যুদ্ধপরাধীদের বিচার, তত্তাবধায়ক সরকার, সাগর- রুনি হত্যার বিচার, বিশ্বজিত হত্যার বিচার, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, পুলিশ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, বিডিআর বিদ্রোহে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যা, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক মানুষ হত্যা, জিনিসপত্রের সীমাহিন মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণ সোচ্চার ছিল। কিন্তু কোন কিছুতেই জনগণ সেই রকম সোচ্চার হয়ে মাঠে নামেনি। কোন কোন ইস্যুতে মাঠে নামলেও সরকারের নির্মম দমন পীড়নে কেউ আর সাহস করে এগোয়নি।
যুদ্ধপরাধ ইস্যুটি নিঃসন্দেহে অনেক বড় ইস্যু, এটি আমাদের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। আমরা নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতা দেখিনি কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পর সেই যুদ্ধপরাধীদের বিচার হচ্ছে দেখে সত্যিই আনন্দিত এবং শিহরিত। আমাদের বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে অনেক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখার জন্য। এইজন্য হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ দিতে গিয়েও শেষপর্যন্ত দিতে পারলাম না। এটা আমার বা আমাদের কৃপণতা নয়। যে বিচার দেখার জন্য জাতি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করল শেষ পর্যন্ত হাসিনা সরকার আমাদেরকে হতাশ করল। হতাশার কারনগুলোঃ
১) সরকার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করল সরকারের সাথে বিশেষ চুক্তির ভিত্তিতে?
২) আবুল কালাম আজাদের মামলা পরে শুরু হলেও রায় দিল সবার আগে, অথচ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অভিযুক্তদের মামলা এখনো শেষ করতে পারেনি।
৩) আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তেমন না থাকলেও উনাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে, অথচ ট্রাইবুনাল কর্তৃক অনেক খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে! যদিও কাদের মোল্লার আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন কোন অভিযোগেরই সাক্ষ্যপ্রমান সরকার হাজির করতে পারেনি।
৪) সরকারের মন্ত্রীরা আদালতের রায়ের আগেই রায়ের দিন তারিখ বলে দিচ্ছেন এবং কার কি শাস্তি হতে হবে তাও বলে দিচ্ছেন, এটা তো বিচার প্রক্রিয়াকে প্রস্নবিদ্ধ করছে।
৫) আব্দুল কাদের মোল্লা সাহেবের রায় ঘোষনা হওয়ার পর জামাত-শিবির রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে (রায় প্রহসনের হয়েছে বলে তাদের দাবী), আবার শাহবাগে অনলাইন ও ফেসবুক এক্টিবিস্টরা আন্দোলন করছে ফাঁসির দাবীতে। এখানে মজার ব্যাপার হচ্ছে, জামাত-শিবির রায়ের বিরোধিতা করায় সরকারের নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের ৯ জন নেতা কর্মী মারা গেছেন পুলিশ ও ছাত্রলীগের হাতে। আর শাহবাগের আন্দোলনকারিরা রায়ের বিরোধিতা করায় সরকার তাদের সমর্থন করেছে। তাহলে কি এই ট্রাইবুনালের বিচার সরকার কর্তৃক প্রভাবিত হলো না?
৬)আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আওয়ামীলীগের মাঝে থাকা রাজাকার ও যুদ্ধপরাধিদের সরকার বিচারের আওতায় আনেননি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকি, সাংবাদিক আবুল মকসুদ সহ অনেক রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবিরাই বার বার একথা বলেছেন। তাহলে বিচারের নামে সরকার আসলে কি করতে চাচ্ছে?
৭) খবর বেরিয়েছে সরকার জামাতের সাথে গোপন আতাতের চেষ্টা করছে। তারই ধারাবাহিকতায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির রায় না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে যাতে জামাতের সমর্থন নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে পারলে সাজা কমিয়ে বা তাদের ক্ষমা করে দিতে পারে।
৮) শাহবাগের আন্দোলন কারিদের মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধপরাধিদের বিচার। কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি আওয়ামীলীগ নেতারা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিস, ভিন্ন মতাদর্শের পত্রিকা, ব্যবসায়িক প্রতিস্টানে হামলার ঘোষণা দেন তবে তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে বিবেক সম্পন্ন কোন মানুষের অসুবিধা হওয়ার কথা না। শাহবাগের আন্দোলন কি তাহলে সরকার কর্তৃক হাইজ্যাক হয়েছে? যদি না হয় তাহলে কেন আওয়ামীলীগ নেতাদের বক্তৃতা দিতে না দেওয়ায় অগ্নিকন্যা (বামপন্থী ছাত্রনেত্রী) লাকীকে ছাত্রলীগ নেতারা আঘাত করেছে?
আমরা যদি সত্যিই যুদ্ধপরাধিদের বিচার চাই তবে সচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষভাবে দলমত নির্বিশেষে সকল যুদ্ধপরাধিদের বিচার করতে হবে। কিন্তু বিচারের নামে রাজনৈতিক ফায়দা লুটা এবং ইস্যু টিকে জিইয়ে রেখে যারা দীর্ঘদিন রাজনীতি করতে চান তাদের পরিণতি ভালো হবে না।
আমরা নতুন প্রজন্ম যে কোন মূল্যে যুদ্ধপরাধিদের বিচার চাই। তবে এজন্য গৃহযুদ্ধের উষ্কানি দিয়ে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য।