somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিল ঐখানে , এখন নেই ।

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবোনের নিজ হাতে লাগান গাছের ফুল , তার মেলবোর্নের বাড়ীতে ।


একজন সেদিন ফোনে বলল মেলবোর্ন থেকে , ' জানেন আপা , আজ মনাশ ইউনিভার্সিটির জাপানী ছাত্র কাঁদছে , আমেরিকান ছাত্র কাঁদছে , গতকাল ইকোনোমেট্রিক্স এন্ড বিজনেস ফ্যাকাল্টির ক্লাস সাসপেন্ড ছিল তাহেরা পারভীনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে । তাকে যারা চিনত , ভালবাসত । অনেক জনপ্রিয় ছিল সে । '
শুনতে হল " ছিল সে " ।
শুনছি শেষদিন আম্মার সাথে একঘন্টারও বেশী কথা বলেছিল সে , অনেক হাসি ঠাট্টা ; প্রতিদিন যেমন বলত । সাত সন্তানের কনিষ্ঠ কন্যা ছিল সে , ছিল আম্মার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু , আম্মার সেবিকা ।
তাই আম্মাজী সেদিন সবার মাঝে বসে বলেছিলেন ,' তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমার কুটন ( আম্মা তাকে এই নামে ডাকতেন )তার আব্বার পাশে থাকবে চিরকালের , তার ঐপাশে আমি ; সবার ছোট তো , বাবা-মায়ের কোলের মধ্যে থাকবে সে '। আমি বললাম , " আম্মা দেখেন আপনার ছোট মেয়ে কেমন চালাকী করে সবার আগে ভাল জায়াটা দখল করে নিল " ।
আম্মার মতের সাথে সহমত আমাদের সবার ।
তাই হয়েছে , আমাদের অসম্ভব কষ্টের মধ্যে ফেলে সে দ্রুত চলে গেল , আব্বাজীর পাশে চিরশান্তির ঠিকানা খুঁজে নিল ।

হঠাৎ মনে পড়ল , ও যেখানে ঘুমিয়ে আছে অনেকদিন আগে একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিল ঐখানে , এখন নেই । নেই আর নেই ; চারিদিকে কি বিষম শূন্যতা , হাহাকার ! এত মানুষ আছে তবু মনে হয় ফাঁকা সব , সবকিছু ফাঁকি , জীবন ফাঁকি --- মিথ্যা , ছলনা । মরনটাই সত্য । তা না হলে কেন সে সেখানেই গেল সব ছেড়ে ?

মনে পড়ছে কত কিছু । ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে পড়বার সময় শিক্ষা সফরে কক্সবাজার গিয়েছিল একবার , সেখানে বসে আমাকে লিখেছিল চিঠি । একটা লাইন ছিল , " এখানে এসে মনে হচ্ছে আমাদের গ্রামের বাড়ীটা এর চেয়ে অনেক সুন্দর ! " তার ভাল লাগা প্রিয় জায়গায় শেষ ঠিকানা বেছে নিল সে । পৃথিবীর এত জায়গা ছেড়ে জীবনের মায়া এড়িয়ে অল্প বয়সে ।
গত ১৪ই আগষ্ট মেলবোর্নে দুর্ঘটনায় চলে গেছে সে মৃত্যুর পরপারে আকস্মিক ভাবে। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ....... রাজেউন । যেখান থেকে শত ডাকেও আর সাড়া দেয় না সে ; কেউ দেয়না , দিতে পারে না । তা না হলে আমাদের বুক ফাটা আর্তনাদে সে কি ছুটে আসত না ।
মনাশ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছিল সে , সামনের বছরের জুনে শেষ হবার কথা ছিল । আম্মাকে বলেছিল , " আমি আপনার জন্য আমার পিএইচডির সার্টিফিকেট নিয়ে আসব , দেখবেন কত্ত খুশী লাগবে আপনার " । সেই সার্টিফিকেটের পরিবর্তে এল এক নিষ্ঠুর সংবাদ ।
আমাদের জন্য এক চরম বাস্তবতা , অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা ।

আগে একবার মনাশে এম এস করতে পাঠিয়েছিল তাকে মন্ত্রনালয়ে চাকুরীর শুরুতে । ২০০০ বা ২০০১ সালে মনাশ অ্যাওয়ার্ড দেবে বলে তাকে যখন নিমন্ত্রনপত্র দিয়েছিল , সে জানিয়েছিল যে সে বাংলাদেশ সরকারের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা , সে তো আর কোথাও কোনকিছুর জন্য এ্যাপ্লাই করে নি । জবাবে কতৃপক্ষ জানিয়েছিল , কেন্দ্রীয়ভাবে তাকে খুঁজে বের করেছে তারা । সেবার বেস্ট স্টুডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করেছিল ছিপছিপে গড়নের , শ্যামলা বাঙালী মেয়েটি , ছোট বোনটি আমার ।
মনে পড়ে ১৮ তম বি সি এস এর সময় তার অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে , রেজাল্ট হয় নি , আমার আগ্রহে সে পরীক্ষা দিতে যায় এবং তার মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট হবার কিছুদিনের মধ্যে মন্ত্রনালয়ে তার পোষ্টিং হয়ে যায় । ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট থেকে ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড হয়ে বের হয় সে । সেখানে সে জনপ্রিয় ছিল সেটাও জানতাম ।

সে মেধাবী ছিল , তাই মনাশ থেকে ফেরার পর তার যোগ্যতার মূল্যায়ন করবার পরে আবার পিএইচডি করবার অনুমতি পেয়েছিল সে কয়েকবছরের মধ্য । বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিল সে পদমর্যাদায় । অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে সে এসব অর্জন করেছিল নিজ যোগ্যতায় , পরিশ্রমে এবং আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ।
সব কিছু সে আগে ভাগে করতে চেয়েছে , পেরেছেও । তার হয়তো যাবার তাড়া ছিল , আমরা বুঝতে পারি নি । ও কি বুঝেছিল ?
সবার ছোট হয়ে ও চলে গেল সবার আগে ।
" ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে ,
সেই দিয়েছে সকল শূণ্য করে "
--- ছোটবেলায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ' ছিন্নমুকুল ' কবিতা পড়ে কবির এমন অস্বাভাবিক চিন্তায় বিরক্ত হয়েছিলাম । মন খারাপ হত বলে এড়িয়ে যেতাম বাড়ীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের বিয়োগব্যথা নিয়ে লেখা এই কবিতা । আর আজ ? এই কবিতাটাই আমাদের পরিবারের চিত্র হয়ে গেল ।
সব খানে তার ছোঁয়া । বাড়ীর সবচেয়ে ছোট বলে আদরের ছিল , তার আদর পাবার বিশেষ যোগ্যতা ছিল । বাড়ীর বড় সন্তানের মত দায়িত্ব পালন করত , মধ্যমনি ছিল সে ।
মনটা খুব নরম ছিল , অনেক বড় হয়েও মুরগীর গোসত খেত না । যে কোন জীবের জন্য তার মায়া ছিল । মেলবোর্ণের বাড়ীতে আছে তার আদরের টিনটিন , যাকে ছেড়ে সে অন্যত্র থাকত না , টিনটিনের যদি কষ্ট হয় এই কথা ভেবে । এখন কি করে থাকছে টিনটিনকে ছেড়ে ?
বলেছিল আম্মাকে , " আম্মা ,আমি চাইলে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারব , চাই না সেটা । আমি দেশে ফিরব , সাধারন মানুষের মত অল্প টাকাতে চলব ।" ওর বরের প্রবাসী জীবনের জন্য আগ্রহ ছিল , ওর ছিল না । গল্প করতো , লেখাপড়ার চাপের মধ্যে হালাল - হারাম বেছে খেতে সময় বের করতে ওর কষ্ট হোত । ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলত যেখানেই থাকতো । আমাদের পরিবারের মধ্যে উজ্জলতম ছিল সে , সর্বাঙ্গীন সুন্দর ছিল তার জীবন , জীবনবোধ । তার মৃত্যুর পর শুনছি তার অফিসের অন্যদের মুখে . " মেধাবী এই মেয়েটি মানুষ হিসেবে ছিল অপূর্ব "। অনেক ভাল ভাল কথা শুনছি , শুনে খুশী হবার পরিবর্তে আফসোস হচ্ছে । মনে হচ্ছে যদি দেশে থাকত , ডিগ্রীর জন্য না যেত এবার হয়তো কাছে থাকত আমাদের । হয়তো অন্যরকম হোত দৃশ্যপট । বিধাতা ভাল জানে ।
অনেক কথা মনে পড়ছে । আমি আর ও পিঠাপিঠি বোন , অতীতের অনেক সুখ-দু:খ ভাগাভাগি আমাদের । একটা পর একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে ।
ভাবতে পারছি না , ও নেই , ওকে দেখব না আর । আম্মার গলা জড়িয়ে ধরবে না দৌড়ে এসে ! আম্মার হাতে বানান চকলেটের জন্য পীড়াপীড়ি করবে না আর । অনেক কিছু মনে আসছে , লেখার শক্তি পাচ্ছি না । ও সাথে করে নিয়ে গেছে আমাদের আনন্দ, হাসি , গান ,বেঁচে থাকবার স্বাভাবিক শক্তি ।

এয়ারপোর্টে কেউ এলে খুশীমনে তাকে স্বাগত জানাতে গিয়েছি আগে । আর এবার এয়ারপোর্টে ? এবার যা পেলাম .........
এবার যা পেলাম তা যেন আর কোনদিন কোন দুর্ভাগা মানুষকে না পেতে হয় কোনদিন । কোনদিন যেন এমন দু:সহ দু:সময়ের মুখোমুখি না হতে হয় আমাদের মত করে । বিধাতার কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করি কেউ যেন আমাদের মত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি না হয় ।



ছোটবোনের আদরের টিনটিন , মেলবোর্নের বাড়ীতে । মনে হচ্ছে আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছে তার প্রিয় মানুষকে ।



[ কৃতজ্ঞতা জানাই নাসিমা আপাকে যিনি গতরাতে আমাকে অনেকটা সময় ধরে বুঝিয়েছেন ,যার অনেক কথা আমি বুঝতে চেয়েছি , পেরেছি । যাঁর অনুপ্রেরনায় লিখতে বসেছি । ]


সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৪৭
৫৩টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×