শীতের কনকনে রাত। ঢাকার মিরপুর স্টেশনের কাছে শিরীষ গাছের ঘন ছায়ায় রাফি তার জীর্ণ রিকশার হ্যান্ডেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাত দুটোর ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে, পিছনের লাল আলোটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। যাত্রীরা সিঁড়ি দিয়ে নামছে, শীতের তীব্র ঠান্ডায় তাদের মুখ বিবর্ণ। অন্য রিকশাওয়ালারা ভিড় করলেও রাফি সেখানে গেল না। তার রুগ্ন শরীর, কাশির শব্দ যাত্রীদের ভয় পাইয়ে দেবে, সে জানে। তাই সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল, ছেঁড়া গামছায় কান ঢেকে, শীর্ণ হাত আস্তিনে লুকিয়ে। রুক্ষ কিন্তু বিনীত কণ্ঠে ডাকল, “আসেন স্যার, আসেন। এই দাস হাজির।”
কাশির ধমকটা চাপতে পারল না। এক যুবকের মুখে কেশে ফেলল। যুবকটা সরে গেল, অন্যরাও দূরে দাঁড়িয়ে রিকশা ডাকল। স্টেশন খালি হয়ে গেল। রাফি ভাবল, এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই। তার শরীর আর চোখ দেখলে যাত্রীরা অস্বস্তি পাবে। সে অন্ধকারে নেমে দাঁড়াল, কথা বলার চেষ্টা করল না। মনে মনে বলল, “নসিবে থাকলে জুটবে।” তার মৃতপ্রায় চোখ শীতের অন্ধকারে উজ্জ্বল করার চেষ্টা করল।
শিরীষ গাছের নিচে সে কাঁপছিল। শীত তার শরীরে শিশিরের মতো জমে যাচ্ছিল। “একটা সোয়ারী পেলে রিকশা টানলে শরীর গরম হবে,” সে ভাবল। কিন্তু কেউ এল না। দূরে গুলশানের গির্জার ঘণ্টা বাজল, কবরখানার ঝোপে জোনাকি জ্বলছিল। হঠাৎ এক নিঃসঙ্গ যাত্রীকে রিকশা খুঁজতে দেখে সে ডাকল, “আসেন স্যার, আসেন। এই দাস হাজির।” তবু অন্ধকার থেকে নড়ল না। তার শরীর দেখে যদি লোকটা ভয় পায়!
যাত্রীটি এগিয়ে এল। বৃদ্ধ, কোটরাগত চোখ, দামি শালে জড়ানো, পা খোঁড়া, হাতে লাঠি। রাফির মনে হল, এই লোকটাকে সে চেনে। বৃদ্ধ লাঠি ঘুরিয়ে রিকশায় উঠে বললেন, “কত লাগবে?” “একশ টাকা, স্যার,” রাফি বলল। “৫০ টাকা দেব,” বৃদ্ধ জবাব দিলেন। রাফি চুপ রইল, শুধু কাশতে থাকল।
রিকশা চলতে শুরু করল। মিরপুরের নির্জন রাস্তায় রিকশার ক্যাচক্যাচ শব্দ আর কাশির আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছিল না। বৃদ্ধ বললেন, “তোর নাম কী?” “রাফি, স্যার।” “কতদিন রিকশা টানছ?” “বহু দিন।”
পথে চেন পড়ে গেল। রাফি নেমে তুলল। বৃদ্ধ বিরক্ত হয়ে বললেন, “জলদি চালাও।” “ভয় পাবেন না, ঠিক পৌঁছে দেব,” রাফি বলল। তার শরীর কাঁপছিল, হাত-পা ঠকঠক করছিল। তবু টানতে লাগল।
তানিয়ার কথা মনে পড়ল। বনানীর বস্তিতে তার বউ অপেক্ষা করে। গতকাল তানিয়া বলেছিল, “একটা শাড়ি কিনে দাও। শীতে কষ্ট হয়।” রাফি ভেবেছিল, আজ সোয়ারী পেলে শাড়ি কিনবে, গরম ভাতে ইলিশ মাছ খাবে। কিন্তু তার শরীরে শক্তি নেই।
বৃদ্ধ বললেন, “গাড়ি চালাচ্ছ নাকি ঘুমাচ্ছ??” রাফি শেষ শক্তি দিয়ে টানল। “দুনিয়া বদলে গেছে, স্যার। আগে আমরা গরিবরা কষ্ট করতাম, এখনও করি।” “তোমাদেরই তো রাজত্ব,” বৃদ্ধ হাসলেন।
ধানমন্ডির কাছে টায়ার ফুটল। রাফি নেমে দেখল, আর টানা যাবে না। বৃদ্ধ চিৎকার করলেন, “এমন করলে পয়সা দেব না!” “একটু সবুর করেন, একটা গল্প বলি,” রাফি বলল। “কী গল্প?”
“আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ’৭১-এ যশোরের মাঠে লড়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা ধরে ফেলল, কিন্তু তিনি পালালেন। তারপর থেকে আমাদের নসিব খারাপ।”
বৃদ্ধ শুনলেন, কিন্তু মন দিলেন না। পকেট থেকে ৫০ টাকা দিয়ে বললেন, “নাও, চলি।” রাফি হাতে নিল, কিন্তু শরীর আর চলছিল না। হ্যান্ডেলে ঝুঁকে পড়ল। শীত তার শরীরে জমে যাচ্ছিল। চোখ সাদা হয়ে এল। তানিয়ার কথা ভাবল—তার শাড়ি, ইলিশ মাছ। কাশতে কাশতে মুখে রক্ত উঠল। সে গামছা দিয়ে মুছতে চাইল, কিন্তু হাত তুলতে পারল না। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল।
বৃদ্ধ নেমে লাঠি ঠুকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন, ভুলে একশ টাকা দিয়েছিলেন। আলো জ্বেলে দেখলেন, রাফি হ্যান্ডেলে ঝুলে আছে, শীতে জমে মৃত। টাকা তুলে নিয়ে অন্ধকারে মিশে গেলেন। দূরে যশোর রোডের শেষ ট্রেনের শব্দ মিলিয়ে গেল।
বনানীতে তানিয়া অপেক্ষা করছিল। রাত গভীর হল, রাফি ফিরল না। ভোরে খবর এল, রাফি রাস্তায় মারা গেছে। তানিয়া কাঁদল, তার শাড়ি আর ইলিশ মাছের স্বপ্ন অন্ধকারে হারিয়ে গেল।