somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাকিস্তান কি ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার 'নতুন কার্ড' ?

০৮ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে এক অদ্ভুত দৃশ্যের জন্ম হলো। চারপাশে ফ্ল্যাশের ঝলকানি, ট্রাম্পের চিরচেনা আত্মতুষ্টি ভরা হাসি, আর সেই হাসির ছায়ায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির। ট্রাম্প তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন “একজন অত্যন্ত মহান মানুষ” হিসেবে। কয়েক বছর আগেও পাকিস্তান ছিল ট্রাম্পের চোখে “মিথ্যা আর প্রতারণার দেশ”, আর আজ সেই দেশই তাঁর “বিশ্বাসযোগ্য মিত্র”। এই পরিবর্তন কোনো হঠাৎ ভালোবাসার ফল নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত কৌশলগত পুনর্গণনা, যেখানে মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তেল, লেনদেন আর ব্যক্তিগত স্বার্থের রাজনীতি।

এই ঘনিষ্ঠতার বীজ বোনা হয়েছিল তিনটি নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে। প্রথম ঘটনাটি আফগানিস্তানের অ্যাবি গেট হামলার অভিযুক্ত মোহাম্মদ শরিফুল্লাহকে পাকিস্তানের হাতে গ্রেপ্তার। ট্রাম্পের জন্য এটি ছিল পুরনো এক দুঃস্বপ্নের প্রতিশোধ, যা তিনি টেলিভিশনের পর্দায় “আমেরিকার বিজয়” বলে ঘোষণা করলেন। দ্বিতীয়টি, ভারত-পাকিস্তানের মে মাসের সংঘাত। ইসলামাবাদ প্রচার করল যে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপেই যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে, এমনকি তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন পর্যন্ত দেওয়া হলো। আর তৃতীয়টি, অর্থনীতি। পাকিস্তান খুলে দিয়েছে তার তেল ও খনিজ সম্পদের দরজা, ঠিক সেই জায়গায় যেখানে ট্রাম্প পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক স্বার্থ ঘুরপাক খায়। এটি কূটনীতি নয়, বরং ব্যবসায়িক দর-কষাকষির এক নতুন রূপ।

ট্রাম্প যখন বললেন “পাকিস্তানে বিশাল তেলসম্পদ আছে”, তখন বিশ্বের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ভূতাত্ত্বিক রিপোর্টে তেমন কোনো ইঙ্গিত নেই, তবু উত্তেজনা আকাশচুম্বী। আসল গল্প তেলে নয়, ব্যবসায়। এই চুক্তিগুলোর পেছনে শোনা যাচ্ছে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বিনিয়োগের গন্ধ। বিনিময়ে পাকিস্তান পেয়েছে শুল্কে সুবিধা, ভারতের ৫০ শতাংশের পরিবর্তে মাত্র ১৯ শতাংশ। এই ছোট্ট সংখ্যাটাই বলে দেয় বড় গল্পটা। ট্রাম্পের দুনিয়ায় বন্ধুত্ব মানে লেনদেন, যেখানে প্রতিটি হাসির দাম হিসাব করা যায় ডলারে।

ওয়াশিংটনের ভেতরকার আরেকটি নীরব রদবদল ঘটেছে। পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এখন নতুন বাস্তবতা। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ঘনঘন ওয়াশিংটন সফর আর “অফিসিয়াল কর্টেসি” নয়, বরং মার্কিন বাস্তববাদের প্রকাশ। আমেরিকা জানে ,পাকিস্তানে ক্ষমতার আসল কেন্দ্র ইসলামাবাদের সংসদ ভবনে নয়, বরং রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে। তাই ট্রাম্প প্রশাসন গণতন্ত্রের মুখোশ সরিয়ে দিয়ে কথা বলছে সেই শক্তির সঙ্গে, যাদের হাতে বন্দুক আছে। গণতন্ত্রপন্থীরা হয়তো হতাশ, কিন্তু ট্রাম্পের চোখে এটি দক্ষতা, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন নির্বাচনের চেয়ে চুক্তি অনেক বেশি স্থায়ী।

তবে এই নতুন সম্পর্কের সবচেয়ে নাটকীয় প্রভাব পড়েছে ভারতের ওপর। দুই দশক ধরে ওয়াশিংটন চেষ্টা করছিল দিল্লিকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গড়ে তুলতে। হঠাৎ সেই বন্ধনেই দেখা দিল ফাটল। ট্রাম্পের প্রশাসন যখন পাকিস্তানকে শুল্কে ছাড় দিচ্ছে, তখন ভারতের ওপর আরোপ করছে রাশিয়ান তেল আমদানির জন্য কঠোর শাস্তিমূলক শুল্ক। মে মাসের সংঘাতে ট্রাম্পের নীরব পক্ষপাতিত্ব নয়াদিল্লির কাছে ছিল অপমানজনক। এরই প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাত বছরের বিরতির পর পা রাখলেন বেইজিংয়ে। এটি নীরব অথচ প্রচণ্ড প্রতীকী বার্তা দিল আমেরিকার উদ্দেশে—“তুমি যদি ইসলামাবাদকে আলিঙ্গন করো, আমরা বিকল্প রাস্তা খুঁজে নেব।”

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্ক সবসময়ই ছিল সুবিধাভিত্তিক, যেন এক অস্থির প্রেমের গল্প। একবার কাছে টানা, আবার দূরে ঠেলা। বর্তমান উষ্ণতারও ভিত দুর্বল। পাকিস্তান এখনো চীনের গভীর ছায়ায় আবদ্ধ। ইমরান খানের বন্দিত্ব, অর্থনৈতিক সংকট এবং সামরিক জেনারেলদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেশটিকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর ট্রাম্প নিজেও কোনো স্থায়ী নীতির মানুষ নন; তাঁর পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে মেজাজ, ব্যক্তিগত স্বার্থ আর ব্যবসায়িক হিসাবের ওপর। আজ যে বন্ধু, কালই সে শত্রু হতে পারে।

ভবিষ্যৎ তাই ঝুলে আছে তিনটি সূক্ষ্ম সুতোর ওপর। প্রথমত, পাকিস্তান নিজেকে কতটা স্থায়ী ও বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার প্রমাণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, চীন-আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোন দিকে গড়ায়—যদি উত্তেজনা বাড়ে, পাকিস্তানকে একদিকে দাঁড়াতেই হবে। আর তৃতীয়ত, ট্রাম্প-পরবর্তী আমেরিকা কোন পথে হাঁটে—আবার কি নীতিনিষ্ঠ, আদর্শভিত্তিক কূটনীতিতে ফিরে যাবে, নাকি এই লেনদেনের রাজনীতিই হবে নতুন নিয়ম।

একটি বিষয় নিশ্চিত, দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে আর আগের সেই স্থিরতা নেই। ওভাল অফিসের সেপ্টেম্বরের সেই দৃশ্য হয়তো এক নতুন যুগের সূচনা, আবার হয়তো এক পুরনো নাটকের পুনরাবৃত্তি, যেখানে অভিনেতারা বদলায় কিন্তু চিত্রনাট্য একই থাকে। আজকের এই উষ্ণ আলিঙ্গন ভবিষ্যতের হিসাবের খাতায় কী মানে বহন করবে, তা এখনও অজানা। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওয়াশিংটনের এই রোলার কোস্টার এখনো চলমান, আর এর পরের মোড়টি হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে আবারও নতুন এক যুগে নিয়ে যাবে।

Source: From pariah to partner: Trump’s puzzling Pakistan pivot- by Elfadil Ibrahim/Asia Times
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:৩১
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×