
বেগম খালেদা জিয়া মারা গেছেন। এই খবরে জাতি শোকাহত। কিন্তু একদল মানুষ আছে যারা উনার মৃত্যুর পরেও নিজেদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে তার মৃত্যু নিয়ে ঘৃণ্য মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। বদনা মুফাসসিল ইসলাম, নবনীতা চৌধুরী, ফ্রান্সের বহি পীর, আবদুল হাসনাত মিল্টন, পাকি ব্লাড বনি আমিন এবং ফ্রড মেজর আখতারুজ্জামান, মনজুরুল ইসলাম পান্নার টকশো সহ একঝাঁক গারবেজ ইউটিউবার গত নভেম্বরের ২৮ তারিখ থেকে দাবি করে আসছিলেন খালেদা জিয়া নাকি অনেক আগেই মারা গেছেন। তাদের মতে, উনার মৃতদেহ হাসপাতালের বিছানায় লাইফ সাপোর্টে শুইয়ে রাখা হয়েছিল সপ্তাহের পর সপ্তাহ। এই ধরনের বক্তব্য শুধু রাজনৈতিকভাবে অনৈতিক নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং হাস্যকর।
প্রথমত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের একদম মৌলিক জ্ঞান থাকলেই বোঝা যায় যে মৃত্যুর পর মানব শরীরে যে জৈবিক প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা কোনো যন্ত্র দিয়ে থামানো যায় না। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রিগর মরটিস বা শরীর শক্ত হওয়া শুরু হয়, লিভর মরটিস বা রক্ত জমাট বাঁধা শুরু হয়, এবং কোষীয় পর্যায়ে ভাঙন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। একজন মৃত মানুষকে ভেন্টিলেটর বা অন্য কোনো যন্ত্রের সাহায্যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ জীবিত দেখানো সম্পূর্ণ অসম্ভব। অর্গান ডোনেশনের ক্ষেত্রে ব্রেইন ডেথ হওয়ার পর মাত্র কয়েক ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ এক-দুই দিন পর্যন্ত দেহের কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করা যায়, এবং তাও বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতিতে। কিন্তু পুরো মৃতদেহকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাঁচিয়ে রাখার কথা বলা একদম উন্মাদনা বা চরম মূর্খতা ছাড়া আর কিছু না।
দ্বিতীয়ত, এভারকেয়ার হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে শুধু একজন দুজন ডাক্তার নন, বরং ডজনখানেক চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, প্যারামেডিক্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মী কাজ করেন। খালেদা জিয়ার মতো একজন জাতীয় নেতার চিকিৎসায় একটি পুরো মেডিকেল টিম নিয়োজিত ছিল। এই সবাইকে নিয়ে একটি ষড়যন্ত্র বা প্রতারণা চালানো কি আদৌ সম্ভব? এই সব পেশাদার মানুষ, যাদের নিজস্ব নৈতিকতা এবং পেশাদারিত্ব আছে, তারা কি এই ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িত হবেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ জানেন।
তৃতীয়ত, যারা এই গুজব ছড়িয়েছেন তারা মূলত দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। একদল হলো জামাত-শিবিরের সমর্থক এবং তাদের মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট যারা বিএনপিকে দুর্বল করতে এবং নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এই মিথ্যাচার করেছেন। অন্যদল হলো চরম আওয়ামী ঘরানার কিছু ইউটিউবার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ী যারা খালেদা জিয়াকে অপমান করার জন্য যেকোনো নিম্নমানে নামতে পারেন। এই দুই পক্ষই মূলত ভিউ, শেয়ার, মনিটাইজেশন এবং পলিটিক্যাল স্কোরিংয়ের জন্য একজন মুমূর্ষু মানুষকে নিয়ে এই ঘৃণ্য খেলা খেলেছেন।
চতুর্থত, এই ইউটিউবারদের একটি বিশাল মুরিদ শ্রেণী তৈরি হয়েছে যারা তাদের প্রতিটি কথাকে সত্যবাণী হিসেবে ধরে নেয়। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই এরা গুজব ছড়ায়, শেয়ার করে, এবং নিজেরাও নতুন গুজব তৈরি করে। এই অন্ধ বিশ্বাসের সংস্কৃতি সামাজিক মাধ্যমে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে সত্য-মিথ্যার কোনো পার্থক্য থাকছে না।
পঞ্চমত, বিএনপির মিডিয়া উইং এই পুরো সময়টায় অত্যন্ত দুর্বল ভূমিকা পালন করেছে। তারা দ্রুত এবং স্পষ্টভাবে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ফলে গুজবের জায়গা তৈরি হয়েছে। একটি বড় রাজনৈতিক দলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এত দুর্বল হওয়া উচিত নয়। তাদের এই ব্যর্থতা শত্রুপক্ষকে আরও বেশি সুযোগ করে দিয়েছে মিথ্যাচার করার।
সবশেষে, খালেদা জিয়া মৃত্যুবরণ করে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তিনি আগে মরেননি। তিনি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় ছিলেন, তার শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা ছিল, কিডনি ফেইলিওর হয়েছিল, রক্তে সংক্রমণ ছিল, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তার শরীরে ছিল। তার অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছিল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি মারা গেছেন। এটাই বাস্তবতা। যারা এর বাইরে কিছু বলছেন তারা হয় পাগল, নয়তো দুর্বৃত্ত।
রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবে, বিরোধিতা থাকবে, সমালোচনা থাকবে। কিন্তু একটি মৌলিক মানবিকতা এবং সত্যের প্রতি সম্মান থাকা দরকার। একজন মানুষের মৃত্যু নিয়ে এই ধরনের নোংরা খেলা খেলা যে কোনো সভ্য সমাজে অগ্রহণযোগ্য। যারা এই কাজ করছেন তাদের প্রতি আহ্বান, অন্তত মৃত্যুকে সম্মান করুন, মানবিকতাকে সম্মান করুন। এবং যারা এসব গুজব শুনে বিশ্বাস করেন তাদের প্রতি অনুরোধ, একটু ভাবুন, একটু যাচাই করুন। অন্ধভাবে কারো কথা বিশ্বাস করে নিজেকে এবং সমাজকে বিভ্রান্ত করবেন না। খালেদা জিয়া মরিয়া প্রমাণ করে গেলেন তিনি আগে মরেননি, এবং যারা বলেছিলেন তিনি মরে গেছেন তারা সবাই মিথ্যাবাদী এবং চরিত্রহীন ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


