
২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। ছাত্ররা দাবি করেছিল সরকারি চাকরিতে কোটা কমিয়ে আনার। কিন্তু সেই আন্দোলন শেষ হয়েছিল আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ এখনো ঝুলে আছে অনিশ্চয়তার মেঘে। শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনে 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হলো ঠিকই, কিন্তু সেই অনুষ্ঠান পরিণত হলো বিতর্ক, বিভাজন এবং লাঠিচার্জের এক প্রহসনে। আর এই প্রহসনের মধ্যেই একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠলো: জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া শুধু প্রফেসর ইউনূসই নয়, কেউই 'নিরাপদ প্রস্থান' পাবেন না। না এনসিপি, না জুলাই যোদ্ধারা, এমনকি উপদেষ্টা পরিষদও না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বয়কট করে বসলো। কারণ? আইনি ভিত্তির অভাব। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, "আইনি ভিত্তি ছাড়া এবং আদেশের ব্যাপারে নিশ্চয়তা ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলে সেটা মূল্যহীন হবে।" নাহিদ ইসলামের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে জুলাই সনদের মূল সমস্যা হলো এর আইনি বৈধতার অভাব। তিনি বলেন, "সব রাজনৈতিক দল একটা জায়গায় বসে একটা দীর্ঘ আলোচনায় কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোই যথেষ্ট নয়।"
এনসিপির তিনটি সুনির্দিষ্ট দাবি রয়েছে, যা পূরণ না হলে তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না। প্রথম শর্ত: সাংবিধানিক আদেশ রাষ্ট্রপতি নয়, প্রধান উপদেষ্টা জারি করবেন। সংবিধান অনুযায়ী সাংবিধানিক আদেশ জারি করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। কিন্তু এনসিপি চায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই আদেশ জারি করুন। কেন? কারণ তারা মনে করে জুলাই সনদের বৈধতার উৎস হতে হবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান, রাষ্ট্রপতি নয়। প্রশ্ন হলো: সংবিধান লঙ্ঘন করে যদি সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হয়, তাহলে সেই আদেশের আইনি বৈধতা কোথায়? আগের সংবিধান মতোই দেশ চলছে। উপদেষ্টা পরিষদ শপথ নিয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে। কেবল শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পেয়েছেন বলে উহার সাংবিধানিক আদেশ জারি করার ক্ষমতা কেড়ে নিতে কেউ পারবে না।
দ্বিতীয় শর্ত: 'নোট অব ডিসেন্ট' থাকবে না, সবকিছু একসাথে গণভোটে যাবে। জুলাই সনদে ৮৪টি বিষয় রয়েছে। এনসিপি চায় এই ৮৪টি বিষয় একত্রে গণভোটে যাবে এবং গণভোটে হা জিতলে 'নোট অব ডিসেন্ট'-এর আলাদা কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। মানে, হয় সব মানো, নয়তো কিছুই না। বিএনপিসহ অনেক দল কিছু বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে 'নোট অব ডিসেন্ট' দিয়েছে। বিশেষত উচ্চ কক্ষ গঠন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে বিএনপির আপত্তি আছে। এনসিপির নেতারা চান, ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন করাটা কঠিন করতে হবে। কিন্তু বিএনপি যেভাবে উচ্চ কক্ষ গঠন চায়, সেভাবে হলে সংবিধান সংশোধন কঠিন হবে না।
তৃতীয় শর্ত: গণভোট পাস হলে পরবর্তী সংসদ সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবে। জনগণ সনদ অনুমোদন করলে পরবর্তী সংসদ বাধ্য থাকবে সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করতে। এনসিপি চায় নির্বাচনের আগেই সবকিছু ঠিক করে ফেলতে, যাতে পরে নির্বাচিত সরকার কোনো সংশোধনী বাদ দিতে না পারে। শুক্রবার জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় 'জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা' ব্যানারে কয়েকশ ব্যক্তি অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদেরও দাবি ছিল তিনটি: জুলাই সনদ সংশোধন, সনদকে স্থায়ীভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত এবং 'জুলাই যোদ্ধা'দের স্বীকৃতি।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ দৌড়ে এসে পঞ্চম দফা সংশোধন করে পড়ে শোনালেন। বললেন, "আপনাদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আজকে এটার স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমাদের সহযোগিতা করুন। এটা আপনাদের জন্যই অনুষ্ঠান।" কিন্তু দাবি মেনে নেওয়ার পরও জুলাই যোদ্ধারা বের হতে চাইলেন না। কেন? ঠাকুরগাঁও থেকে আসা এক জুলাই যোদ্ধা দুলাল ইসলাম বলেন, "আমাদের দাবি যা যা ছিল তা মানা হয়নি।" কোন দাবিটি মানা হয়নি এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারলেন না। এরপর শুরু হলো পুলিশের সাথে সংঘর্ষ। লাঠিপেটা, ইটপাটকেল নিক্ষেপ। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে 'ঐতিহাসিক' সনদ স্বাক্ষরের দিনে এমন দৃশ্য দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন উপস্থিত সাধারণ মানুষেরা।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে শুক্রবার রাতেই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, যার শিরোনাম ছিল 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা এর দফা (৫) এর সংশোধনী'। সংশোধিত দফায় বলা হয়েছে: "শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।" বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন এই বিষয়ে একটি চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেছেন । তিনি বলেন, জুলাই যোদ্ধাদের একটি সংগঠন শুক্রবার সকালে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে, অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী ফ্যাসিস্ট বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য গণহত্যা চালালেও, সেই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে ফ্যাসিস্ট শক্তি বা তাদের দোসরদের কয়েকজন জনগণের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। তারা মনে করেছেন, সেইখানে তাদের অভিযুক্ত করা হবে কি না।
সালাহউদ্দিন বলেন, "আমি বলেছি, যারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, যারা গণ-অভ্যুত্থানের নিরস্ত্র ছাত্রজনতাকে হানাদার বাহিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের গণহত্যা করেছে, গণ-অভ্যুত্থানের যুদ্ধের ময়দানে তাদের বিচার জনগণ করেছে। সুতরাং তাদের আর বিচার হবে না। তাদের আশ্বস্ত করেছি এবং সেই দফাটা যাতে সংশোধন করে যে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে, সেটা বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, "তাদের যাতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, চিকিৎসা, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিধান করা হয় এবং মাসিক ভাতাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা হয়, সেই বিধান লেখার জন্য আমি নিজে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রফেসর আলী রীয়াজ সাহেবের সাথে কথা বলার পর সংশোধন করা হয় । এখানে তাদের সন্তুষ্টি হওয়ার কথা। সন্তুষ্ট হয়ে তারা বিদায় নিয়েছেন।"
এই পুরো পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কঠিন অবস্থানে আছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি চাইছেন জুলাই সনদ সফল হোক, যাতে তিনি একটি সম্মানজনক 'নিরাপদ প্রস্থান' নিতে পারেন। কিন্তু এনসিপি, জুলাই যোদ্ধা এবং বিএনপি সবাই তাদের নিজস্ব স্বার্থে সনদকে ব্যবহার করতে চাইছে। এনসিপি চাইছে আইনি ভিত্তি, যাতে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার সনদ বদলাতে না পারে। জুলাই যোদ্ধারা চাইছে 'দায়মুক্তি', যাতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না হয়। বিএনপি চাইছে দ্রুত নির্বাচন, কিন্তু জুলাই যোদ্ধাদের সমর্থনও চাইছে।
এই তিন পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বে আটকে গেছেন প্রফেসর ইউনূস। তিনি যদি এনসিপির দাবি মেনে সাংবিধানিক আদেশ জারি করেন, তাহলে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আসবে। আর যদি না করেন, তাহলে এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করবে না, সনদ ব্যর্থ হবে। তিনি যদি জুলাই যোদ্ধাদের 'দায়মুক্তি' না দেন, তাহলে জুলাই যোদ্ধারা রাস্তায় নামবে, সরকারের জন্য নতুন সংকট তৈরি হবে। তিনি যদি দ্রুত নির্বাচন দেন, তাহলে বিএনপি খুশি হবে, কিন্তু এনসিপি ও অন্যান্য ছোট দল অসন্তুষ্ট হবে। আর যদি নির্বাচন বিলম্বিত করেন, তাহলে বিএনপি ক্ষুব্ধ হবে, আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে।


অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


