
সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকাল সবচেয়ে বেশি শেয়ার হচ্ছে কোন খবরগুলো? গাজায় কতটি ত্রাণবাহী জাহাজ সাহায্য নিয়ে যেতে পারল, গুলতেকিন বেগম তাঁর জবানবন্দিতে কী লিখলেন, আবু তোয়াহা হুজুরের প্রেমলীলার নতুন কোনো তথ্য বেরিয়ে এল কি না। এসব খবর মুহূর্তে লাখ লাখ বার শেয়ার হচ্ছে। পক্ষে-বিপক্ষে কত যুক্তি-তর্ক তুলে ধরছেন একেকজন সোশ্যাল মিডিয়া বুদ্ধিজীবী। কিন্তু দেশের আসল সমস্যা দারিদ্র্য কিংবা গরিব মানুষের হাহাকার ও চোখের পানি কারও মনে প্রভাব ফেলছে না। এগুলো নিয়ে আলোচনা করার দরকার নেই।
রাজশাহীর চৌদ্দপাইয়ে রাত দুইটায় লাঠিতে ভর করে লাইনে দাঁড়ানো সোনাবান বেগমের কথা কি একবারও ট্রেন্ডিং হয়েছে? রোজেনা বেগম রাত তিনটায় এসে সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে পাঁচ কেজি চাল কিনলেন, অথচ তাঁর পরিবারে চার-পাঁচজন মানুষ খায় আর একজনই কামাই করেন। এই বাস্তবতা নিয়ে কোনো ভাইরাল পোস্ট দেখেছেন? চায়না বেগম কান্নাজড়িত গলায় বললেন, "আমরা একা খেতে চাইনি। আমরা কারও হক মারতে চাইনি। বাংলাদেশের সবাই খাব।"- তাঁর এই আকুতি কি সোশ্যাল মিডিয়ার নেটিজেনদের হৃদয় স্পর্শ করল?
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। দেশের অর্থনীতি স্থবির পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) বাদ দিলাম, দেশের ব্যবসায়ীরাই নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছেন না। চারদিকে অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন কমছে। কিন্তু এদিকে গরিব মানুষের হাহাকার নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া নেটিজেনদের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। সারাদিন তাঁরা ব্যস্ত গাজায় কতটি জাহাজ রিলিফ নিয়ে যেতে পারল, গুলতেকিন বেগম কী লিখলেন কিংবা আবু তোয়াহা হুজুরের মোবাইল ফোন কে চুরি করেছে তার খোঁজ নিয়ে।
অথচ বাস্তবতা হলো, সাধারণ মানুষ গত বছর যদি আন্দোলনে যুক্ত হয়ে থাকে, তবে মূল্যবৃদ্ধি সেটার অন্যতম বড় কারণ ছিল। গত বছর শেখ হাসিনার সময়ে মধ্যবিত্ত লোকজন, এমনকি শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়াত, কিন্তু অনেকেই খালি হাতে বাড়ি ফিরত। শেখ হাসিনা জোর করে ক্ষমতায় ছিলেন, তাই মানুষ তাঁর শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল। কিন্তু এখন যে সরকার, সেটা আমাদের সবার সরকার হয়ে ওঠার কথা। জুলাই আন্দোলনের পর যে সরকার এল, তার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া।
যারা নিম্নশ্রেণির মানুষ, তাদের পাশে এই সরকারের দাঁড়ানোর কথা ছিল। তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারত। একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করে যেতে পারত, যাতে আমরা সামনের সরকারকে বলতে পারি, "দেখুন, অন্তর্বর্তী সরকার তো পেরেছিল, আপনারা পারলেন না।" কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সেই দিকে মনোযোগ কম।
ইন্টেরিম সরকার যে সময়টুকু থাকবে, তাতে কষ্টকর ট্রানজিশন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে, এটা নিয়ে তাদের দোষারোপের কিছু নেই। কিন্তু চাইলেই তারা লাইনে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষকে না ফিরিয়ে সবার প্রয়োজন মেটাতে পারত। রাজশাহীতে যেখানে মানুষ রাত দুইটা-তিনটায় এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে বরাদ্দ বাড়ানো কি খুব কঠিন কাজ? প্রতিটি ওয়ার্ডে এক টন করে চাল-আটা দিয়ে মাত্র দুশো জনকে সেবা দেওয়া যাচ্ছে, অথচ লাইনে দাঁড়ায় পাঁচশো-ছয়শো মানুষ। এই সমস্যার সমাধান কি অসম্ভব?
টিসিবি কার্ড আগে আওয়ামী লীগ তাদের পছন্দের লোকজনকে দিত, এখন বিএনপি-জামাত-এনসিপি একই কাজ করছে। অথচ এরা আবার একে অপরকে বলবে, "তোমরা জুলাই চেতনার বিরোধী।" খেতে গেলে সবাই মিলেমিশে খায়। সেদিন দেখলাম নিউমার্কেটে টিসিবির আটা কালোবাজারি হচ্ছে, দোকানদাররা ভর্তুকিযুক্ত পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে, সচ্ছল মানুষ গরিব সেজে কার্ড দেখিয়ে পণ্য কিনে দোকানে বিক্রি করছে: এসব বন্ধ করতে কি গোপন অভিযানের দরকার নেই? প্রকৃত দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে, আর একটি চক্র সরকারি ভর্তুকি লুটপাট করে যাচ্ছে। এ যেন নতুন বোতলে পুরনো মদ।
রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত কে ক্ষমতায় যাবে, তার হিসাব-নিকাশে। জনগণের কেবল ভোট তাদের দরকার, আর কিছু দরকার নেই। তাদের অভাব-অভিযোগ শোনার সময় তাদের নেই। প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সফরে বিএনপি চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তারেক যেতে না পারায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি তখন বিদেশে থাকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবিরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই কথা শুনে জামাত আর এনসিপি নেতারা গোস্বা করায়, ড. ইউনূস সাহেব সবাইকে খুশি রাখার জন্য একশত চার জনের বিশাল বাহিনী নিয়ে আমেরিকা গেলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাজকর্ম পুরোটাই মাথা নষ্ট। একদিকে ওএমএসের লাইনে মানুষ দাঁড়াচ্ছে, আর তারা চিফ অ্যাডভাইজারের সাথে কে যাবে, তার হিসাব-কিতাব নিয়ে ব্যস্ত। কীভাবে রাষ্ট্রীয় টাকার শ্রাদ্ধ করা যায় এরাই কেবল সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল। তারা ওএমএসের বরাদ্দ বাড়িয়ে, কালোবাজারির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালিয়ে এবং ডিজিটাল মনিটরিং চালু করে প্রমাণ করতে পারত যে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠেও জনগণের শাসন সম্ভব। কিন্তু সেই বেঞ্চমার্ক তৈরি হচ্ছে না। আমরা ভুলছি যে জুলাই আন্দোলনের বড় কারণ ছিল মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, সুশাসনের দাবি ও জবাবদিহিতার প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলে এই সময়ের অর্থ হারিয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার হিসাব কষলেও, মনে রাখা দরকার - ক্ষমতার উৎস শেষ পর্যন্ত সেই জনগণই, যারা আজ ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।
অর্ধেক দামে চাল–আটা কিনতে মধ্যরাতে লাইন, কাঁদলেন নারী - prothomalo
প্রফেসর ইউনূস নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙলেন- মানবজমিন ।
রাজশাহীতে ওএমএসের চাল-আটা কিনতে কেউ রাত ১২টা, কেউ ভোররাত থেকে লাইনে- prothomalo

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


