যারা ফরাসি জেনারেল ক্লদ অগাস্তে কোর, ভেনতুরা এবং ইতালীয় জেনারেল পাওলো ডি অ্যাভিতাবাইলের মতো ইউরোপীয় প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে আধুনিক যুদ্ধ কৌশল ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করত। অন্যদিকে ওয়াহাবী বাহিনী ছিল তলোয়ার ও পুরাতন বন্দুকের উপর নির্ভরশীল একটি অসংগঠিত গেরিলা দল, যারা স্থানীয় সব উপজাতির সমর্থন লাভেও ব্যর্থ হয়েছিল।
এই সংঘাতের ফলে যুদ্ধকালে উভয় পক্ষের নারীরা অত্যাচার, অপহরণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হন, বিশেষ করে শিখ ও হিন্দু নারীদের অবস্থা ছিল করুণ; উভয় পক্ষই অল্পবয়স্ক ছেলেদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল এবং কিছু এলাকায় ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। যুদ্ধের ফলে শিখরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে তাদের কর্তৃত্ব আরও শক্তিশালী করে এবং এই বিজয় শিখ সেনাবাহিনীর দক্ষতা ও সংগঠনের প্রমাণ দেয়। অন্যদিকে প্রধান নেতাদের মৃত্যুতে ওয়াহাবী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এই অঞ্চলে ওয়াহাবী প্রভাব প্রায় বিলুপ্ত হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধ ব্রিটিশদের পাঞ্জাব দখলের পথ সুগম করে। এই ইতিহাসের অধ্যায় শিক্ষা দেয় যে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর সামনে শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্দীপনা দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়, এবং জনগণের সমর্থন ছাড়া কোনো আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
তথ্যসূত্র: Hunter, William Wilson এর The Indian Musalmans যা ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয় এবং ওয়াহাবী আন্দোলনের সবচেয়ে বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য ইংরেজি বিবরণ হিসেবে বিবেচিত । Ahmad, Qeyamuddin এর The Wahabi Movement in India যা ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত এবং ওয়াহাবী আন্দোলনের বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রদান করে। Chopra, B.R. এর Kingdom of the Punjab যা ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এবং পাঞ্জাব রাজ্যের ইতিহাস ও শিখ সাম্রাজ্যের বিবরণ উপস্থাপন করে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


