"বুঝলেন, জগত রাজনীতিময়, বিশ্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি।" দীঘল চুল নাচিয়ে বললেন বুদ্ধিজীবি।
"আপনি বলতে চাচ্ছেন, বিষয়টি আপেক্ষিক, নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির উপর?" ব্যস্ত রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন রাখি আমি।
মৃদু হাসেন বুদ্ধিজীবি, সম্ভবতঃ আমার নির্বুদ্ধিতায়। "না, এখানে আপেক্ষিকতার কিছু নেই, যদিও মননশীলতার ক্ষীণতার দরূণ রাজনীতির সূক্ষ্ম বিষয়াদি অনেকের নজর এড়িয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।"
নিজের মরণশীলতা নিয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছি বহু পূর্বেই। তবে মননশীলতার ব্যাপারে, তিনি ঠিকই বলেছেন, দ্বিধা রয়েছে আমার বেশ।
"খুব সহজেই আপনার রাজনীতি জ্ঞান পরীক্ষা করতে পারি আমি।" বুদ্ধিজীবি বলেন।
"তাই নাকি, হোক তাহলে!" তীব্র কৌতূহল কাজ করে আমার ভেতর।
"সংসদ ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেবেন, গত বুধবার দেয়া প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে কী হিসেবে দেখছেন আপনি?"
"বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সংযুক্ত, অর্থাৎ এটি একটি রাজনৈতিক ঘটনাক্রম।" জবাব দেই আমি।
"গতকাল বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আবার নাকচ করে দিলেন বিরোধীদলীয় নেত্রী, এ ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?"
"আমাদের সরকার ও বিরোধী দলের পারস্পরিক সুদীর্ঘ অবিশ্বাসের প্রকৃষ্ট উদাহরণ এটি। সংক্ষেপে, রাজনীতি।"
"অভিনন্দন! বৃহৎ পরিসরে রাজনীতি নিরূপণ করার ক্ষমতা রয়েছে আপনার।" ঘোষণা করেন বুদ্ধিজীবি।
আমরা হাঁটতে থাকি অতঃপর, মার্তণ্ডের প্রখর কিরণের ভেতর দিয়ে। আমরা দেখতে পাই, লাল গোলাপ আর চকলেট হাতে লাজুক এক তরুণ দাঁড়িয়ে, অভিমানী এক তরুণীর সামনে।
"এদের দেখে কী মনে হয় আপনার?"
"মেয়েটি রেগে আছে, মিষ্টি কথা আর উপহারে তার রাগ ভাঙাচ্ছে ছেলেটি। ভালোবাসাবাসির একটি স্নিগ্ধ সাধারণ দৃশ্য।"
"আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে আপনাকে।" রহস্যময় ভঙ্গিতে বলেন বুদ্ধিজীবি।
"আপনি নিশ্চয়ই বলতে চাচ্ছেন না, বিষয়টি নিছক জৈবিক!" আশ্চর্যান্বিত হই আমি।
"জৈবিক? হ্যাঁ, তবে তার চেয়েও বেশি, রাজনৈতিক।" দার্শনিকভাবে বলেন তিনি।
"রাজনৈতিক!" প্রায় চিৎকার করে উঠি আমি।
"হ্যাঁ, এদের ভালোবাসায় উপঢৌকনের বিষয়টি চলে এসেছে।" নির্লিপ্তভাবে বলেন তিনি।
আবারও হাঁটতে থাকি আমরা, এবার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে। পরিষ্কার নয় পোশাক তাদের, কিন্তু চমৎকার জ্বলজ্বলে মুখ, নিষ্পাপ দেবশিশুর মতো, কিছু ছেলেমেয়ে দেখতে পাই একটি কক্ষে।
"সদা সত্য কথা বলবে তোমরা। মিথ্যা বলা মহাপাপ, মিথ্যাবাদী রাখালের মতো হবে না কখনো।"
"জ্বি, স্যার।" শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে মাথা দোলায় তারা।
"কেউ অভাবে পড়লে, সাধ্যমতো সাহায্য করবে তোমরা। মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর চেয়ে বড় সফলতা মানবজীবনে নেই আর।"
"জ্বি, স্যার।"
"কারও বিপদে আপদে, অসুখে বিসুখে ছুটে যাবে তোমরা। জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর।"
"জ্বি, স্যার।"
"মনে রাখবে, সকল মানুষ সমান, ছোট-বড় ভেদাভেদ নেই।"
"জ্বি, স্যার।" উদ্ভাসিত হয়ে উঠে দেবশিশুদের মুখ।
"কী মনে হয় আপনার?" চোখ মটকে প্রশ্ন ছুঁড়েন বুদ্ধিজীবি।
"চমৎকার অনুকরণীয় নৈতিক।"
"আসলে বিষয়টি জটিল রাজনৈতিক।"
বিস্ময়ে কোনো কথা সরে না আমার মুখে।
"শিশুদের দিক থেকে বিষয়টি হলো, নীতিবাক্যগুলোর দরূণ সঙ্গবদ্ধ একটি দলে পরিণত হবে তারা। বাক্যগুলো হবে তাদের মূলমন্ত্র, এদের দ্বারা নানা আচারাদি পালন করবে তারা, সমাধান করবে নিজেদের সমস্যার। বাক্যগুলো দ্বারা অন্যদেরও আকৃষ্ট করবে তারা, চেষ্টা করবে দলভারী করতে, যেরকম করে থাকে সকল রাজনৈতিক দল।"
"আর শিক্ষকের ব্যাপারটি?"
"আর শিক্ষকের দিক থেকে ব্যাপারটি দাঁড়াবে, শিশুদলের অনুকরণীয় নেতা তিনি। দলটি এখন যেহেতু রাজনৈতিক, তিনিও আর সব রাজনৈতিক নেতার মতোই!"
আমাকে স্বীকার করতেই হলো রাজনীতি অনুধাবনে আমার মস্তিষ্কের ক্ষমতা বড়জোর শিশুর পর্যায়ে। শীঘ্রই পথ শেষ হয় আমাদের, করমর্দন করে বিদায় নেই আমি বুদ্ধিজীবির কাছ থেকে।
খানিকটা এগুতেই বিস্ফোরণের আওয়াজ। পেছন ফিরে তাকাই আমি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক গাধা সশব্দে বায়ুত্যাগ করেছে, আর তাতে বাত্যাবিধ্বস্ত, সেসঙ্গে মলবিধ্বস্ত, হয়েছেন আমাদের বুদ্ধিজীবি। দ্রুত তার সাহায্যে এগিয়ে যাই আমি, পকেট থেকে টিস্যু বের করে দেই। গাধাকে গালি ও অভিসম্পাত দিতে দিতে তিনি বলেন, "আপনি নিশ্চয়ই ধরতে পারেননি।"
"কীসের কথা বলছেন?" অবাক হই আমি।
"গাধার বায়ুত্যাগেও রয়েছে রাজনীতি।"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৫৮