"আমি ওয়াদা করছি, আমাদেরকে এ পুরস্কার প্রদানের জন্য অনুশোচনা করতে হবে না আপনাদের।" নরওয়ের রাজধানী অসলোর সিটি হলে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রচণ্ড করতালির মধ্য দিয়ে এভাবেই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। অন্যসব সাধারণ ইয়েমেনি নারীর মতোই দেখতে—বিনম্র, কিছুটা আটপৌরেই বলা যায়, আর হালকা আকাশি রঙের হিজাবে শ্রদ্ধাবনত। কিন্তু কথা বলেন সুতীব্র আবেগে আর হাসিতে, ইয়েমেনের শিশুদের নিয়ে, তাদের সোনালি ভবিষ্যতের অঙ্গীকারে। ইয়েমেনের মানুষ মুগ্ধ হয়ে শোনে তাঁর কথা।
তিনি সাংবাদিক তাওয়াক্কুল কারমান, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রথম আরব নারী, শান্তিতে কনিষ্ঠতম নোবেল বিজয়ী। মানুষ শ্রদ্ধা ভরে তাঁকে ডাকে, বিপ্লবের জননী। তাঁর নিজেরই রয়েছে তিনটি সন্তান, আর এখন সমগ্র ইয়েমেনি জাতিরই মায়ের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে তাকে।
পুরস্কারের যথার্থতার ব্যাপারে কারমানের আশ্বাস কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে নির্বাচক কমিটিকে, কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক হিসেবে বিবেচিত এ পুরস্কারটির সাথে বিতর্কের ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। একেবারে সম্প্রতি, ২০০৯ সালে ওভাল অফিসে বসতে না বসতেই, বারাক ওবামার নোবেল পাওয়া ছিল বিস্ময়। এর পরের বছরই চীনের ভিন্ন মতাবলম্বী নেতা লু জিয়াওবোকে পুরস্কার প্রদান বিশ্ব জুড়ে জন্ম দিয়েছে সমালোচনার, নরওয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও ছিন্ন করেছে চীন।
কারমান পুরস্কার গ্রহণ করেন আরও দুজন নারীর সঙ্গে। তাঁদের একজন লাইবেরিয়া তথা আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সিরলেফ; অন্যজন তাঁরই স্বদেশি, সমাজকর্মী লিমা বৌউই। তিন জনের যে বিষয়টি সবার আগে চোখে পড়ে, ব্যক্তিত্বে প্রায় পুরোপুরিই ভিন্ন তাঁরা। সিরলেফ রাশভারী, কথা বলেন ধীর শান্ত স্বরে, যৌথ পরিবারের প্রাচীন দাদিমাদের মতো। লিমা স্পষ্টবাদী, আবেগে ফুটছেন যেন, ঠোঁটকাটা বলেই ভুল হয়। আর সারাক্ষণ কেবল হাসছেন কারমান। কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে অভিন্ন চিন্তা ও সংগ্রাম হৃদয়ের একই বন্ধনে বেঁধেছে তাঁদের। আর এ কারণেই হয়তো, কারমান, বাকি দুজনকে যিনি সরাসরি দেখেননি কখনো, অসলোতে এসেই যে লিমার হাতটি ধরলেন, ছেড়েছেন খুব অল্প সময়ের জন্যই।
সিরলেফ, লিমা ও কারমান পুরস্কার পেয়েছেন অবিচার, যৌন সন্ত্রাস ও নিপীড়ণের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য। "আপনারা প্রাচীন সেই চীনা প্রবাদটির সুনির্দিষ্ট অর্থ দিয়েছেন, নারীরা ধরে রাখে অর্ধেক আকাশ," নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান থরবিওর্ন ইয়াগল্যান্ড তাঁর ভাষণে বলেন। "আমাদের মধ্যে যে আশার সঞ্চার করেছেন আপনারা, তার জন্য ধন্যবাদ।"
নব্বইয়ের দশকের অধিকাংশ সময় লাইবেরিয়া অতিবাহিত করেছে রক্তপাতের ভেতর দিয়ে। সবচেয়ে করুণ ছিল লাইবেরিয়ার শিশুদের অবস্থা; তাদের একদল হয়ে উঠল নরহত্যাকারী সৈনিক, আরেক দল প্রাণভয়ে ভীত উদ্বাস্তুর মতো পালিয়ে বেড়াতে থাকল বনে-জঙ্গলে। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে চার্লস টেলর ক্ষমতা আরোহণের পর পশ্চিমা আফ্রিকার দেশটিতে সবাই যখন দীর্ঘমেয়াদী রক্তপাতের আশঙ্কা করছিল, কেউই কল্পনাও করতে পারেনি, লাইবেরিয়ার নারীরাই একদিন পরিবর্তনের আলোকবর্তিকাটি নিয়ে আসবেন।
"তুমি যখন কোনো আশা দেখো না, নিজেকে যখন নিঃস্ব দেখো, তুমি যখন ক্রুদ্ধ হও, তখন তোমার সামনে দুটি পথ খোলা থাকে: বন্দুক তুলে নাও হাতে, কিংবা ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা কর। আমি দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছি," প্রশ্নোত্তর পর্বে লিমা বলেন। "লাইবেরিয়ার নারীদের গল্পটি সিনডারেলা উপাখ্যানের মতোই।"
লিমা তাঁর সংগ্রামে সমর্থন পেয়েছিলেন নারী আধিকারকর্মী এবং প্রাক্তন অর্থমন্ত্রি সিরলেফের। গ্রিক পুরাণের অতলগহ্বর থেকে লাইবেরিয়ার উত্তরণে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন সিরলেফ, এ বছর দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। "আমাদের শিশুরা পালিয়ে যাচ্ছিল। আমরা তাদের ফিরিয়ে আনলাম, আমরা তাদেরকে আশা দিলাম।" সিটি হলের জনাকীর্ণ কক্ষে ক্ষণিকের জন্য হলেও আর্দ্র হয়ে উঠে রাশভারী এই নারীর কণ্ঠস্বর।
তবে বাকি দুজনের মতো স্বস্তিদায়ক নয় তাওয়াক্কুল কারমানের মাতৃভূমির পরিস্থিতি। যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র আর নিপীড়ণের মাধ্যমে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতা ধরে রাখেন স্বৈরাচারী আলী আবদুল্লাহ সালেহ। দেশ শাসনের বিপদ ও অনিশ্চয়তাকে সালেহ নিজেই আখ্যায়িত করেন, সাপের ফনায় দাঁড়িয়ে নৃত্যের সাথে। তারপরও তেত্রিশ বছর ধরে নেচেই গিয়েছেন সালেহ; আর জীবনের তেত্রিশ বছর পূর্ণ হতে কামরানের এখনও এক বছর বাকি।
সালেহ পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে এখনও ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। "সালেহ মিথ্যাবাদী, এবং তিনি মিথ্যা বলে যেতেই থাকবেন। স্বেচ্ছায় তিনি ইয়েমেন ত্যাগ করবেন না, কিন্তু আটাশ হাজার নিহত ও আহত ইয়েমেনির আত্মত্যাগ নিষ্ফল হতে দিতে পারি না আমরা," দৃঢ়কণ্ঠে বলেন কারমান।
আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না জানতে চাইলে সিএনএনের প্রশ্নকর্তাকেই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন কারমান, "ইয়েমেনে কি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে? আমেরিকা প্রশাসনকে দয়া করে প্রশ্নটি করবেন আপনারা।" তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যথার্থ পদক্ষেপের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে বিজয়ী হবেন তিনি, হাস্যোজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী তাঁর মুখ।
বিপ্লবের জননী, যিনি উজ্জ্বীবিত হন তাঁর ধর্মবিশ্বাসের সাম্যে, যিনি উজ্জ্বীবিত হন সুপ্রাচীন, বিখ্যাত এক ইয়েমেনি নারীর গৌরবময় ইতিহাস ও কর্মকাণ্ডে, সফল হবেন কি শেষ পর্যন্ত, তাঁর সন্তানদের জন্য? আমরা আশাবাদী, তাওয়াক্কুল কারমানই হবেন আধুনিক ইয়েমেনে প্রাচীন সেবা'র রাণী।
(সিটি হলের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে, ১০ ডিসেম্বর ২০১১, অসলো, নরওয়ে)
____________________
* কিছুটা পুরোনো লেখা, সংকলিত পাতায় না দিয়ে মূলতঃ সংরক্ষণের জন্য আমার ব্লগে রেখে দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:১০