উন্নত বিশ্বের মানুষেরা যে অনেক ক্ষেত্রেই বেশ উন্নতি অর্জন করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবে পারিবারিক বন্ধন উপেক্ষা করে দৈহিক-তৃপ্তিলাভের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়ায় এবং বাঁকা পথ অবলম্বন করার কারণে তারা মরণব্যাধি 'এইডস্' এর কবলে পড়ে দিশেহারা প্রায়। বর্তমানে এটি উন্নত, অনুন্নত সব দেশেই কম-বেশী ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশটিও এ তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যে এই রোগটি মহামারির আকার ধারণ করে একটি দেশ বা জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে সে সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ আশংকা প্রকাশ করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই। এর হাত থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরন্তর গবেষণা চলছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় বিশ্ব মানচিত্রের যে সমস্ত অঞ্চলের মানুষেরা ফ্রি-সেক্স অর্থাৎ বন্ধনহীন অবাধ যৌন জীবনে যত বেশী অভ্যস্ত, সে সমস্ত অঞ্চলের মানুষের মাঝে এই ভাইরাসের প্রবাহও তত বেশী। ভবিষ্যতে এই (HIV) ভাইরাসকে সম্পূর্ন নির্মূল করার মত আরও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষকৃত হোক সে কামনা সবারই।
'এইডস্' এর মূল কারণ এই HIV নামক ভাইরাসটিকে সম্পূর্নরূপে নির্মূল করার মত কোন ওষুধ এখনও আবিষকৃত হয়নি। তবে অগত্যা এ থেকে বাঁচার বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে। নিম্নে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল-
*'সেফার-সেক্স' অর্থাৎ যৌন মিলনের সময় কন্ডম ব্যবহারের মাধ্যমে যান্ত্রিক বাধা সৃষ্টি করে ভাইরাসকে আটকানোর বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।
*রক্ত-সংস্পর্শের মাধ্যমে এইডস্ ছাড়াও হেপাটাইটিস-বি ও সি এবং আরও অনেক জানা অজানা প্রাণঘাতি রোগ সংক্রমিত হয় এবং মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। কিছু খেলে তা পাকস্থলিতে গিয়ে পরিপাক হয়। অতঃপর এর সারাংশ রক্তের মাধ্যমে শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। কিন্তু যখন কোন কিছু মাংসে বা ধমনীতে বা শিরায় প্রবেশ করানো হয় তখন তা সরাসরি রক্তের মাধ্যমে মুখে খাওয়ার তুলনায় দ্রুত ও সহজেই শরীরের সর্বত্র পরিচালিত হয়। এভাবে রক্তের মাধ্যমে জানা ও অজানা বিভিন্ন রোগের জীবাণু একজনের দেহ থেকে খুব সহজেই অন্যের দেহে প্রবেশ করতে পারে। রক্ত সংস্পর্শের ব্যপারে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য এখন চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিস্পোসিবল্-সিরিঞ্জ ব্যবহৃত হচ্ছে। একজনের ব্যবহৃত ছুঁচ (Needle) যেন অন্যের দেহের সংস্পর্শে না আসে সেজন্য সেমিনার, ব্যানার, পোষ্টার ও লেখালেখির মাধ্যমে জনগনকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। উন্নত ও ধনী দেশগুলোতে ব্লাড-ট্রান্সফিউশনের সময় রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষার ও ডিস্পোসেবেল সিরিঞ্জ ব্যবহারের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকায় এ পথে সংক্রমণের বিষয়টি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যয়বহুল তথা অপর্যাপ্ত হওয়ায় এ পথে সংক্রমণের বিষয়টি এখনও অনেকটাই ঝুকিপূর্ণ রয়ে গেছে। সুতরাং পরীক্ষা পদ্ধতি সহজলভ্য ও ডিস্পোসেবেল সিরিঞ্জ পর্যাপ্তভাবে সরবরাহ করার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য-সংস্থা সহ প্রতিটি দেশের সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়কে অগ্রণী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সেইসাথে স্বাস্থ্য-সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগুলোর সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহারের বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসক সহ সকল স্বাস্থ-সেবা কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
*মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে দুর্বলভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাই গুরুতর অসুস্থ ও দুর্বল কোন রোগীর জীবন রক্ষার্থে যদি কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেই রোগীর শরীরে রক্ত সরবরাহ অর্থাৎ ব্লাড-ট্রান্সফিউশন করা অত্যন্ত জরুরী বলে পরামর্শ দেন, তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই চেনা-জানা, সুস্থ-সবল ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে যথাসম্ভব পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে।
*'HIV' আক্রান্তদের মাড়ির ক্ষত হতে নিঃসৃত রস মিশ্রিত লালা ও দেহের ক্ষত হতে নিঃসৃত রসের মাধ্যমেও এ ভাইরাস ছড়ানোর কিছুটা সম্ভাবনা থাকে। তাই তাদের সাথে নিবিঢ়ভাবে চুম্বন ও দৈহিক মিলন থেকে বিরত থাকা উচিত। কোন এইচআইভি+ ব্যক্তির মাড়ির ক্ষত হতে নিঃসৃত রস মিশ্রিত লালা কোন কারণে অন্য কোন ব্যক্তির দেহের চামড়া বা মুখের ভিতরের উন্মুক্ত ক্ষতের মাধ্যমে সেই ব্যক্তির দেহরস বা রক্তের সংস্পর্শে আসলে ভাইরাসটি তার দেহে সংক্রমিত হতে পারে। যেমন নিবিঢ়ভাবে চুম্বনের সময় এইচআইভি+ স্ত্রী/পুরুষ-এর লালার মাধ্যমে অন্য একজন স্ত্রী/পুরুষের মুখের ভিতরের যে কোন ক্ষত অর্থাৎ জিহ্বার ক্ষত বা দাঁতের মাড়ির ক্ষত দিয়ে এই ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু খাবার সময় লালা সাধারনত আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের অভ্যন্তরে থাকে। সরাসরি অন্য কারো দেহরস বা রক্তের সংস্পর্শে আসে না। কদাচিত সামান্য পরিমাণ লালা খাদ্যের সাথে মিশলেও তাতে যে পরিমাণ ভাইরাস থাকে তা বাহিরের পরিবেশের সংস্পর্শে আসার ফলে অন্যকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাই এইডস রোগির সাথে একই পাত্রে খাবার খেলে 'এইচআইভি' ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না।
*সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আক্রান্ত মা হতে সন্তানের দেহে যেন ভাইরাসটি সংক্রামিত হতে না পারে সে বিষয়ে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
*আক্রান্ত মায়ের মাতৃদুগ্ধ দ্বারাও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে, তাই শিশুদেরকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর বিষয়েও সাবধান হতে হবে।
*অবাধ যৌনাচার অর্থাৎ ব্যভিচার, জেনা, সমকামিতা ইত্যাদি মানুষের রুচির বিকৃতি সাধন করে এবং এর মাধ্যমে সমাজের মধ্যে সিফিলিস, গণরিয়া, এইডস্ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের নোংরা ও প্রাণঘাতি রোগের বিস্তার ঘটে। অনেক সময় চিকিৎসা করার পরও এ সমস্ত রোগের খারাপ প্রতিক্রিয়া বা স্থায়ী ক্ষতি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন হয় এবং ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুমুখে পতিত হতে হয়। এমনকি পিতা ও মাতার মাধ্যমে এ রোগগুলো নিষ্পাপ সন্তান-সন্ততির মাঝেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি যেহেতু শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক অবন্থার সঙ্গে জড়িত। তাই শুধুমাত্র যৌন-শিক্ষা ও ওষুধ বা যান্ত্রিক কোন ব্যবস্থার উপর নির্ভর করলে এ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে না। ভাল ফল পেতে হলে পারিবারিক সুসম্পর্কের বন্ধন রচনার পাশাপাশি ধর্মীয়, সামাজিক তথা পারিবারিক অনুশাসনকে উপেক্ষা না করে যথাযথভাবে মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
*সমপ্রতি এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, খাৎনা করা পুরুষদের যৌনবাহিত 'এইচ.আই.ভি' ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম। গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী বাল্টিমোরের জন- হপকিনস্ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ থমাস কুইন, গষেকদের 'এইডস্' সংক্রান্ত এক সম্মেলনে বলেন, "বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির পুরুষদেরকে নিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে খাৎনাকারী কোন পুরুষের 'এইচ.আই.ভি' সংক্রমণ ঘটেনি।" খাঁটি ধর্মীয় বিধান 'এইডস্' প্রতিরোধে ও জানা অজানা অনেক জটিল রোগ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য যে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, মূলত সে বিষয়টি এখানে ফুটে উঠেছে।
এই মরণ-ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে একদিকে যেমন যারা 'HIV+' এবং বিশেষ করে যে সমস্ত শিশু 'HIV+' অবস্থায় জন্ম নেয় তাদের পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং AIDS রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে তাদের জন্য সুচিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। অপরদিকে তেমনি রুচিশীল ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে ধর্ম. বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে অবৈধ অবাধ যৌন সম্পর্ক, সমকামিতা ও মাদক গ্রহণের মত অস্বাভাবিক কর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে। সেইসাথে বিবাহিত জীবনের মধুর ও সংরক্ষিত বন্ধনে আবদ্ধ থেকে 'এইডস' প্রতিরোধের পথকে সহজ ও কার্যকর করে তুলতে হবে।
এখানে দেখুন- এইডস প্রতিরোধে আল-কোরআনের বিধান-(১ম পর্ব)