
ফেনী শহরের মাস্টারপাড়ার লমি হাজারী বাড়ির সামনে যে শান্ত পুকুরঘাট আজ শানবাঁধানো, যেখানে ছাউনির নিচে বসে মানুষজন গোসল করে, ঝালমুড়ি আর পেয়ারা-জাম্বুরামাখা খায়, এই দৃশ্য একসময় ছিল কেবলই কল্পনা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে এই জায়গাটি ছিল এক আতঙ্কের নাম। এই পুকুরঘাট ছিল ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজামউদ্দিন হাজারীর ‘ঘাটলা’। এখান থেকে চলতো তাঁর সাম্রাজ্যের শাসন। ঠিকাদারি বণ্টন, চাঁদাবাজির হিসাব, এমনকি স্থানীয় বিবাদ মীমাংসা সবকিছুর কেন্দ্র ছিল এই ঘাটলা, যা স্থানীয়ভাবে ‘ঘাটলার শাসন’ নামে পরিচিত ছিল। জেলার নানা প্রান্তের মানুষকে এখানে হাজিরা দিতে হতো।
আমারও মনে আছে সেই দিনের কথা। আমার আর আব্বার সেই ঘাটলায় নিজামের মুখোমুখি হওয়া। সেটা ছিল এক চরম দুঃসময়ে। ২০২০ সালের করোনা মহামারির সময়, যখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার দশা আমার বাবা ও মা দুজনেই কোভিড আক্রান্ত। ঠিক সেই মুহূর্তে নিজাম হাজারী আমাদের জমি দখল করে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করেন। অথচ মাত্র ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেও ঢাকার মিরপুরে আমাদের এক টুকরো জমি স্থানীয় এমপি ইলিয়াস মোল্লা দখল করে নিয়েছিলেন। একের পর এক এমন আঘাতে মা ক্ষোভে নিজাম ও আব্বা দুজনকেই অনেক গালমন্দ করেছিলেন।
নিজাম হাজারী যে তার এলাকার জমি দখল করে নিজের রংমহল ও রিসোর্ট বানাচ্ছিলেন, সেটা অনেক পুরোনো খবর। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেই তিনি আমাদের জমির সামনের প্রায় সবকিছুই জোর-জুলুম আর কৌশলে দখল করে নেন। তিনি মানুষ বুঝে টাকা দিয়েছেন : যারা প্রভাবশালী, তারা পেয়েছে বেশি দাম, আর আমাদের মতো নিরীহ মানুষদের দেওয়া হয়েছে জমির চার ভাগের এক ভাগ দাম। কিন্তু অন্যের জমি দখল করে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া তো আসলে অপরাধ। যাই হোক, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি দখল করা জমির চারপাশে দেওয়াল তুলে আমাদের জানিয়ে দেন: ‘আপনাদের জমি আর লাগবে না।’ সেদিন আমিও ছিলাম আব্বার সঙ্গে। আব্বা খুব সহজ-সরল আর ভীতু স্বভাবের হওয়ায় মা সব সময় আমাকে তাঁর সঙ্গী করে পাঠাতেন। নিজাম যে একজন অপরাধী, তা আমাদের চেয়ে ভালো আর কারোরই জানার কথা না।
নির্বাচনে জেতার ঠিক দুই বছরের মাথায় তিনি আমাদের জমিও দখল করে ঢাকা থেকে ফোন করে বলেন: ‘এসে জমি রেজিস্ট্রেশন করে দিয়ে যান।’ এই লোকটার এত টাকা, অথচ তাঁর নিজের কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। ভাই জসিম হাজারীর মেয়েকে দত্তক নিয়ে মানুষ করছেন। মাঝে মাঝে ভাবি, এত সম্পদের শেষ গতি কী হবে? নিজাম-বেনজীর-জেনারেল মাসুদ মিলে মালয়েশিয়াতে লোক পাঠানোর নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। ওবায়দুল কাদের ফেনী গেলেই নিজাম হাজারীর বাড়িতে যেতেন। সেখানে রংমহলে রাতভর ফুর্তি চলত।
নিজাম তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের সরকারি চাকরি দিয়েছিলেন, যারা এখন চাকরি হারানো ও মামলার শিকার হয়ে বসে আছেন। কোরবানির ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশীদের তিনি পাঁচ কেজি করে গরুর মাংস দিতেন। যখন ফেনী বা আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যেত, মাস্টারপাড়ায় যেত না, কারণ সেখানে ছিল ‘এমপি সাহেবের বাড়ি’। নিজামের মুরব্বি ছিলেন আরেক গডফাদার আলাউদ্দিন নাসিম। ভাগ্যক্রমে নিজাম হাজারী ফেনী-২ আসনের এমপি মনোনয়ন পেয়ে যান। তিনি চট্টগ্রামে পড়াশোনা করেছেন এবং সেখানকার মেয়েকেই ভাগিয়ে বিয়ে করেছিলেন।
সেই ঘাটলায় আব্বা আর আমি সেদিন বসেছিলাম। আমাদের পূর্বপরিচিত এবং নিজামের একজন দালাল মারফত যোগাযোগ হয়েছিল। নিজাম আমার মায়ের চেয়েও মাত্র দু-বছরের বড়। সেখানে অনেক মানুষ বসে ছিল। আব্বা ঘেমে যাচ্ছিলেন আর আমার মুখ শুকিয়ে কাঠ। দালাল বারবার অভয় দিচ্ছিল, ‘ভয়ের কিছু নেই।’ আমরা দুজনেই ছিলাম চরম উদ্বেগে। মা বারবার ফোন দিচ্ছিলেন। আমরা সব কাগজপত্র আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। আমরা আগে থেকেই খোঁজ নিয়েছিলাম, নিজাম হাজারী কাকে কী পরিমাণ টাকা দিয়েছেন। কিছু খারাপ খবরও আমাদের কানে এসেছিল : শোনা গিয়েছিল যে টাকা দিয়ে ফেনী শহর ছাড়ার সময় নিজাম তাঁর লোক দিয়ে ছিনতাই করিয়ে আবারও টাকা ফিরিয়ে নিতেন। মা এসব শুনে ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন।
যাই হোক, একটা ব্যাগ আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো। আমরা কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ মাস্টারপাড়া থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম। নিজাম হাজারী দালালের মাধ্যমে কত টাকা দেবেন, তা আগেই জানিয়েছিলেন। সেই দালালও কিছু টাকা নিজামের থেকে আগেই চেয়ে সরিয়ে নেওয়ায় এখানেও আমাদের লোকসান হলো। তবে খুশির কথা হলো: সেই দালালের ভাই-বেরাদার এবং তাঁর নিজের এখন আর্থিক অবস্থা খারাপ। নিজাম না থাকায় তাদেরও এখন উপার্জন নেই। আমরা শহর থেকে অটোরিকশায় উঠে দেখি, একই অটোতে তিন-চারজন ছেলে বসা আগে থেকেই । আমরা বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। দ্রুত ব্যাংকে টাকা জমা দিলাম এবং আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে ফেনী বাস কাউন্টারে পৌঁছলাম। তারপর ঢাকা চলে আসি। আমাদের পেছনেও লোক ছিল : আমরা কী করি, কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই, সেসব জানার জন্য।
এখন সেই নিজাম হাজারী দেশে নেই। তাঁর সেই রংমহল আর বাড়ি এখন কোথায়? গত বছর আগস্ট মাসের ৫ তারিখে শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুব্ধ জনতা নিজামের ২০০ কোটি টাকার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। নিজামের সাম্রাজ্য এখন কারা দেখাশোনা করছে? অবশ্যই বিএনপির লোকজন। তারা বালুমহল থেকে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে। চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য যেসব ধান্দা আগে নিজাম করত, এখন তারাই সেগুলো করছে। এটাই আমাদের দেশের রাজনীতি। একটা দেশের এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার থাকলে, তাদের তো এমন ধান্দা-পানি করেই খেতে হবে। কিছু করার নেই।


অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


