
বিখ্যাত ফরাসি লেখক ভিক্টোর হুগো একবার বলেছিলেন, 'He who opens a school door, closes a prison'। তাঁর এই কথাটা বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবি উপন্যাসের মূল চরিত্র নিতাইচরণের ক্ষেত্রে বেশ ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়। নিতাইচরণের জন্ম হিন্দু সমাজের পতিততম স্তরের ডোম বংশে। তার বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষ চোর ডাকাতির ইতিহাসে (কু)খ্যাত। মামা গৌর বীরবংশী একজন নামকরা ডাকাত- বছর খানেক পূর্বেই নিজের কৃতকর্মের জন্য ৫বছরের শাস্তি ভোগ করে ফিরে এসে সে এখন নিতাইচরণের মাকে তাগাদা দিচ্ছে অতি সত্বর ছেলেকে বংশীয় কাজের ধারায় নিযুক্ত করার জন্য। এমনই কদর্য ইতিহাসযুক্ত পরিবার ও সমাজের সন্তান হয়েও নিতাইচরণ চোর কিংবা ডাকাত না হয়ে, হয়ে উঠলেন একজন প্রতিভাধর কবিয়াল। তার সেই কবিয়াল হয়ে ওঠা ও কবিয়াল হওয়ার পরবর্তী জীবনকাহিনি নিয়েই মূলত কবি উপন্যাসের আখ্যান। তো যাই হোক, নিতাইচরণ কেন কবিয়াল হলো, সেই উত্তর খুঁজতে গেলেই মি.হুগোর কথা চলে আসে।
শৈশবে স্থানীয় জমিদারের মায়ের স্মৃতিরক্ষার্থে প্রতিষ্ঠিত নৈশবিদ্যালয়ে গ্রামের আর সকল ডোম-সন্তানের সঙ্গে নিতাইও সেখানে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। তবে বছর শেষে একে একে সকলে বিদ্যালয় থেকে বিদায় নিলেও নিতাই সে কাজ করেনি, বরং টানা দুই বছর পড়াশোনার মধ্যে থাকায় তার নীতিচক্ষুর উন্মেলন হয়েছিল এবং জানার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই আগ্রহ থেকেই তার কবিগানের সাথে পরিচয় হয়; মনের মধ্যে ধীরে ধীরে কবিয়াল হওয়ার বাসনা পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। এ থেকে বোঝা যায় যে, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও শিক্ষার সাথে নিতাইয়ের যে মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল- সেটাই নিতাইকে তার সমাজের অন্যদের থেকে পৃথক করে তুলেছে। তার অভ্যন্তরীণ নীতিবোধ তাকে শিক্ষা দিয়েছে তার বংশীয় পেশার অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক সম্পর্কে। এজন্যই সে সেই পেশা গ্রহণ তো করেই না, বরং মা-মামার সাথে এক প্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করেই গ্রামান্তরে চলে যায়।
যে শিক্ষার বীজ নিতাইচরণকে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছিল, সে বীজ শুধু এ কাজ করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং নিতাইয়ের মনের কোনে লালিত হয়েছিল আজীবন। ফলস্বরূপ, উপন্যাসে নিতাইকে পাওয়া যায় একজন নীতিসচেতন, আদর্শপ্রিয়, সুক্ষ্মদর্শী মানুষ হিসেবে। কবিগানের ইতিহাস জানামাত্রই এ কথাও জানা যায় যে, একসময়ের কবিগানের যে উজ্জ্বল গৌরব-কাহিনি ছিল তা ইতিহাসের বাঁকবদলের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই স্তিমিত হয়ে এসেছিল। তখন কবিগানের অস্তিত্ব হিসেবে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই ছিল খিস্তি-খেউর আর অশ্লীলতা। কবিয়াল নিতাই হচ্ছে সে স্তিমিত সময়ের কবিয়াল। তবু্ও সে পুরাণ ঘেঁষা কবিগানের বাইরে খিস্তি-খেউর সংশ্লিষ্ট কবিগান কখনোই রচনা করতে পারেনি, যতদিন না দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে নেশাগ্রস্থ হয়ে সে ওমন ধারার গান রচনা করতে বাধ্য হয়। এমনই তীক্ষ্ম ছিল তার নীতিবোধ।
এছাড়াও ব্যক্তি নিতাইয়ের জীবনেও নীতি সংশ্লিষ্ট টানাপোড়েনের ছাপ দেখা যায়। কবিয়াল হওয়ার পরপরই সে প্রথমবারের মতো পরিচিত হয় প্রেমের স্নিগ্ধ অনুভূতির সঙ্গে। কিন্তু বিধি বাম, যার মায়ায় নিতাই এতো মুগ্ধ, যাকে সে তুলনা করে 'কাশফুলের উপর একটি স্বর্ণবিন্দু'র সাথে- সেই ঠাকুরঝি যে বিবাহিতা! তাই অনুভূতি গাঢ় রূপ পাওয়া শুরু করতে না করতেই সে ছেড়ে যায় তার অনেকদিনের আবাসস্থলকে- আদতে তার ঠাকুরঝিকে। তার এমন সিদ্ধান্তে ঠাকুরঝির প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে কিংবা তার নিজের মন কী চায় এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সমাজের সামনে ঠাকুরঝির মতো এক নারীর সম্মান রক্ষা করা। কেননা যে সমাজে তারা বসবাস করে, সে সমাজ পরকীয়ার দায়ে নিতাইকে হয়তোবা মাফ করলেও করতে পারে। কিন্তু ঠাকুরঝিকে তারা ক্ষমা করবে না কখনোই। তাই নিতাই যুদ্ধক্ষেত্রে ঠাকুরঝিকে একা রেখেই চলে যায় ঝুমুর দলের কাছে কবিয়াল হিসেবে জীবনের আরেকটি নতুন পর্ব শুরু করার উছিলায়। অনেক পাঠকের কাছেই নিতাইয়ের এমন সিদ্ধান্তকে পিঠ বাঁচানো কিংবা পালিয়ে যাওয়ার মতো কাপুরুষতা হিসেবে মনে হতে পারে। কিন্তু একটু ধৈর্য নিয়ে সার্বিক দিক চিন্তা করলেই হয়তো বুঝতে পারা যায় যে, এখানে তার ঠাকুরঝির মঙ্গল কামনা ব্যতীত আর কোনো মনোষ্কামনা ছিল না।
ঠাকুরঝিকে ত্যাগ করে ঝুমুর দলের সাথে যুক্ত হওয়ার পরে ধীরে ধীরে নিতাই আরেকটি নতুন আবেগঘন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সে দলেরই 'মুখপাত' স্বৈরিণী বসন্তের সাথে। বসন্ত এ ঝুমুর দলের আকর্ষণ। আসরে নিতাই গান গায়, বসন্ত নাচে- যেন তারা একে অপরের পরিপূরক এমনি করে সে আসর মাতিয়ে তোলে। আসরের বাইরেও তাদের অন্তরঙ্গতা ঈর্ষনীয়। নিতাই যেমন করে বসন্তকে ভালোবাসে, যত্ন করে- তেমন করে আর কোনো রূপোপজীবিনী তো দূর, কোনো সাধারণ স্ত্রী-লোকের ভাগ্যেও জোটে কিনা সে বিষয় তর্কযোগ্য। ঝুমুর দলের সে যাযাবর জীবনে তারা দুটিতে যেন এক ভালোবাসার সংসার পেতে বসে। শুধু সেই সংসারে ছেদ পড়ে, যে রাতে বসন্তের ঘরে অন্য কোনো পুরুষ আসে- কিংবা বসন্ত কোনো পুরুষকে আপ্যায়ন করতে বাধ্য হয় পেশাগত প্রয়োজনে। সে রাতে নিতাই চুপচাপ বেহালাদারের করুণ বাজনা শুনে নিরবে তার একই যন্ত্রণার সহমর্মী হয় কিংবা জীবন নিয়ে ভাবে। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মনে আনে না বসন্ত ব্যতীত অন্য কোনো নারীর সংস্পর্শে যাওয়ার চিন্তা। তাদের এ প্রেম কাহিনির অন্তভাগে বসন্তর বিদায় নেওয়ার সময় যখন চলে আসে, তখনও নিতাই বসন্তকে একইভাবে ভালোবাসে। তার মৃত্যুর পরও অবশিষ্ট ছাই হওয়া ভস্মিত বসন্তের পাশে নিতাই বসে থাকে চুপচাপ, একা একা।
এক জীবনে সত্যিকার অর্থে কয়জনকে ভালোবাসা যায়?- এ প্রশ্ন নিয়ে হয়তো তর্ক হতেই পারে। কিন্তু নিতাইয়ের ঠাকুরঝির প্রতি মায়া কিংবা বসন্তের প্রতি যত্ন- কোনোটাই প্রশ্নবিদ্ধযোগ্য নয়। সে যেন ভালোবাসাতেও বড্ড নীতিবান। যখন যাকে ভালোবাসে তাকে সে সত্যি সত্যি ভালোই-বাসে। শুধু নিয়তিই হয়তো তাকে স্থির হতে দেয় না কোথাও। হয়তো বা সে স্থির হবেও না কোনোদিন। কিন্তু তাই বলে কি অতীতের সব মিথ্যে? নাকি তার এই ভাগ্যই বাস্তবতা কিংবা সত্যিকারের জীবন? আমাকে প্রশ্ন করলে আমি নিতাইয়ের এই দ্বিচারিতাকে বাস্তবতা বলেই তাকে সব দায় থেকে মুক্তি দেব। কারণ এই বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হওয়াই হয়তো তাকে এক কালজয়ী উপন্যাসের কালজয়ী চরিত্র করে তুলেছে!
ছবি: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ৮:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



