পণ্ডিত, আইনজ্ঞ, ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী ( c. 1058 – 19 December 1111)। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পর ইমাম গাজ্জালী ছিলেন অন্যতম প্রভাবশালী মুসলিম। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ও আলেমে দ্বীন ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-গাজ্জালী কে হুজ্জাত আল ইসলাম বা Proof of Islam (ইসলামের প্রমাণ), জাইন আল-দীন Ornament of Faith (ঈমানের অলঙ্কার) এবং মুজাজ্জোর The renewer of religion ( ধর্ম সংস্কারক) -এর মতো বিশেষণে প্রশংসিত হয়েছেন। ইমাম গাজ্জালী রঃ এর পিতার ও পিতামহ উভয়ের নামই মুহম্মদ। তিনি খোরাসানের অন্তর্গত তুস নগরের গাজালা নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। তাই সবাই উনাকে গাজ্জালী নামেই চিনে। পৃথিবী ব্যাপি জ্ঞানের আলো বিতরনের উদ্দেশ্যে হযরত ইমাম গাজ্জালী র: ঘুরে ফিরেছেন দেশ,থেকে দেশে। প্রায় দশ বছর পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বিচরণ করে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারে যে অবদান রেখে গেছেন তা নিঃসন্ধেহে অতুলনীয়। এ মনীষি মাত্র ৫৫ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। শৈশব ও পাঠ্য জীবন বাদ দিলে মাত্র ৩৪/৩৫ বৎসর কর্মজীবনে তিনি অনেক অমুল্য গ্রন্থ রচনা করেন। বিজ্ঞান, ইসলাম দর্শন এবং সুফিবাদের উপর তার ৭০ টি বই ইউরোপে বেশ সমাদৃত হয়েছে। যাদের অন্যতম হলো-
১) দার্শনিকদের অসঙ্গতি (Incoherence of the Philosophers)
২) ধর্মীয় বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণ (The Revival of Religious Science)
৩) জেরুজালেমর এলাকা (The Jerusalem Tract)
৪) হেদায়েতের শুরু (The Beginning of Guidance)
ইমাম গাজ্জালীর সেরা দশটি উদ্ধৃতি
১. তের'টি অদেখা শত্রুদের উপর আপনার জিহাদ ঘোষণা করুন-কাম,ক্রোধ,ঔদ্ধত্য,অহংকার,স্বার্থপরতা, লোভ, লালসা,অসহিষ্ণুতা,ভণ্ডামি, মিথ্যাচার, প্রতারণা,গালগল্প ও পরনিন্দা। যদি আপনি তাদেরকে দক্ষতার সহিত ধ্বংস করতে পারেন, তাহলে আপনি যে সমস্ত শত্রুদের দেখতে পারেন তাদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত হবেন।
২. মানুষের গুণকীর্তনে আপনার হৃদয়কে আনন্দ নিতে দেবেন না, তাদের নিন্দার মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করবেন না ।
৩. আপনি যা ভালবাসেন তা পেতে হলে, প্রথমেই আপনি যা ঘৃণা করেন তারজন্য ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে ।
৪. কর্ম ছাড়া জ্ঞান বিনষ্ট হয় এবং ক্রিয়া ছাড়া কর্ম হলো নির্বুদ্ধিতা|
৫. যারা ঝিনুক খুঁজছে তারা ঝিনুকই খুঁজে পাবেন, যারা এগুলো খোলে তারা মুক্তা খুঁজে পাবে।
৬. আমি কখনো আমার নিজের চেয়ে কঠিন কোনো কিছুর মোকাবেলা করিনি, যা কখনও কখনো আমাকে সাহায্য করে, কখনো বা আমার বিরুদ্ধাচরণ করে ।
৭. আপনার সমসাময়িক যারা চলে গেছে তাদের স্মরণ করুন এবং যারা তোমার সমবয়সী ছিলো। তারা যে সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেছিল, যে উচ্চ পদ,এবং সুন্দর দেহের অধিকারী ছিল তা কেউ মনে রাখবে না। আজ সব কিছু ধূলিসাৎ হয়ে গেছে । তারা তাদের পেছনে রেখে গেছে এতিম ও বিধবা। তাদের ধন-সম্পদ বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং তাদের বাড়ী-ঘর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে । আজ তাদের কোন নিদর্শন নেই এবং তারা পৃথিবীর তলদেশে অন্ধকারে পড়ে আছে। আপনার মনের চোখের সামনে তাদের মুখের চিত্র অংকন করুন এবং চিন্তা করুন।
৮. পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসের অর্ধেক মানুষ তাদের খারাপ আচরণ ও অজ্ঞতার কারণে ধর্মকে কুৎসিত মনে করে।
৯. আপনার সময়কে অবহেলা করে না, এবং এটি অযথা ব্যবহার করে না; বিপরীতভাবে আপনি নিজেকে জবাবদিহিতায় আনা উচিত. প্রতিদিন এবং রাতে আপনার জবাবদিহিতা এবং অন্যান্য অভ্যাস গঠন করুন । এভাবেই প্রতিটি সময়কালে আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ (বারাকাহ) নিয়ে আসা যায়। আপনার প্রতিটি শ্বাস যদি একটি অমূল্য রত্ন হয়, প্রতারিত বোকা যারা আনন্দিত হয় তাদের মত হয়ো না, কারণ প্রত্যেক দিন তাদের সম্পদ বৃদ্ধি হয় যখন তাদের জীবন ছোট থেকে ছোটই হচ্ছে |
১০. আপনার হৃদয়ে কোন একজন মুসলমান সম্পর্কে খারাপ সন্দেহ হলে তার প্রতি আপনার বিবেচনা বৃদ্ধি করো এবং তার জন্য দোয়া করো। এভাবে তুমি শয়তানকে রাগান্বিত হতে দেখবে এবং তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে। এই কারণে শয়তান আপনার অন্তরে অসৎ চিন্তা-ভাবনা ঢুকাতে অনিচ্ছুক থাকবে,শয়তান ভয় পাবে যে, আপনি আপনার ভাইয়ের প্রতি আপনার বিবেচনা বৃদ্ধি করবেন এবং আবারো তার জন্য দোয়ার দরিয়ায় পরিণত হবেন ।
এই মহান দার্শনিকের অর্থনৈতিক দর্শন আজোও বিবেকবান হৃদয়কে নাড়া দেয়। তিনি অর্থনৈতিক কার্যকলাপের তিনটি লক্ষ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা তিনি বিশ্বাস করেছিলেন একজন ব্যক্তির নিজের জন্য উপকারী এবং ধর্মীয় দায়বদ্ধতার অংশ হিসাবে, তা হলো- ক) "বেঁচে থাকার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন; খ) একজন ব্যক্তির নিজ বংশধরদের সুবিধার বিধান করা গ) যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তাদের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করা। এমন ভাবানা থেকে হয়তো জৈনৈক ইউরোপীয় পন্ডিত বলেছেন, ইমাম গাজ্জালী ও ইবনে রুশদের জন্ম না হলে মুসলমানগন নিউটন ও এরিষ্টটলের জাতি হয়েই থাকতো। বস্তুত পাশ্চাত্যের জড়বাদী ভ্রান্ত দার্শনিক মতবাদের মোকাবিলায় খটি দর্শনকে বলিষ্ঠ যুক্তিতে প্রকাশ করে ইমাম গাজ্জালী বিশ্ব মানবের মুল্যবোধ ও চিন্তাধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করেন। অপরিনামদর্শী আধ্যাতিক জ্ঞান ও চিন্তাধারার মাধ্যমে দিকভ্রান্ত মানুষকে সঠিক পথের সন্দ্ধান দিয়ে মানব ইতিহাসে অমরত্বের স্বাদ গ্রহন করছেন। এ মহান দার্শনিকের কর্ম ও জীবন হাজারো মানুষকে আলোকিত করেছে দেশে-দেশে, যুগে যুগে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৯ দুপুর ২:৩৬