somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালন রবীন্দ্রনাথ মুজিবনগর; রাজমিস্ত্রির খপ্পরে কুষ্টিয়ার তিন অনাথ আশ্রম

০১ লা এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রায় দশ বছর পর কুষ্টিয়া গেলাম। শুকনা গড়াই নদী হেঁটে পার হয়ে নসিমনে চড়ে প্রথমেই শিলাইদহ ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরবাড়িতে কেন যেন যেতে যত ভাল্লাগে যাবার পরে আর তত ভাল্লাগে না। উঠানে ঢোকার পর তাও যতটুকু ভালোলাগার রেশ থাকে; বাড়ির ভেতরে ঢুকলেই তা একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকে। বহুবারই তো গেলাম। কিন্তু সেই একই অনুভূতি; অন্ধকার ঘরে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা ছবি আর ঘুণে ধরা ঠাকুরবাড়ির পুরোনো কিছু ফার্নিচার...

বাড়িটাকে কি অন্যভাবে সাজানো যায় না? রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক বাড়ি বলেই কি আমরা শুধু পারিবারিক পুরোনো খাটপালঙ্ক চেয়ার আর সব জায়গায় সহজলভ্য কয়েকটা ছবি দেখব? ওখানে সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে দেখানোর কোনো ব্যবস্থা করা যায় না? প্রতিদিন ওখানে যাওয়া হাজার হাজার স্কুলশিশু আর দর্শকদের জন্য ওটাকে কি একটা রবীন্দ্রকেন্দ্র বানানো যায় না?

কে জানে। আমি জানি না। জাদুঘরের নিয়ম নীতি আমার জানা নেই। তার চেয়ে বাউন্ডারির বাইরে পুকুরপাড়ের বকুলতলাটা আমার বরং বেশি ভাল্লাগে। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হবার জন্য গেটের দিকে আগালেই উঠানের ডান কোনায় সামনের আর ডানের দেয়ালের বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে একটা মঞ্চ আর একটা অফিসঘর। অফিসঘরটা জুড়ে রেখেছে উঠানের বেশ কিছু অংশ আর দুই ফুট উঁচু মঞ্চটা জুড়ে রেখেছে আড়াইফুট উঁচু বাউন্ডারির দুই কোনার বেশ কিছু জায়গা। এই অফিসঘরে বসে ঠাকুরবাড়ির দেখাশোনা করেন সরকারি কর্তাবাবুরা। আর মঞ্চটা?

ওটা হু.মু এরশাদ সাহেবের। তিনি বাংলাদেশে বহু কিছু করার অংশ হিসেবে একবার বড়োসড়ো করে রবীন্দ্রনাথকেও স্মরণ করার জন্য ঠাকুরবাড়িতে আসেন। বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তাকে ঠাকুরবাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয়েছিল। এবং সেজন্য দরকার ছিল উঁচু একটা মঞ্চ। এটা সেই মঞ্চ। ইট সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা বক্তৃতার মঞ্চ...

এরশাদকে উঁচু করার জন্য ঠাকুরবাড়ির নাকেমুখে এরকম একটা স্থায়ী মঞ্চ চাপিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিশ্বাস বন্ধ না করলে কি একেবারেই চলত না?


ঠাকুরবারিড় বকুলতলায় বাউলদের রবীন্দ্রসংগীতের আসর

০২

বারো কি তেরো বছর পর এলাম মেরেপুরের মুজিবনগর। ঠা ঠা রোদের ঘাম-ধুলা সব এক ঝটকায় মুছিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নতুন স্ট্যাচুগুলো মনটা ভালো করে দিলো। মূর্তিগুলো মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একেকটা কম্পোজিশন। মুজিবনগর সরকারের শপথ থেকে শুরু করে নিয়াজির আত্মসমর্পণ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সবগুলো ঘটনাই একের পর এক চুনাপাথরের রংয়ে সাজানো। অদ্ভুত সুন্দর এবং নিখুঁত। আমরা মুক্তিযুদ্ধের যেসব ঘটনার ছবি দেখে অভ্যস্ত। এগুলো সেইসব ছবিরই স্ট্যাচু। কিন্তু একটা একটা করে সবগুরো ঘুরে দেখার পর মনে হলো সার্বিক কম্পোজিশন থেকে কিছু একটা যেন মিসিং...


মুজিবনগর সরকারের শপথ এবং প্রথম গার্ড অব অনারের কম্পোজিশনের সামনে ক্ষুদে পর্যটক জয়িতা

অনেকক্ষণ তাকানোর পরে মনে হলো মুক্তিযুদ্ধের এই মূর্তিময় উপস্থাপনার মধ্যে বাংলাদেশের প্রকৃতিটা নেই। মেহেরপুরের আম্রকাননে করা এই কম্পোজিশনের সাথে কি একটা দুইটা কিংবা কয়েকটা প্রাকৃতিক গাছকে অংশ করা যেত না? স্বাভাবিক গাছগুলোকে কেটে পুরোটাই কি ইট দিয়ে মুড়িয়ে দেবার দরকার ছিল?

কম্পোজিশনগুলোর পেছনে স্টেডিয়ামের মতো একটা গ্যালারি। তিন তলা সমান উঁচু। চারদিকে গোল। স্টেডিয়ামের মাঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের থ্রিডি মানচিত্র। সবুজ জমিনের মানচিত্রের বিভিন্ন জায়গায় মিনিয়েচার মডেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কম্পোজিশন। দেখতে দেখতে মনে হলো সিমেন্টের উপর প্লাস্টিক পেইন্ট ছাড়া প্রাকৃতিক সবুজ দিয়েও হয়ত মানচিত্রটাকে সবুজ করা যেত...

গ্যালারি থেকে নেমে চলে আসি উল্টো দিকের আম বাগানের ভেতরে মুজিবনগর সরকারের শপথ মঞ্চের উপর বানানো স্মৃতিসৌধে। চমৎকার এবং চমৎকার একটা স্মৃতিসৌধ। মুজিবনগর সরকারের শপথ মঞ্চ যেখানে বানানো ছিল সেখানটাতেই স্মৃতিসৌধটি। আশপাশে আম বাগানও নিখুঁত অবস্থায় আছে। আর মঞ্চের ঠিক ডান কোনায় একটা বিশাল মেহগনি গাছ...

- গাছটার বয়স সাড়ে তিনশো বছর। একটুখানি হেসে কথাটা জানালেন স্মৃতিসৌধের বর্তমান কেয়ারটেকার আর ৭১এ শপথমঞ্চ নির্মাণের একজন কর্মী মুক্তিযোদ্ধা সুভাস মল্লিক...

শপথের আগের রাতে বন্য শুকর আর শেয়ালের অবাধ বিচরণভূমিতে মঞ্চ বানানো আর পাশের চার্চ থেকে চেয়ার টেবিল এনে নেতাদের বসার ব্যবস্থা করার বর্ণনা দিতে দিতে বাঁশি বাজিয়ে সৌধের দিকে ধেয়ে গেলেন সুভাস মল্লিক। জুতা মোজা স্যান্ডেল নিয়ে সৌধের স্তম্ভ বেয়ে বেয়ে উঠছে কয়েকটা তরুণ। ধমকে সবাইকে নামিয়ে আবার ফিরে এলেন- সাধারণ নিয়মটাও এদেরকে শেখানোর কেউ নেই। বুঝলেন?

সত্যি সত্যি ভালো লাগার মতো একটা স্মৃতিসৌধ। সৌধ থেকে নেমে গেট দিয়ে বের হবার মুখেই চোখে পড়ল বামপাশের দেয়াল ঘেঁষে দুই ফুট উঁচু একটা সিমেন্টের মঞ্চ। দেখার জন্য এগিয়ে যেতেই একটা ধাক্কা খেলাম। এই মঞ্চটার নাম শেখ হাসিনা মঞ্চ। সামনের দিকে শেখ হাসিনার নাম ধারণ করে স্মৃতিসৌধের দিকে পাছা ঠেকিয়ে দাঁড়ানো মঞ্চটা সম্ভবত তিনি যখন স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন তখন বানানো হয়...

স্মৃতিসৌধের সামনে নিজের নামে স্থায়ী মঞ্চ বসিয়ে শেখ হাসিনা কি নিজেকে সম্মানিত করলেন নাকি বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথকে অসম্মান করলেন?


সুভাস মল্লিক পর্যটকদের বর্ণনা করছেন সেদিনের শপথমঞ্চ তৈরির কাহিনী

০৩

নিচে বারো চৌদ্দফুট ফাঁকা রেখে উপরে দালান তোলার যে মডেল; বাংলাদেশে তার নাম সাইক্লোন সেন্টার। গোরস্থানে সিমেন্টের কারুকাজ করা ঢিবি জাতীয় যে কবর তা দেখলেই বোঝা যায় কোনো পিরের কবর। আর মসজিদের মডেল তো সকলেরই জানা...

সিমেন্টের একতারাওয়ালা একটা গেটের ওইপারে একটা সাইক্লোন সেন্টার বানিয়ে তার সামনে ছোট একটা মসজিদ তুলে সেই মসজিদের ভেতর একটা পিরের কবর ঢুকিয়ে দিলে যে অবস্থা দাঁড়ায় সেটাই হলো সরকারি হেফাজতে লালন সাঁইয়ের বর্তমান চেহারা। দেখলেই মনে হবে লালন নামে একজন পির এখানে সিমেন্টের মসজিদে বসে আল্লাবিল্লা করে বৃক্ষবিহীন সিমেন্টের উঠান পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে সাইক্লোন সেন্টারে উঠে গিয়ে ঘুমাতেন...


ডানের মসজিদে লালন বন্দী। সামনে সিমেন্টচাপা তার শিষ্যের দল

আজকের স্থাপত্যপ্রকৌশল দিয়ে কালিগঙ্গার পাড়ে ছেউড়িয়ায় লালনকেন্দ্রকে লালনের পরিবেশের মতো সাজানো কি খুব বেশি কঠিন হতো? আর রাজনৈতিকভাবে খুব কি অসুবিধা হতো মৃত লালনকে মসজিদে ঢুকিয়ে না দিলে?
২০১১.০৩.২৪
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ২:৪৭
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×