somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

এমজেডএফ
পেশা ব্যবসা ও চাকরি। জ্ঞানভিত্তিক জীবনদর্শনে বিশ্বাসী। নির্জনে ও নীরবে প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ উপভোগ করতে ভালোবাসি। বই পড়তে, ভ্রমণ করতে, একলা চলতে এবং জটিল চরিত্রের মানুষ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করি। –এম. জেড. ফারুক

দেশ-বিদেশের আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব ৩ - হগম্যানায়

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিশ্বজুড়ে জমকালো আয়োজনে পালন করা হয় ইংরেজি নববর্ষ। থার্টিফার্স্ট নাইটে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে আনন্দে মেতে উঠে সবাই। বিভিন্ন দেশে ইংরেজি বর্ষবরণের আনন্দ ও আনুষ্ঠানিকতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিল থাকলেও অনেক দেশে অমিলও রয়েছে অনেক। কিছু কিছু দেশে আবার এ উৎসব ব্যাপক জাঁকজমকভাবে কয়েকদিন ব্যাপী পালন করা হয়। তেমনি একটি দেশ হচ্ছে স্কটল্যান্ড এবং এদের নতুন বছরের উদযাপনের স্কটিশ নাম 'হগম্যানায়' (Hogmanay)। স্কটল্যান্ডের লোকেরা এই উদযাপনটি বিভিন্ন রকমের কর্মসূচীর সমন্বয়ে তিন দিন ব্যাপী করে। উৎসবের কর্মসূচিগুলো পুরো স্কটল্যান্ড জুড়ে হয় ডিসেম্বরের শেষের দিন শুরু হয় এবং ২ জানুয়ারি শেষ হয়। বিশ্বের সব দেশে ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে একদিন (১ জানুয়ারি) সরকারি ছুটি হলেও স্কটল্যান্ডে দুইদিন (১ ও ২ জানুয়ারি) সরকারি ছুটি।

উৎস ও ইতিহাস
এই শব্দটি কোথা থেকে এসেছে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি, যদিও এটি ফরাসি শব্দ 'হোগিনে' যার অর্থ 'পার্বণ দিন' থেকে এসেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। ১৫৬১ সালে স্কটল্যান্ডের রানী মেরি ফ্রান্স থেকে স্কটল্যান্ডে ফিরে আসার পরে এটি সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বহু শত বছর পূর্বে পৌত্তলিক সময়ে স্কটল্যান্ডের লোকেরা ফসল কাটার শেষে বছরের সমাপ্তি ঘোষনার জন্য সমহাইন (Samhain) নামে একটি উৎসব পালন করত। পরবর্তীতে ক্যাথলিক ধর্ম যখন দেশের প্রধান ধর্ম হয়ে উঠল তখন এটি মিডউইন্টার ইউলে উৎসবে পরিণত হয়েছিল। এই উৎসবটি পালন করা হতো ১৭-২৫ ডিসেম্বর। লোকেরা পার্টিতে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করে, বহ্ন্যুৎসব উপভোগ করে এবং প্রতিবেশীদের সাথে সাক্ষাৎ করে এটি উদযাপন করত। দিনটি তখন সবার কাছে 'ডেফট দিন' (daft day) হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মিডউইন্টার ইউল দীর্ঘ সময়ের সংস্কারে পরবর্তীতে ক্রিসমাস উৎসবে পরিণত হয়। ১৫৬০ সালে খ্রিস্টান ধর্মের চর্চা কীভাবে করা উচিত তা নিয়ে প্রচুর যুক্তিতর্কের সৃষ্টি হলে ধর্ম ভিত্তিক উৎসবগুলো সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। ধর্মীয় চর্চার সংস্কারকারী ব্যক্তিরা ধর্মভিত্তিক উৎসবগুলোকে নিষিদ্ধ বা নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মত দেন। ফলে ১৬৪০ সালে পার্লামেন্ট আইন পাশের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিসমাস ছুটিকে বেআইনী ঘোষণা করে। তখন স্কটল্যান্ডবাসীরা শত শত বছর ধরে পালন করা এই উৎসবটি চালু রাখার জন্য নববর্ষের দিনকে বেছে নিলেন। যদিও ১৯৫৮ সালে আইনটি পরিবর্তন করে স্কটল্যান্ডে ক্রিসমাস একটি সরকারী ছুটিতে পরিণত হয়েছিল। এইভাবেই শত শত বছর আগের এই স্থানীয় উৎসবটি কালের বিবর্তনে ধর্মীয় লেবাস পরিত্যাগ করে স্কটল্যান্ডের সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

উৎসবের রীতিনীতি


হগম্যানায়ের সাথে পালন করা হয় জাতীয় এবং স্থানীয় উভয় প্রথা রয়েছে। স্কটল্যান্ড জুড়ে স্থানীয়ভাবে রীতিনীতির কিছু হেরফের থাকলেও বিশেষ করে পরিবারের সবাইকে উপহার দেওয়া, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া এবং নতুন বছরের প্রথম প্রহরে প্রথম অতিথির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্কটল্যান্ডে এ উৎসব শুরুর আগে সবাই নিজেদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে নতুন বছরের আগমনের প্রস্তুতি নেয়।

নববর্ষের প্রথম অতিথি (First-footing for friends and family)
সর্বাধিক বিস্তৃত জাতীয় আচারানুষ্ঠানটি হচ্ছে প্রথম পর্বের অনুশীলন, যা মধ্যরাতের পরপরই শুরু হয়। এর মধ্যে বন্ধু বা প্রতিবেশীর দ্বারে প্রথম ব্যক্তি হিসাবে উপস্থিত হওয়া এবং প্রতীকী কোনো উপহার প্রদান করা। বিশ্বাস করা হয় যে, নববর্ষের প্রথম মুহুর্তে যে মানুষ প্রথম বাড়িতে পা রাখে সে-ই ওই বছর বাড়ির সদস্যদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। তাই এই সময় তাকে ব্যাপক সমাদর করা হয়। তাকে তুষ্ট করতে পারলেই বছর খুব ভালো যাবে বলে মনে করা হয়। সাধারণত লম্বা-চওরা ও ঘন কালো চুলের অধিকারী পুরুষ মানুষকে প্রথম ফুট হিসাবে পছন্দ করা হয়। তবে ইদানিং সব ধরনের মানুষকে প্রথম ফুট হিসাবে পছন্দ করা হয়, যদি মানুষটি প্রিয়জনদের একজন হয় এবং হাতে ভালো ভালো উপহার থাকে। উপহারগুলি, তাদের নিজস্ব নির্দিষ্ট অর্থ সহ, শুভকামনার একটি চিহ্ন।



নববর্ষের গান (Joining hands for Auld Lang Syne)
মধ্যরাতে স্কটল্যান্ডের কবি রবার্ট বার্নস-এর লেখা বিখ্যাত কবিতা/গান 'Joining hands for Auld Lang Syne' গাওয়া স্কটল্যান্ডে একটি খুব প্রিয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে এবং এটি হগম্যানায় উদযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঘড়িতে যখন মধ্যরাত পেরিয়ে নতুন বর্ষের আগমনী ঘন্টা বেজে উঠে, সেই মুহূর্তে আউল্ড ল্যাং সিনের শব্দগুলি স্কটল্যান্ড জুড়ে অনুরণিত হয়। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য দেশ কর্তৃক গৃহীত নববর্ষের একটি ঐতিহ্য স্কটিশ বার্ড রবার্ট বার্নসের এই গানটি। গায়করা বড় বা ছোট একটি বৃত্ত তৈরি করে হাতে হাত মিলিয়ে কোরাসে গানেটি গাইতে থাকে। গানটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই হাতগুলি ধরে রেখে বৃত্তের মাঝখানে ছুটে যায়।

বাড়ি-ঘর পবিত্র করা (Saining the house)
বাড়ি ও পশুপালনের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করাও এই উৎসবের একটি অংশ। আগেরকার দিনের কৃষিভিত্তিক সমাজে এটির প্রচলিত ছিল বেশি। তবে এখনও অনেক পরিবারে এই প্রথাটি প্রচলিত রয়েছে। জাদু বলে বিশ্বাস করা বিশেষ জল (পানিপড়া) বাড়িতে এবং পরিবারের সমস্ত সামগ্রী জুড়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এরপরে ধোঁয়ায় ঘর ভরাট করার জন্য জুনিপার শাখাগুলি পোড়ানো শুরু হয় যা বিশ্বাস করা হয় যে এটি ঘর পরিষ্কার করে এবং মন্দ আত্মাকে দূরে সরিয়ে দেয়। এরপরে, দরজা, জানালা এবং ভেন্টিলেটর নববর্ষের বাতাস প্রবেশ করার জন্য খোলা হয় এবং হৃৎপিণ্ডকে সচল রাখার প্রতিক হিসাবে সকালে প্রাতঃরাশের আগে সামান্য পরিমাণে হুইস্কি পান করা হয়।


এডিনবার্গে ভাইকিং-এর পোশাকে সজ্জিত হয়ে মশাল মিছিলের দৃশ্য

বহ্নিৎসব ও আতশবাজি (Bonfires and fire-work)
হোগম্যানয়ের উৎসবে আগুনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং একে প্রাক-খ্রিস্টান সেল্টসের পৌত্তলিক ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। এই ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এডিনবার্গে টর্চলাইট শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। সহস্রাধিক মানুষ অগ্নিশিখায় প্রজ্জ্বলিত মশাল বহন করে এডিনবার্গ শহরের কেন্দ্রস্থলের মধ্য দিয়ে শোভাযাত্রা করে। স্কটল্যান্ডের ঘাগরা পরিহিত পুরুষরা দু'ফুট অবধি প্রশস্ত আগুনের বল মধ্যরাতে মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাজপথে শোভাযাত্রা করে।

স্কটল্যান্ডের এই উৎসবে মানুষ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এমন কি প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবং সবাই সবাইকে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করে। এক কথায় অনেকটা আমাদের দেশের ঈদুল ফিতর উৎসবের মতো। এডিনবার্গে এখন যে নববর্ষ উৎসব (হগম্যানায়) হয় তা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নববর্ষ উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। চার দিনব্যাপী চলা এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে মানুষ আসে।



ছবি ও তথ্যসূত্র:
১। BBC
২। Wikipedia
৩। Culture Trip

◄ আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব ২ - ক্র্যাম্পাস   |   আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব ৪ : রণ উৎসব ►
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ভোর ৪:০৩
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×