(সময়: ২৩শে আগষ্ট১৯৭১)
(ক্যাপ্টেন মাহি, সহঃ ক্যাপ্টেন ঈভান সহ আরো এগারো জন)
ক্যাপ্টেন : সবাই রেডি থাকো, আজকেই আমরা অপারেশনে নামবো, এ অপারেশন হবে দুই অংশে। প্রথম অংশ হবে কিছুটা সন্মুখ যুদ্ধের মতো। আর বাকী অংশে হবে গেরিলা যুদ্ধের মতো। আমরা এতদিন ধরে যে প্রস্তুতি নিয়েছি আজকের দিনটির জন্যই।
ক্যাপ্টেনঃ ঈভান আমরা কত জন টিমে আছি এই মূহুর্তে।
ঈভানঃ আমরা ১৩(তেরো) জন আছি।
ক্যাপ্টেনঃ হ্যা, তুমিসহ তোমরা ছয়জন নেতৃত্ব দিবে শেষের অংশের, তোমরা বনের ভিতরে থাকবে, তোমাদের এই অংশ হবে গেরিলা যুদ্ধের মত। আমি আর বাকি ছয়জন যাবো মহাসড়কে সন্মুখ যুদ্ধে। ওদের আক্রমন করে এইদিকে নিয়ে আসবো, তখন তোমরা আমাদের সাথে মিলিত হবে।
ঈভানঃ এ অসম্ভব, আপনি এতো বড় ঝুঁকি নিতে পারেন না। সবাইকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে আমি বনের মধ্যে বসে থাকতে পারবো না। তাছাড়া বিশ্বরোডে থাকবে বড় বড় ট্যাংক এবং পাকিস্তানি আর্মিদের জীপ, সাথে আধুনিক অস্ত্র।
ক্যাপ্টেনঃ তোমার এই ভ্রাতৃত্বপ্রেম এবং দেশপ্রেমের জন্যই তোমাকে এই অংশের সহকারী ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। যাতে আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি দলকে আগলে রাখতে পারো। যা বলছিলাম, আমরা পাকিস্তানী আর্মিদের উপর অতর্কিতে হামলা চালাব এবং পালিয়ে এই বনের দিকে ওদের নিয়ে আসবো। ওরা আমাদের দাওয়া করতে করতে বনের দিকে আসবে। আর এর মাঝে লুকিয়ে থাকবে তোমার টিম। মনে রাখবে ওদের কিন্তু গাড়ী ছাড়াই বনের দিকে আসতে হবে। সুতরাং ভয় পাবার কোন কারন নেই। আমাদের হামলার সাথে সাথে তোমরাও যোগ দিবে।
ইভানঃ হুম।। তোমরা সবাই কি বলো?
সবাই সমস্বরে হুংকার দিয়ে উঠলো- আমরা সবাই রাজি।
.
২৩শে আগষ্ট সন্ধ্যা ৭টা, আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। দিনের শেষের সোনালী আলোর আভা রয়ে গেছে তখনো। ক্যাপ্টেন চলেছে তার বাকি ছয় সদস্য নিয়ে বিশ্বরোডের দিকে। প্রত্যেকের হাতে হালকা মেশিনগান ও ম্যাগাজিন এবং অল্প কিছু বোমা। এগিয়ে চলেছে পুরো টীম, বুকে অদম্য সাহস আর দেশের জন্য অপরিসীম ভালোবাসা নিয়ে।
বিশ্বরোডের কাছে ওরা থেমে গেলো, রাস্তার দুপাশে তাকিয়ে সামনে এগোতে লাগলো। সামনে দিয়ে দুটো পাকিস্তানি আর্মি জীপ চলে যাচ্ছে, সবার চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো, ক্যাপ্টেন বুঝতে পেরে সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, এখনো সময় আসে নি, এখানে কিছুক্ষন পরপরই জীপগুলো আসা যাওয়া করতে থাকে।
ক্যাপ্টেন সবাইকে নিয়ে গাড়ীর হেডলাইটের আলো এড়িয়ে রাস্তার এক পাশে গাছের আড়ালে নিচু হয়ে অবস্থান করলেন।ক্যাপ্টেন বললেন বুলেট মিস করা যাবে না, এখানেই ওদের কয়েকটার লাশ চাই।
চারিদিকে সুনসান নিরবতা, সময় যত যাচ্ছে চাঁদের রুপালী আলো তত বাড়ছে। হায়েনাদের অপেক্ষায় কিছু উৎসুক চোখ, হঠাৎ হঠাৎ হেডলাইটের আলোর ঝলকানি হৃদপিন্ডের স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়।
হঠাৎ ক্যাপ্টেন সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিল, অদূরেই পাকিস্তানী তিনটি জীপ আসছে। না আশে পাশে আপাতত ট্যাংক দেখা যাচ্ছে না। এইতো সুযোগ, সবার চোখ আবার জ্বলে উঠলো, আঙুল চলে গেলো ট্রীগারে। মূহুর্তেই কয়েক রাউন্ড গুলি ভেদ করলো কয়েকজন পাকিস্তানী আর্মীদের বুক, মাথা। হঠাৎ আক্রমণে পাকিস্তানী আর্মিরা দিশেহারা হয়ে পড়লো। ক্যাপ্টেন সবাইকে পিছু হটবার নির্দেশ দিল। সবাইকে আগলে ক্যাপ্টেন গুলি করতে করতে পিছু হটছে। তারাও পাল্টা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে এগুতে লাগলো। ওরা সংখ্যায় অনেক বেশি, ক্যাপ্টেন সবাইকে দ্রুত বনের ভিতরের দিকে যেতে বললেন। যেখানে সহকারী ক্যাপ্টেন ঈভান ওঁতপেতে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটছে উদ্দেশ্য পাকিস্তানী এই টীমকে বনের কাছে নিয়ে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের মাধমে পুরো ধ্বংস করে দেওয়া। ক্যাপ্টেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গুলি ছুড়ছেন আর পিছু হটছেন।
এই সময় অন্যদের গুলি করতে বারণ করে দিয়েছিলেন। বনের ভিতরে ঢুকে গেছে মুক্তিযোদ্ধারা, পাকিস্তানি আর্মিরা দ্বিধান্বিত ভিতরে প্রবেশ করবে কিনা? তারা দাঁড়িয়ে পড়লো। এই সুযোগেই সহ ক্যাপ্টেন ইভান তার ও দল ক্যাপ্টেন এর দলের সাথে মিশে গেলো। এবার মুক্তিযোদ্ধারা পুরো দল একসাথে পাকিস্তানি হায়েনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। অতর্কিত আক্রমণ যে এত ভয়াবহ হবে ওরা বুঝতে পারে নাই। দুপক্ষ থেকে গুলি বিনিময় হচ্ছে। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা হয়ে পড়লো, তাদের গুলি কমে আসছিলো। ক্যাপ্টেন বুঝতে পারলেন বিপদ আসন্ন, ওদের যতই মারছিলেন ওদের সংখ্যা তত বাড়ছিলো। ক্যাপ্টেন কৌশলে পাকিস্তানি আর্মিদের দিকভ্রান্ত করতে বোমা হাতে তুলে নিলেন কারন ওদের সংখ্যাটা অনেক বেশি এবং তাদের ছত্রভঙ্গ করাটা জুরুরী। চাঁদের আলোয় গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন, বোমা নিক্ষেপ করা শুরু করলেন। এইবার ওদের কেউ পালিয়ে যেতে লাগলো, কেউ কেউ আহত হতে লাগলো। কিন্ত অনেকেই গুলি চালিয়ে যাচ্ছে তখনো। হঠাৎ শত্রুসেনাদের দিক থেকে আসা গুলি ক্যাপ্টেনের বুক ঝাঁঝরা করে দিলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন। সহকারী ক্যাপ্টেন ঈভান দৌড়ে আসতে লাগলেন। না আসবে না, ক্যাপ্টেন চিৎকার করে ঈভানকে নির্দেশ দিলেন লড়াই চালিয়ে যাবার। ক্যাপ্টেনের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। এই পানি তাঁর বাংলাদেশকে দেখে যেতে না পারার পানি, সহ-সঙ্গীদের একা ফেলে যাওয়ার পানি। মূহুর্তেই প্রিয়কিছু মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তারমধ্যে ক্যাপ্টেন ঈভান অন্যতম। ক্যাপ্টেন ইভান তখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো ক্যাপ্টেন মাহীর নির্দেশে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১৫