
একটি ফুটবল ম্যাচ। কেবল একটি মাত্র ম্যাচই পারে নঙ্গী হাইস্কুলকে “টমাস চ্যালেঞ্জ কাপ” পাইয়ে দিতে। আর পারে নঙ্গী হাইস্কুলের গেমস টিচার পুরুর জীবনকে সাজিয়ে তুলতে। এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটিতে যারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে অন্যতম দিয়েগো, ডুডু, কবীর আর জ্যাকসন। এই চারজনের মাঝে ভিন্ন ধর্মালম্বী কবীর আর নামের সাথে স্বভাবের মিল রেখে অদ্ভুত বাকি তিনজন— প্রত্যেকেই সদ্য কৈশোর পেরোতে যাওয়া নবযুবক। প্রত্যেকের জীবনেই আলাদা আলাদা ঘটনাবলির সমাহার। তবুই চারজনই যেন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। কি সেই অদৃশ্য সুতো?
ফুটবলকে ভালোবেসে বড় হয়ে ওঠা এই চারজনের দলটির প্রত্যেকের জীবনেই একে একে বসন্ত আসে। একটু একটু করে রঙিন হতে চায় সব। কিন্তু হয় কি? কোথায় যেন বাধা পড়ে! কে যেন বারবার রঙিন হয়ে ওঠা জীবনগুলোতে কালো কালির ছাপ ফেলতে চায়! আলোর থেকে দূরে সরিয়ে তাদের নিয়ে যেতে চায় অন্ধকার পথের দিকে! কিন্তু কেন? কি তার স্বার্থ? সে কি শেষ পর্যন্ত তার স্বার্থসিদ্ধি করতে পেরেছিল? নব্য যৌবনে আন্দোলিত হওয়া চার কিশোরই কি পেরেছিল আলোর পথ খোঁজার পাশাপাশি তাঁদের স্বপ্নকে পূরণ
করতে? স্কুল জীবনের শেষ খেলায় স্কুলকে একটি অনন্য উপহার দিতে?...
স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর “পাতাঝরার মরশুমে” নতুন যুবকদের গল্প। তাদের স্বপ্নের গল্প। তাদের দুঃখ-কষ্ট-ভালোবাসার গল্প। উপন্যাসটি পড়ার সাথে যখন লেখক পরিচিতি পড়ি তখন চোখ আটকে যায় লেখক যে এলাকায় বড় হয়ে উঠেছেন সেই এলাকার নামটির দিকে, তাঁর স্কুলের জ্বলজ্বল নামটি দেখে আর তার ভালোবাসার কথা পড়ে। মনে হয়, এ কি তবে লেখকের নিজ জীবনে প্রত্যক্ষ করা সত্য ঘটনাই? উত্তর অজানা। তবে উপন্যাস পাঠের সময় একে বাস্তবই লাগে, গল্প গল্প নয় ঠিক। আর দু’টো ফুটবল ম্যাচের বর্ণনা… ফুটবলপ্রেমী-অপ্রেমী মাত্রই উপভোগ করবেন। মনে হয় যেন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের ম্যাচ টেলিভিশনের পর্দায় চলছে। টান টান উত্তেজনায় পাঠককে ধরে রাখে ম্যাচ দু’টির বর্ণণা।
এবার আসি চরিত্র বর্ণনায়। বেশি নয়, উপরোক্ত চারজনের কথাই বলব। এরাই আমার মনে দাগ কেটেছে বেশি।.. দিয়োগাটা কেমন ইনট্রোভার্ট। নিজের কষ্টের কথা কখনো কাউকে বলতে চায় না সে, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, মানুষের কষ্টের কথা শুনে অন্যেরা শুধু সহানুভূতিই দেখাতে পারে, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তাই রবিন মেমোরিয়ালের সাথে প্রথম ম্যাচ হেরে অনেক বড় একটা মিথ্যা Blame ও সে চুপচাপ মেনে নেয়। কাউকে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে না। ভেতরে ভেতরে কেবল গুমড়ে মরে। মাঝে মাঝে হয়তোবা আলতো প্রতিবাদ করে!..
অত্যন্ত ঈশ্বরবিশ্বাসী আর সংস্কার বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ডুডু দিন-ক্ষণ মেনে চলার চেষ্টায় ব্যস্ত মানুষ। কোনো একটা বিপদের সম্ভাবনা এলেই তার নাকের ডগায় সে কেমন যেন ঠিক বিরিয়ানি বিরিয়ানি নয় একটা গন্ধ পায়। আর মুসলমানের ছেলে কবীর ওদের টিমের গোলকিপার। ভালোবাসে টাপুরকে। কিন্তু টাপুর যে হিন্দু! আর সেও তো মনপ্রাণ সঁপে ভালোবেসেছে পুরুকে। তবে? কবীর কি সামাজিক-ধর্মীয় কাঠগোড়া ডিঙিয়ে টাপুরকে কাছে টানতে পারে? নাকি টাপুর পারে বহুদিন আগের জেদের বশে করে করে ফেলা এক ভুলের মাশুল দিয়ে অবশেষে পুরুকে পেতে?...
জ্যাকসন চরিত্রটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। রবিন মেমোরিয়ালের ছেলেরা ওকে জোকার বলেছে, তার সঠিক প্রতুত্ত্যর দেওয়ার পর সে নিজেকে বলেছে ‘জোকার ট্রা্ম্প’। পুরো উপন্যাসটা জুড়ে তার রসময় উপস্থিতি পাঠককে আনন্দ দেয়। মনে হয়, এমন ‘জ্যাকসন’ প্রতিটি বন্ধু দলেই কেউ না কেউ থাকে, যে তার নির্মল, সাধাসিধে, হাস্যোজ্জ্বল চরিত্রের জন্য হয়তো নিজের নামটা নিজেই ভুলতে বসে।
আর এই চারজনের সাথে অন্য যে মানুষটার জীবনের গল্প জড়িয়ে যায় সে পুরু। একটা সময় পুরুর নিজেকে দাদা বলে মনে হয় এই চারজনের।.. আমন, শিমুল, রোহিনি, সায়েকা, পরী--- গল্পের একেকটি খুঁটি, যারা বাকি পাঁচজনের তুলনায় হয়তোবা সরু, তবে বেশ শক্ত, গুরুত্বপূর্ণ।..
এই এত এত চরিত্র আর একটি ‘টমাস চ্যালেঞ্জ কাপ’ এর কাহিনিই “পাতাঝরার মরশুমে”, যে মরশুমে প্রকৃতিকে ভিন্ন দেখায়, অনিন্দ্য ভিন্ন…
বইয়ের নাম- পাতাঝরার মরশুমে
লেখক- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
ধরণ- উপন্যাস
পৃষ্ঠা- ২৩৮
প্রচ্ছদ মূল্য- ২০০
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২৪ ভোর ৪:৩৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



