শহরের হাওয়া বাতাস আর ক'দিন!এমন কিছু জিনিস আছে যা এক জায়গায় পরে থাকতে থাকতে মরিচা ধরে যায়।শফিক সাহেবের মনেরও সেই দুরবস্থা।শহরের পরিচিত হাওয়া বাতাসে থাকতে থাকতে তার মনেও মরিচা ধরার মত। তাই শহরটাকে কিছুদিনের জন্য ছুটি দিয়ে সেই গ্রামের মাটিতেপদার্পণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন,যে গ্রামের প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে আছে তার শৈশবস্মৃতি।
দুপুর ঘনিয়ে এসছে।সূর্যের তাপে পরিবেশ খুব গরম।স্ত্রী হালিমা আর সাত বছরের জমজ দুই ছেলে সাইম এবং নাইমকে নিয়ে গ্রামের মাটিতে ফিরলেন শফিক সাহেব। প্রায় ১০ বছর পর এই আগমন।বাবা-মা হারানোর পর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে
পাড়ি জমিয়েছিলেন।চাকরিবাকরি আর বিয়ে করে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।বাড়ি
পৌছেই সকলের সাথে কুশল বিনিময়,খাওয়া-দাওয়া শেষ করলেন এবং সাথে সাথে মনস্থির করলেন মাছ
ধরবেন।
দুপুর ঘনিয়ে বিকেল হয়ে এলো।শফিক সাহেব দুই ছেলেকে নিয়ে গাঙের দিকে রওনা দিলেন।হাতে
বড় একটা জাল।আর দুই ছেলের হাতে দুইটা ছোট ছোট পাত্র। ছেলে দুটো সর্বক্ষণ দুষ্টুমিতে মেতে থাকে।
নতুন পরিবেশে এসে যেন আচমকা সেই মাত্রা আরো বেড়ে গেলো।শফিক সাহেব ছেলেদের ডাকলেন,
-"সাইম-নাইম দুষ্টুমি করে না"
কে শুনে কার কথা! তাদের দুনিয়ায় তারাই নেতা!
গ্রামের মেঠোপথ ধরে বড় রাস্তায় উঠলেন।রাস্তা পেরিয়ে আবার মেঠোপথ।ছোট ছোট আইলে হাটতে
হাটতে গাঙের পাড়ে এসে পৌঁছলেন।ছেলে দু'টো দুষ্টুমিতে মেতে আছে।এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।
শফিক সাহেব ডাকলেন,
-" সাইম-নাইম দুরে কোথাও যাবে না।এখানেই
খেলো।"
একসঙেগ গলা ফাটালো তার জমজ দুই ছেলে,
-"আচ্ছা বাবা"
মিনিট দশেক পার হলো।আশেপাশে ছেলেদের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে থমকে গেলেন।এদিক
ওদিক ছুটতে লাগলেন। এভাবে আরো পাচ মিনিট ব্যয় হলো।হঠাত দুরের জমিন পেরিয়ে ছুটে আসছে সাইম-
নাইম। শফিক সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন। ছেলেরা কাছে এলে তাদের জড়িয়ে ধরেন,
-"কোথায় গিয়েছেলে? তোমাদের না বলেছিলাম দুরে কোথাও না যেতে!"
-"সরি বাবা" সাইম জবাব দিলো।নাইম চুপচাপ।
তাদের দুজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল হলো যখন কোনো কথা বলে একসাথে বলে।তাই নাইমের চুপ
থাকা শফিক সাহেবকে খানিকটা অবাক করলো। যাই হোক,তিনি ছেলেদের নিয়ে আবার মাছ ধরতে
গেলেন।এইবার শফিক সাহেবকে বেশি অবাক করলো ছেলেদের আচরন। তারা দুজনেই পাত্র থেকে মাছ
তুলে খাওয়ার চেষ্টা করছে।শফিক সাহেব তাড়াতাড়ি ছেলেদের কাছে গিয়ে তাদের বাধা
দিলেন।আজকের মত মাছ ধরা বন্ধ করে ছেলেদের নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।তার হাতে বড়
জালটি আর মাছের পাত্র দু'টি দুই ছেলের হাতে।বড় রাস্তায় পৌঁছেই শফিক সাহেব খুব বেশি অবাক
হলেন এবং ভয়ও পেলেন,যখন দেখলেন ছেলেরা কাচা মাছগুলো অনায়াসে চিবিয়ে খাচ্ছে।তিনি
ছেলেদের বাধা দিতে চাইলেন,কিন্তু দিলেন না। মন তাকে আটকে রাখলো।শফিক সাহেব খেয়াল
করলেন রাস্তায় অনেক মানুষের ভিড়।লোকজনের কথাবার্তা শুনে তার বুঝতে দেরি হলো না যে
এইখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে। তিনি ছেলেদের রাস্তার একপাশে একটা গাছের নিচে দাড় করিয়ে
ঘটনাস্থলে গেলেন।গিয়ে যা দেখলেন তা বিশ্বাসের অযোগ্য। তাড়াতাড়ি পিছু ফিরে
দেখলেন গাছের নিচটা খালি।ছেলেরা সেখানে নেই।এইবার তার কাছে পুরো বিষয়টা জলের মত
পরিষ্কার হয়ে গেলো। শফিক সাহেব নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না।মাটিতে পড়ে থাকা
রক্তমাখা লাশ দুটো জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ শুরু করলেন।
ঘটনাটা ঘটেছে প্রায় আধ ঘন্টা আগে,যখন গাঙের পাড় থেকে তারা মিসিং হয়েছিলো।এক্সিডেন্ট
এর পরপর লোকজন ছুটে এসছিলো তাদের হস্পিটাল নিয়ে যেতে।কিন্তু লোকজনের কি করার যদি
ছেলেগুলো নিজেরাই বাঁচতে না চায়।অর্থাৎ তারা খানিক সময়ও বিলম্ব না করে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।
শফিক সাহেব চোখ বন্ধ অবস্থায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। হালিমা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বাতি
জ্বালিয়ে দিলেন।তিনি খেয়াল করলেন শফিক সাহেবের বালিশটা ভেজা।মুহূর্তেই শফিক সাহেব
সাইম-নাইম বলে চিতকার করে জেগে উঠলেন। হালিমা খুব ভয় পেয়ে শফিক সাহেবের হাত ধরে বলতে লাগলেন,
-"কি হয়েছে! কি হয়েছে!"
বিছানার পাশে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে শফিক সাহেবকে দিলেন।পানি পান করে স্থির হয়ে
বসলেন এবং সাইম-নাইম'দের দেখতে চাইলেন। হালিমা তাকে ছেলেদের রুমে নিয়ে গেলেন।শফিক
সাহেব ঘুমন্ত ছেলেদের কপালে চুমু খেলেন।তারপর আবার নিজেদের ঘরে ঢুকে স্বপ্নের পুরো
ঘটনা হালিমাকে শুনালেন।ঘড়িতে তখন রাত তিনটা।