বয়ঃসন্ধির রঙিন সময়ে কে না জগৎ পাল্টানোর স্বপ্ন দেখে? আমিও এই একই স্বপ্ন দেখেছি। একটা সময়, যখন সিক্স-সেভেনে পড়তাম কিংবা অষ্টম শ্রেণির শুরুর দিকে, খুব করে স্বপন্ দেখতাম দিন বদলের। সমাজের যত অসঙ্গতি, সব ‘প্রচেষ্টা’ নামক স্বচ্ছ পানির প্রবাহে নিঃশ্চিহ্ন করে দিতে ইচ্ছে করতো। মনে মনে কত শত কল্পনার জাল-বুনতাম। তার কিছু কিছু বান্ধবীদের সাথে শেয়ার করলে তিরস্কৃতও হতাম খানিকটা আগে-পিছে। এই তিরস্কার কিংবা নিজের যথাযথ প্রচেষ্টার অভাবেই হয়তো বা সেই স্বপ্নগুলো সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গিয়েছিল। কঠিন বাস্তবতা আমাকেও আর সকলের মতো গতানুগতিক স্রোতের বাহিরে যেতে দেয়নি। সকলের সাথে পা মিলিয়ে না চলে যে একটা পা বাড়িয়ে আরো অনেকগুলো পা’কে সামনে এগিয়ে আসতে অনুপ্রেরণা দেবো, সে সাহস আমি ‘দোলা’ পাইনি।
সেই দিনগুলোর প্রায় ছয়-সাত বছর পরে যখন কোনো এক বইয়ের পাতায় নিজের স্বপ্নের কথাগুলো বাস্তবায়িত হতে দেখি, তা যে কতটা আবেগের, এ কথা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য!
বলছিলাম লেখিকা মালিহা নামলাহ’র প্রথম উপন্যাস “ছায়ামানবী”র কথা। “ছায়ামানবী”র গল্পের মূল চরিত্র মাঈশা যখন তেরো বছরের কিশোরী, তখন এ গল্পের শুরু। স্বপ্ন, কৈশোরের উচ্ছ্বলতা, নতুন স্বপ্ন, ‘টর্চ লাইট টিম’, ক্ষণে ক্ষণে নানা রঙের স্বপ্ন ভঙ্গ, সৃষ্টিকর্তার উপর অসীম বিশ্বাস নিয়ে আবার সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, সদ্য যৌবনে পা দেয়া মাঈশার একাকী সংগ্রামের শুরু- এই নিয়ে “ছায়া মানবী”র উপাখ্যান। এই উপাখ্যানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাড়িত করে। যেকোনো পাঠকমাত্রই নেশাচ্ছন্ন হয়ে ১৫৭ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি শেষ করতে তৎপর হয়ে উঠবেন- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আমি সাধারণত কোনো বই পড়ার সময় কলম হাতে নিই না। এতে আমার পড়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।কিন্তু “ছায়া মানবী” পড়ার সময় আমি একটি সবুজ রঙের কলম হাতের কাছে রাখতে বাধ্য হয়েছি। কারণ প্রতিটি পাতায় পাতায় এতো সুন্দর সুন্দর কথা লেখা যে, তাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত না করলে অপরাধ হয়। আর কবি মাঈশা তথা মালিহা নামলাহ’র অসাধারণ কিছু কবিতা তো আছেই। এই কিছু কবিতা, কিছু বাক্য- এতে লেখিকা মালিহা নামলাহ’র গভীর জীবনবোধ সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে। বইটি পড়ার সময় কোনো এক অজানা কারণে আমার বারবার মনে হচ্ছিল মাঈশা চরিত্রটির প্রতিটি চিন্তা-ভাবনা, কথোপকথন লেখিকা মালিহা নামলাহ’র আর বইয়ের বাকি সব চরিত্র আমি নিজে, যে তার সব কথা অতি মনোযোগ সহকারে শুনছে কিংবা যার সামনে মালিহা নামলাহ তার চিন্তা ভাবনাগুলো মুক্তভাবে মেলে ধরছে।
‘ছায়ামানবী’ বই থেকে আমার প্রিয় কিছু লাইন-
আল্লাহর প্রতি ভরসা যেই ধৈর্য দেয় মানুষকে, সেই ধৈর্য দিয়ে সর্বোচ্চ কঠিন সময়ও পাড় করে দেওয়া যায় অবলীলাক্রমে।
সফলতার কৃতিত্ব নিজে নিলে, ব্যর্থতার দায়ভারও নিজেরই নিতে হবে। তখন আর যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে বলে স্বস্তি পাবো না। যেটা আমার ভিতরে হতাশা তৈরি করে দিবে। এটা আরেক অশান্তি। প্রশান্তিটুকুই শুধু নিজের জন্য দরকার আমার।
সাহিত্যের ভিতরের যুক্তিটাকে গ্রহণ করতে হয় না, ভাবটাকে গ্রহণ করতে হয়। সাহিত্য ব্যাপারটাই এমন।
মানুষ যেটা ভুলতে চায়, সেটাই কেন যেন চিরস্থায়ী হয়ে মনে গেঁথে যায়। সেটাকে সর্বক্ষণ মনে নিয়েই বেঁচে থাকার অভ্যাস করতে হয়, ক্যান্সারের রোগী যেমন ক্যান্সারকেই জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেয়।
কায়নাদের অগাধ বিশ্বাস ছিলো মাঈশা একদিন ফিরবে তার কাছে। বিশ্বাস ভাঙাও যে আনন্দময় হতে পারে তা মাঈশা অনুভব করে।
কেন সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোই মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারে না?
১৩৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ার সময় মাঈশার জীবনের সাথে নিজের জীবনকে জড়িয়ে যে কতবার চোখের পানি মুছেছি, জানি না। তবে সেই চোখের পানির সমপরিমাণ হেসেছি ১৩৮ পৃষ্ঠায় পিয়াল আর রিয়াদের কথোপকথন পড়ে।
“ পিয়াল- বুঝছো, আমি জন্ম থেকেই ওর মতো একটা মেয়েকে খুঁজছি। ও হলো আমার স্বপ্নের রাজকন্যা, ওকে আমার লাগবেই।
রিয়াদ- আপনি জন্ম থেকেই মেয়ে খুঁজছেন? ”
বইয়ের অসংখ্য কবিতার মধ্যে থেকে আমার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছতে পারা কবিতা-
আমার চোখের নিচে জল,
আমার চোখের নিচে কালি।
নিরব সাক্ষী হয়ে থাক,
তুমি আমার চোখের বালি।
তোমায় উপড়ে ফেলা ব্রত,
তুমি যন্ত্রণার কারণ।
জপি ভোলার মন্ত্র রোজ,
তোমায় স্বপ্নে পোষা বারণ।
সামান্য নেতিবাচক আলোচনা:
উপন্যাসের প্রথম পর্বকে আমার মূল উপন্যাসের কাহিনি থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছে। ভেবেছিলাম, শেষে গিয়ে হয়তো কোনো মিলবন্ধন পাবো। কিন্তু পাইনি। এ কি আমার-ই উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা না কি লেখিকার অসতর্কতা- ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।
আমি নিজেও একজন কম বয়সী লেখক। নিজের প্রথম উপন্যাসের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমাদের বয়সীদের বই পড়তে অনেক সিনিয়র লেখক-পাঠকই দ্বিধায় ভোগেন। কারণ, বয়সকে তারা লেখনীর পরিপক্বতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমি এর সাথে সহমত-দ্বিমত কোনোটাই পোষণ করছি না। শুধু আন্তরিকভাবে অনুরোধ করছি, বয়সের বিবেচনায় অনভিজ্ঞ লেখকদের বইও পড়ুন অনুগ্রহপূর্বক। চিন্তার গভীরতা, লেখনীর দক্ষতা যে কখনো বয়স দিয়ে মাপা যায় না তা নবীন লেখিকা “মালিহা নামলাহ” আবারও প্রমাণ করে দিতে সমর্থ হয়েছেন। আপনাদের উৎসাহ, গঠনমূলক সমালোচনা-ই হয়তো বা একজন নবীন লেখককে আগামীতে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহয্য করবে।
বই: ছায়া মানবী
লেখক: মালিহা নামলাহ
প্রকাশক: কুহক কমিকস এন্ড পাবলিকেশন্স
প্রচ্ছদ: সানজিদা স্বর্ণা
প্রচ্ছদ মূল্য: ২৮০ টাকা
রকমারি লিঙ্ক: Click This Link
সবাইকে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২৪ ভোর ৪:৩০