
সোমবার সকাল। দিল্লির সাউথ ব্লকে বসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি যখন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সামনে বললেন, "শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধটি একটি আইনগত বিষয়, আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিবেচনা করব" – তখন অনেকেই ভাবলেন, বুঝি ভারত নরম হচ্ছে। কিন্তু আসল সত্যিটা একেবারেই আলাদা। দিল্লির করিডোরে কথা হলো একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা, সাবেক কূটনীতিবিদ আর পলিসি এক্সপার্টদের সাথে। তাদের মোটামুটি সবার কথার সারমর্ম এক : শেখ হাসিনা ভারতকে ফেলেছেন এক বিশাল 'ক্যাচ টোয়েন্টি টু' সিচুয়েশনে। না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে। কিন্তু ফেলে দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না !
সাউথ ব্লকের একজন কর্মকর্তা গোপনে বললেন, "খেয়াল করুন, বিক্রম মিশ্রি কথাটা কোথায় বলেছেন। বাংলাদেশের অতিথি সাংবাদিকদের সামনে, সরকারি অনুষ্ঠানে। ওখানে তো সরাসরি বলা যায় না – 'না, আমরা ওনাকে কিছুতেই ফেরত দেব না!' ডিপ্লোম্যাটিক্যালি কারেক্ট ভাষায় যেটুকু বলা যায়, সেটাই বলেছেন।"আসলে কূটনীতির জগতে যা বলা হয় না, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানে যা বলা হয়নি তা হলো : শেখ হাসিনাকে ভারত কখনোই ফিরিয়ে দেবে না।
ভারতের সাবেক শীর্ষ কূটনীতিবিদ টিসিএ রাঘবন একটা অসাধারণ পয়েন্ট তুললেন। তিনি বললেন, "আজ যদি ভারত তাদের এত বছরের পরীক্ষিত বন্ধু শেখ হাসিনার পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নেতাই ভারতের বন্ধুত্বে আস্থা রাখবে না।" দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব কতটা কমে যাবে যদি এই বার্তা যায় যে : সংকটে ভারত বন্ধুদের ফেলে দেয় ।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী বিক্রমজিত ব্যানার্জি একটা শক্ত আইনি যুক্তি দিলেন। "বাংলাদেশে গত আগস্টের পর যেভাবে ঢালাও মিথ্যা মামলা হচ্ছে, আদালত প্রাঙ্গণেও সাবেক নেতাদের হেনস্তা হচ্ছে – তাতে শেখ হাসিনা সুষ্ঠু বিচার পাবেন, এমন বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। শুধু এই যুক্তিতেই প্রত্যর্পণ খারিজ করা যায়।" বাংলাদেশে এমনিতেই ভারত-বিরোধী মনোভাব যথেষ্ট প্রবল। আর এখন শেখ হাসিনাকে জোর করে ঢুকিয়ে দিলে সেটা আরও বাড়বে। ভারত সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝছে। নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো বোকামি দিল্লি করবে না।
বিজেপির ঘনিষ্ঠ পলিসি এক্সপার্ট শুভ্রকমল দত্ত পরিষ্কার করে বললেন, "ভারত শেখ হাসিনার আতিথেয়তা, নিরাপত্তা ও মর্যাদার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কোনো দায়িত্ব নেয়নি। তিনি যদি নিজে থেকে ফিরতে চান আর পরিস্থিতি অনুকূল হয়, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু ভারত তাকে 'প্যারাড্রপ' করে বাংলাদেশে বসিয়ে দেবে : এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।" পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তাও জানালেন, "ভারত তাকে নিজে থেকে আশ্রয় দেয়নি, পরিস্থিতির চাপে একরকম বাধ্য হয়েছিল। আসার পর বেশ চেষ্টা হয়েছে তাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর, কিন্তু সব শর্ত না মিলায় সে চেষ্টাও আপাতত থেমে গেছে।"
নিউ ইয়র্কে সাংবাদিক মেহদি হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছিলেন, "ভারত এখনও আশা করছে শেখ হাসিনা বিজয়ীর বেশে ফিরবেন।" কিন্তু দিল্লির পর্যবেক্ষকরা এই মন্তব্যকে "নিছকই রাজনৈতিক" বলছেন। বাস্তবতা হলো : ভারতের কোনো এমন পরিকল্পনা নেই। ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিলেন, "বিদেশি নেতাদের আশ্রয় দেওয়ার ঐতিহ্য আছে ভারতের। দালাই লামা ৬৬ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে আছেন। আফগান প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহর পরিবার ৩০ বছরের বেশি। শেখ হাসিনাকেও ভারত যতদিন দরকার, সম্মানের সাথে রাখবে।"
শেখ হাসিনাকে ঘিরে ভারতের অবস্থান এক জটিল ধাঁধা। একদিকে তাকে ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না – কারণ সেটা ভারতের কূটনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করবে। অন্যদিকে, তাকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করবে না : কারণ সেটা বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব আরও তীব্র করবে। তাই দিল্লি বেছে নিয়েছে এক মধ্যপন্থা – শেখ হাসিনা থাকবেন ভারতে, সম্মানের সাথে, দীর্ঘদিন। না ফেরত যাবেন বিচারের মুখোমুখি হতে, না ফিরবেন বীরের বেশে ক্ষমতায়।
যতদিন দরকার শেখ হাসিনাকে রাখবে ভারত- বাংলা ট্রিবিউন


অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


