মুক্তি রানীরা হারিয়ে যায়। বাবা-মা কাঁদে। আত্মীয়-স^জন ,ভাই-বোন খোঁজে , আফশোস-অনুশোচনা করে। একসময় সবাই ভুলে যায়। ভুলতে পারে না মা। নিঃসঙ্গ, নিরবতায় খচ খচ করে তার অন্তর। হারানোর বেদনায় বুকটা চিন চিন করে ব্যাথা করে। গাল বেয়ে ঝরে চোখের পানি। দু‘চোখের কোনা ভিজতে ভিজতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। চোখে ছানি পড়ে। ঝাপসা হয় চারদিক। ঝাপসা চোখেও এদিক সেদিক চায়। খোঁজে ফেরে মুক্তিকে।
মুক্তি রানীর যে মুক্তি মেলে না। হয় তাকে থাকতে হয় কোন মক্ষিরারীর সেবায় নিবেদিত হয়ে, কখনো কারো কেনা দাসী হয়ে, কখনো বিকৃত রুচির পুরুষের বিছানার সঙ্গী হয়ে । আবার কখনো রক্ত, চোখ,কিডনী সহ কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রেখে চলে যেতে হয় পরপারে। তাদের জন্মই হয় যেন হারিয়ে যাওয়ার জন্য ।
কুড়িগ্রামের বৈদ্যের বাজারে হত দরিদ্র একটি পরিবারে এ মুক্তির (১০) জন্ম। বাবা মন্টু রায় দুরারোগ্য রোগে শয্যাশায়ী। মা কল্পনা রানীর তিন ছেলে মেয়ের সবার বড় মুক্তি। স্কুলে পড়তো তৃতীয় শ্রেনীকে।বাড়তে না বাড়তে অভাবের সংসারে প্রথমেই বোঝা হয়ে ওঠে মুক্তি। তাকে কাজের মেয়ে হিসাবে যেতে হয় ঢাকায়। ডেকো গ্র“পের ইঞ্জিনিয়ার প্রবীর কুমারের বাড়িতে। প্রতিবেশী পরেশ রায়ের জানাশুনা থাকায় তিনি মুক্তিকে পৌঁছে দেন সেখানে। ভাল খাবার, পোষাক ও মাসে ৪০০ টাকা বেতন বাড়িতে পাঠাতে পারবে এমন আশ্বাস পেয়ে ছেড়েছে সে বাড়ি। দুই বছরে দুই একবার মায়ের করা ফোনে কথা বলা ছাড়া আর বাড়ির সাথে যোগাযোগ হয় নাই। কুশলাদি ছাড়া ‘একমাত্র ছোট ভাইটি নিশ্চয় বড় হয়েছে খানিকটা ’এমন আলাপে গৃহকর্ত্রীর কাজের তাড়া খেয়ে ছেড়েছে ফোন। বলাই হয় নি তার ‘ মা, এবার পুজায় আমাকে নিতে পাঠিও কাউকে’।
মুক্তির ফেরা হয়নি। কয়েকদিন ধরে মা কল্পনার মনটা কেমন যেন আনচান করে । হঠাৎ একটা মোটর গাড়ী এসে দাঁড়ায় বড় রাস্তার মোড়ে। মুক্তিদের বাড়ির রাস্তাটা অনেক সরু। গাড়ী ঢুকাতে না পেরে তাই নেমে আসে এক ভদ্রলোক। সাথে পরেশ রায়ও। মুক্তির ব্যাপারে জানতে চায় ভদ্রলোক। ‘মুক্তি তো ঢাকায় থাকে’ জানিয়ে কল্পনা পরিচয় জানতে চায় । কোন কথা না জানিয়ে ভদ্রলোক গাড়িতে গিয়ে ওঠে। পরেশ জানায় মুক্তির খোঁজে এসেছেন প্রবীর বাবু। কল্পনা বুঝতে পারে না তার কথা । আবার জানতে চায় মুক্তির কি হয়েছে? পরেশ এবার কিছুটা পরিস্কার করে বলে। মুক্তি তাদের বাসায় নাই । উনি খুঁজতে এসেছেন। কেন-কবে - কিভাবে- কোথায় কল্পনার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তরিঘরি করে চলে যায় তারা ।
কল্পনা জানতে পেরেছে ভদ্রলোক প্রবীর কুমার । কিন্তু তিনি মুক্তির খোঁজে করবেন কেন । সে তো ঢাকায় তারই বাসায়। কিছুই বলা হয়নি। সে বাসার ঠিকানা বলতে তো একটা ফোন নম্বর আছে। পরে ফোন করে জানতে পারে মুক্তি তাদের বাসায় নেই । হারিয়ে গেছে। বাড়ির মালিক থানায় জিডি করেছে। টাকা-পয়সা ,স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়েছে বলে থানায় জানিয়েছে মালিক। আর তাদের সব দায়িত্ব যেন শেষ হয়েছে। সেবাড়িতে আর কোন ফোন করতে বারণ করেছে মালিক। বাড়াবাড়ি করলে চুরির অপরাধে জেলে পাঠানোর হুমকিও দিয়েছে কল্পনাকে। ‘আমার মেয়েকে ফিরে দেন’ বলে অনেক কান্নাকাটি করেছেন কল্পনা। অনেককে দিয়ে ফোন করিয়েছেন কিন্তু খোঁজ মেলেনি। ফোনটি বন্ধ করে রেখেছেন। পরেশ রায়কে ধরে অনেক অনুনয় করেছে । কিন্তু তিনিও কোন খবর দিতে পারেননি ।
কল্পনার কান্না হয়েছে যেন নিত্য সঙ্গী । স্কুলে উপবৃত্তির জন্য মুক্তির ছবি তুলেছিল একসময় । এক কপি রেখেছিল বাড়িতে। ঢাকায় যাওয়ার দিন মা ভাইবোনদের নিজের ছবিটা দেখিয়ে বলেছিল তার জন্য না কাঁদতে । দেখতে ইচ্ছে হলে যেন ছবিটা দেখে। হাতের ঘষা লেগে ছবিটার রং উঠে গেছে স্থানে স্থানে। সেটা দেখিয়ে সবার কাছে কল্পনা জানতে চায় কেউ তাকে দেখেছে কিনা।খুঁজতে ঢাকায় যাওয়ার সামর্থ যে তার নেই। পেটের তাড়নায় বাধ্য হয়েছিলেন মেয়েকে কাজে পাঠাতে। সে বেঁচে আছে না কি মরে গেছে কেউ কি জানে? কে দিবে তার উত্তর ? না কি হারিয়ে গেছে মুক্তি? তাকে খুঁজে দেওয়ার কি কেউ নাই ? কল্পনার ভাসতে থাকা চোখের সামনে প্রশ্ন গুলো ভিমড়ি খেতে থাকে। আরো ঝাপসা হয়ে তার পৃথিবী।