১.
"কঙ্কার বাপ, এই কেইলডা বন্ধ কইরা নতুন কেইল ছাইড়া দিয়া আয়, ভাই।"
মুলিবাঁশের টানা কলের ভেতরে পিস্টন টানতে টানতে কুঁজো শরীরটাকে সোজা করার চেষ্টা করতে করতে বলেন সোনাতন বানু। বাঁশের কলে যথেষ্ঠ জোরালো নয় বায়ুর চাপ, আজকাল তাই দ্রুতই কুঁজো হয়ে উঠছেন তিনি। পাওয়ার পাম্প কিংবা নিদেনপক্ষে প্লাস্টিকের টানা কলের টাকা থাকলে আরো কিছুদিন ঋজু থাকত তার শরীর।
চোখ জুড়ানো সবুজ মরিচ ক্ষেত, বেশ অনেকগুলি সারিতে ভাগ করা, যাকে বলা হয় কেইল। প্রতিটি কেইলের দু'ভাগ খানিকটা উঁচু যাতে সেঁচের পানি কেইলের ভেতর আবদ্ধ থাকে। কেইলগুলির একদিকের ধার বরাবর তৈরি করা হয়েছে ছোট্ট নালা, কল থেকে পড়ে সেটি ধরে অগ্রসর হয় পানির প্রবাহ। নালার এক কোণে কল, টানছেন সোনাতন বানু, আর কঙ্কার বাপের কাজ হচ্ছে মরিচ ক্ষেতে দাঁড়িয়ে কেইলের মধ্যে পানির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা। কেইলের শেষ প্রান্তে পানি পৌঁছার খানিকটা আগেই কেইল বন্ধ করে নতুন কেইলের মুখ খুলে দিতে হবে তাকে। সূক্ষ্মভাবে কাজটি করার অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই অর্জন করেছে পাঁচ বছরের কঙ্কার বাপ, এমনভাবে কেইল বন্ধ করে সে যাতে পুরো কেইলই পানি পায়, কিন্তু পাশের জমিতে গড়িয়ে পড়ে না পানি।
ঘাসফড়িঙের পেছনে ছুটতে ছুটতে ভুট্টা ক্ষেতে ঢুকে পড়েছিল কঙ্কার বাপ। দাদীর ডাক শুনে যেই না ফিরে আসবে, শুনতে পেল লঞ্চের ভেঁপু; গঞ্জের লঞ্চ ভিড়েছে মেঘনার ঘাটে। কেইলের কথা ভুলে তুফানবেগে ভোঁ দৌঁড় দিল কঙ্কার বাপ, এ লঞ্চেই তার কাকা ফরিদ আসবে আজ। ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে ফরিদ, তার জন্য নতুন জামা আর রঙিন চশমা আনবে। কালকে রোজার ঈদ।
একে একে লঞ্চ থেকে নামে যাত্রীরা। শেষ যাত্রী হিসেবে রঙবেরঙের আংটি ও ঘড়ি হাতে, গলায় চেইন পড়া, বাবরি চুলের সিটার [প্রতারক] কফিলও নেমে পড়ে লঞ্চ থেকে, কিন্তু ফরিদের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। লঞ্চটি ঘাট থেকে না ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে কঙ্কার বাপ, তারপর হাঁটা ধরে মরিচ ক্ষেতের দিকে। গতি বেশ মন্থর তার, মাথাটা সামান্য ঝুঁকে আছে নিচের দিকে।
সোনাতন বিবি এদিকে পড়েছেন সমস্যায়। কঙ্কার বাপ চলে গেলে নিজেই কেইল বন্ধ করতে গিয়েছিলেন তিনি, ফলে নালার মধ্যে জলের প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে গেছে। নতুন করে আবার বেগ বাড়াতে হবে জলের। কাজটি করতে গিয়ে টের পেলেন বাঁশের চোঙায় বায়ুর চাপও নষ্ট হয়ে গেছে, পানি উঠছে না আর। কঙ্কার বাপ কাছে এসে চোঙায় পানি ঢালতে লাগল অল্প করে, পিস্টন টানতে লাগলেন সোনাতন বিবি। বেশ অনেকক্ষণ পর আবার শুরু হলো প্রবাহ।
সোয়া ঘন্টা পর আবারও ভেঁপু, কঙ্কার বাপের আবার দৌঁড়। এবার লঞ্চ থেকে নামল চৌধুরীদের সুন্দরী নতুন বউটি, অনেক মাল-সামানা তার, নামতে অনেকক্ষণ লাগল তার। না, এ লঞ্চেও আসেনি ফরিদ! বুক ঠেলে আসা কান্নার বেগ রুখতে ঠোঁট চেপে অনেক কষ্ট করতে হয় কঙ্কার বাপকে, বুকের উপর থুতনি ঝুলে পড়ে পাঁচ বছরের বালকটির।
এভাবেই কেটে যায় আরো কয়েক ঘন্টা। ম্লান অপরাহ্নে মরিচ ক্ষেতে পানি দেয়ার কাজ শেষ হয় যখন, শেষ লঞ্চটিও চলে গেছে ততোক্ষণে। পাশাপাশি বাড়ি ফিরতে থাকে দুই জন কুঁজো মানুষ, দুই প্রজন্মের। সূর্যের আলোয় তাদের কুঁজো ছায়া দীর্ঘতর হতে থাকে।
২.
গভীর রাত। সাদা কুয়াশার চাদর ঢেকে রেখেছে সারা গাঁ, শীত রয়ে গেছে এখনও। পাটখড়ির বেড়ার ফাঁক দিয়ে কনকনে হাওয়া ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর, নাড়িয়ে দিয়ে যায় ঘুমন্ত মানুষগুলির শরীর।
সোনাতন বিবির পাশে তার মেয়ে জমিলা। মাত্র কিছু দিন আগে বিয়ে হয়েছে তার, কিন্তু কুড়ি হাজার টাকার জন্য বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে জামাই। উচ্ছ্বল মেয়েটি আজকাল তেমন কথা বলে না কারো সাথে। কবে যে টাকা জোগাড় হবে, কবে আবার শ্বশুর বাড়িতে যেতে পারবে, কে জানে?
দমকা হাওয়া বয়। মানুষের মতো গোঙানির আওয়াজ আসে গরুর খোঁয়ার থেকে। লালী গাভীটার উরুতে পচন ধরেছে, চৌধুরীদের ক্ষেতের ধান খেয়ে ফেলায় শিকের খোঁচা খেয়েছিল সে। মরণ ঘনিয়ে এসেছে তার, সবাই জবাই করে ফেলার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু বাধ সাধে সোনাতন বিবির বড় ছেলে রহিম। বোকাসোকা রহিম, হালচাষ করতে পাচন দিয়ে মারত যে গরুটিকে, তার জন্যই এখন রুখে দাঁড়িয়েছে সবার বিরুদ্ধে। বোবা প্রাণীর গোঙানির ফাঁকে ফাঁকে তারও কান্না ভেসে আসে বারান্দার ঘর থেকে।
রহিম মানুষটা অবশ্য বেশিই বোকাসোকা। তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করে সবাই, ঠাট্টা করে দু'বছর আগে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া বউটিকে নিয়ে। বউটি এখন শহরে কাজ করে, সবাই বলে অনেক রঙঢং আর সুখে আছে সে। সোনাতন বিবি এ ঘরে তার একমাত্র নাতি, কঙ্কার বাপকে রেখে দিয়েছেন নিজের কাছে। সেটি অবশ্য অধিকতর ভালো হয়েছে বলা যায় না, কারণ পাঁচ বছরের বালককেও মা'কে নিয়ে শুনতে হয় নানা কথা। এবং আজকাল কিছু কিছু কথা সে বুঝতে পারে।
নিশুতি রাতে গোঙাতে থাকে একটি বোবা গরু এবং একজন বোকা মানুষ। রাতের গভীরতায় ক্রমাগত দীর্ঘতর হয় তাদের গোঙানির আওয়াজ।
৩.
দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি আজকাল আর তেমন তীক্ষ্ণ নয় সোনাতন বিবির। গরীব মানুষদের জন্য এটি অবশ্য চমৎকার একটি ব্যাপার, কারণ আনন্দিত না হতে পারলেও এতে কম দুঃখী হয় তারা। শুধু কষ্ট খানিক তীব্র হয় যখন, সোনাতন বিবির মনে পড়ে তার পাগল স্বামীর কথা, দেড় যুগ আগে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। কোথায় আছে মানুষটি, কেমন আছে? বেঁচে আছেন কি? কত উড়ো খবর আসে, আর পাগলের মতো ছুটেন সোনাতন বিবি!
"মা, মা, কই তোমরা?" চমকে উঠে সোনাতন বিবি।
মুহূর্তে জেগে উঠে ঘুমন্ত বাড়িটি। চোখ কচলে ঘুম থেকে উঠে কঙ্কার বাপ, তার গালে কান্নার রেখা অনেকটা ম্লান এখন। ফরিদের চার বছরের মেয়ে মালাও জেগে উঠে। বাবার দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসিতে হাত বাড়িয়ে দেয় সে, ঘুম কেটে গেছে তার।
শেষ রাতে প্রজাপতির ডানার মতো ফিনফিনে উত্তুরে হাওয়া বইতে থাকে। বাসন্তী উষ্ণতার আমেজ বাতাসে, আমের হলুদ বোলের মিষ্টি ঘ্রাণ। বোকা রহিমের গোঙানি থেমে যায়, চুপ করে লালী গাভিটিও। খানিক পর আবার নিস্তব্ধ হয় বাড়িটি।
রঙিন চশমা পরে ঘুমাতে যায় কঙ্কার বাপ, পাশে মালা। দু'জনের হাতে একটি করে লালচে আপেল, হাত দিয়ে চোখের সামনে নিজ নিজ আপেল ধরে পরীক্ষা করে তারা। কঙ্কার বাপের কপাল থেকে চশমাটি খুলে নেয় মালা, বসিয়ে দেয় নিজের চোখের উপর। হঠাৎই ভাইয়ের আপেলটিকে সুন্দর মনে হয় তার।
"এইটা নেও, ঐটা আমারে দেও।" আপেল বদল করতে জেদ ধরে মালা।
কঙ্কার বাপ অবশ্য এসব ক্ষেত্রে বোনকেই অগ্রাধিকার দেয়, সানন্দে বদল করে ফেলে। বদলি আপেলটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে মালা, গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়। কেন যেন আগের মতো আর সুন্দর লাগছে না আপেলটিকে। নিজের আপেলটিকে ফিরিয়ে নিতে গোঁ ধরে মালা, আবারও বদল হয় আপেল। কিছুক্ষণ পর মালা আবার হাত বাড়ায় ভাইয়ের আপেলটির দিকে।
গভীরতর হয় রাত, কিন্তু ছোট্ট দু'টি মানুষের মধ্যে আপেল দু'টির চূড়ান্ত কোনো মীমাংসা হয় না। একসময় বুকের কাছে আপেল রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে তারা, ঘুমের ঘোরে মজার স্বপ্ন দেখে তারা, স্বপ্নে ডানাওয়ালা স্বর্গীয় দেবদূতের পিঠে চড়ে হাসতে থাকে তারা।
বাইরে ধূসর, অন্ধকার আকাশ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে দু'টি মানব শিশুর দিকে। কত অযুত-নিযুত বছর পেরিয়ে যায় মহাকালের পথে, তবু সাধারণ দু'টি আপেল নিয়ে ক্ষুদ্র দু'টি মানুষের এত আনন্দের রহস্য এখনও বুঝে উঠতে পারে না সুবিশাল আকাশ।