
(এই লেখাটি বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন “একই দিনে হাসিনার তিন-তিনটি সাক্ষাৎকার: কীভাবে আর কেন?” থেকে অনুপ্রাণিত)
ভারতের অভ্যন্তরে আশ্রিত এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ তিনটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একযোগে হাজির হলেন, তাও আবার ই-মেইলে। পৃথিবী ঘুরে গেছে, কিন্তু ইন্টারভিউ এখনো ‘ইন্টারনেট কানেকশন’ নির্ভর। মুখ নেই, মাইক্রোফোন নেই, শুধু প্রশ্নমালা আর ই-মেইল। যেন রাজনীতি নয়, একটা পরীক্ষার খাতা—যেখানে শেখ হাসিনা লিখছেন, আর বিশ্বজগত দেখছে, তিনি এখনো লিখতে পারেন কিনা।
এই ই-মেইল সাক্ষাৎকারের আয়োজন যেন ভারতীয় গণতন্ত্রের এক নতুন শিল্পরীতি। দিল্লি থেকে অনুমোদন, নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স, তারপর ব্রিটেন, আমেরিকা আর ফ্রান্সের সাংবাদিকরা সবাই মিলে একটা অনলাইন প্রশ্নোত্তর উৎসব পালন করলেন। শেখ হাসিনা মুখ খুললেন না, কিন্তু তাঁর ই-মেইল খুলে গেল। এমন সাক্ষাৎকার পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল—যেখানে ইন্টারভিউয়ার জানেন, প্রতি প্রশ্ন করা যাবে না, আর ইন্টারভিউই জানেন, উত্তর পাঠালেই হবে, মুখোমুখি হতে হবে না।
কেন এই সময়, কেন এই তাড়াহুড়ো? উত্তরটা রাজনীতির চেয়ে নাটকীয়। নভেম্বরেই রায় ঘোষণার সম্ভাবনা, আর তাই রায়ের আগেই একধরনের আবেগীয় আত্মপক্ষ সমর্থন দরকার ছিল। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি, তাই মাতৃহৃদয়ের বার্তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পাঠানোই হয়তো নিরাপদ মনে হলো। ভারতেরও এ নিয়ে আপত্তি ছিল না, কারণ দিল্লি এখন জানে" বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যাখ্যা করতে শেখ হাসিনার লেখা চিঠি যতটা কার্যকর, তাঁর উপস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
যেভাবে এই সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ পেল, তা অনেকটা গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশনের মতো। তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শর্ত ছিল, সবাইকে একসঙ্গে প্রকাশ করতে হবে, না হলে ইমপ্যাক্ট কমে যাবে। রাজনীতি এখন মিডিয়া ম্যানেজমেন্টের শিল্প, আর শেখ হাসিনা সেই শিল্পের পুরনো কারিগর। শুধু পার্থক্য এই যে এবার তাঁকে ফ্রেমে পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে শুধু ইনবক্সে।
দিল্লির এক সাংবাদিক যখন বললেন, এসব কিছুই অমিত শাহের মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়া সম্ভব নয়, তখন বোঝা গেল: ভারত সরকার এখন কূটনীতির পাশাপাশি স্ক্রিপ্ট এডিটিংও করছে। শেখ হাসিনা ভারতেই থাকবেন, এ কথাটিও সম্ভবত দিল্লির অনুমতিপত্রেই লেখা হয়েছিল। মোদি সরকার হয়তো এখন বুঝেছে, প্রতিবেশীর রাজনীতি সামলাতে সীমানা নয়, সার্ভারও লাগাম দিতে পারে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বারবার বলেছে, শেখ হাসিনাকে এমন কিছু বলার সুযোগ না দিতে, যাতে দেশ অস্থিতিশীল হয়। কিন্তু মোদি বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কারও মুখে লাগাম টানা সম্ভব নয়। কী চমৎকার ব্যঙ্গ : যে প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশে বাকস্বাধীনতা সীমিত করেছিলেন, তিনি এখন ভারতের অতিথি হয়ে বাকস্বাধীনতার প্রতীক!
তবু সবচেয়ে কৌতূহলজনক অংশ ছিল ভোট বয়কটের ডাক। শেখ হাসিনা হঠাৎ ঘোষণা দিলেন, আওয়ামী লীগ যেন ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে না যায়। মনে হলো, নিজের রাজনৈতিক জীবনের প্রতিধ্বনি শুনছেন তিনি: যেমন একসময় অন্যদের বয়কটকে ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ বলেছিলেন, আজ সেই শব্দটাই নিজের পক্ষ থেকে পাঠাচ্ছেন। এটি রাজনীতি নয়, আত্মসমর্পণের এক শৈল্পিক ঘোষণা।
ভারত যদিও এখনো বলে যাচ্ছে : নির্বাচন হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। কিন্তু শেখ হাসিনা বুঝে গেছেন, যে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে তাঁর দল অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই বয়কট এখন তাঁর শেষ কূটনৈতিক অস্ত্র। যেন হারার আগেই হেরে যাওয়ার এক সাহসী ঘোষণা।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়, এতে কাজ হবে? বয়কটের ডাক কি আন্তর্জাতিক সহানুভূতি পাবে, নাকি এটাও ইতিহাসের পাতায় আরেকটি “লিখিত সাক্ষাৎকার” হয়ে হারিয়ে যাবে? রাজনীতিতে সময়ের চেয়ে শক্তিশালী কিছু নেই, আর সময় এখন শেখ হাসিনার বিপক্ষে। ভারত তাঁকে রেখেছে, কিন্তু তাঁকে চালাচ্ছে না; আর বাংলাদেশ তাঁকে বিচার করছে, কিন্তু ভুলছে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




