somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শহীদের সেলুন

২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের এলাকায় দুইটা সেলুন ছিল। চুল কাটার জন্য দুইটা সেলুনই বিখ্যাত আমাদের এলাকায়। মুন্নার সেলুন আর শহীদের সেলুন। শহীদের মামা ছিলেন ইব্রাহিম বিহারি, উনি ওই সময় সেলুনে চুল কেটে টাকা জমায়ে পবিত্র হজ্ব পালন করে এসেছিলেন,তাই এলাকার মুরুব্বি আর ভদ্রলোকেরা শহীদের সেলুনেই বেশি ভিড় করতেন।সিরিয়াল দিয়ে আসা লাগতো শুক্রবারে সকালে যেন জুম্মার আজানের আগেই চুল কাটা শেষ করে নামাজে যেতে পারে সবাই। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠতো না।
সে সময়,মানে অনেক আগে খুব বেশি চুলের কাটিং স্টাইল বা এতো আধুনিক সেলুন ছিল না।
যারা চুল কেটে দিতেন তারাও এখনকার মতো আধুনিক বিউটিশিয়ান বা রূপলাবণ্য স্পেশালিস্টদের মতো ভংচং কাটিং দিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিতেন না বা বিভিন্ন ধরণের রূপ সৌন্দর্য সম্পর্কিত বিষয়ে সিডিউসিং করে ফাঁদে ফেলতেন না। তারা জিজ্ঞেস করতেন এই ভাবে,''চুল দাড়ি দুইটাই কাটমু নাকি খালি চুল ছাটবেন?'' যদিও তখন দাড়ি-মুছ উঠেই নি তাই আমার চুল কাটার বিষয়ে পরে আসতেছি।
সে সময়ের সেলুনে বসে থাকা এক দুই ঘন্টা সময়ে দুনিয়ার অনেক কিছু জানতে পারতাম, তবে সেগুলো সত্য না মিথ্যা তা বুঝতাম না তবুও কেন জানি সেসব শুনতে খুব ভালো লাগতো। বড়দের সেভিং করা দেখতাম খুব আগ্রহ নিয়ে, সেভিং শেষে যখন স্টিলের গেলাসে রাখা পানির ভেতর থেকে ভেজা ফিটকিরি নিয়ে গালে ঘষে দিতেন কেন জানি সে সময় খুব ভালো লাগতো। জেল, ফোম এসবতো তখন আসেইনি বাংলাদেশের জেলা শহরগুলোতে।ঐ যে সেভিং ব্রাশ আর কিরিম দিয়ে কত যত্ন করে গালে থুতনিতে ঘষিয়ে ঘুরিয়ে ফেনা উঠাইতে এসব এখন অতীত। তবে কিছু গ্রামের হাটে এখনো অনেক মুরুব্বিদের দেখা যায় ''হাঁটুর তলে কাল্লা '' দিয়ে দাড়ি কামাচ্ছে আগের দিনের সেই ব্রাশ আর কিরিম দিয়ে ফেনা তুলে। চুল দাড়ি কাটা শেষে হাত উচা করে দিতো কিছু কিছু মানুষ। কি কাটতো তা না হয় নাই বললাম, বুঝে নিয়েন।

এবার আসি আমার ঘটনায়। তার আগে বলে নেই, ছোটদের চুল কাটার জন্য চেয়ারের ওপর একটা সাহায্যকারী চওড়া আর লম্বা কাঠ ব্যবহার করতো নাপিতেরা। অনেকেই বুঝতে পারবেন হয়তো। আমার বাবা ছিলেন এক কথার মানুষ। জীবনে তার সাথে আমার যত কথা কাটাকাটি হয়েছে তার মধ্যে প্রায় ৯৮ ভাগ চুল কাটা নিয়ে। আমার চুল কাটানো হতো শহীদের সেলুন থেকে। শহীদ মামা বলেই ডাকতাম নাপিতকে। আব্বুর কড়া নির্দেশ ছিল আর্মি কাটিং দেওয়ার জন্য। এলাকায় সমবয়সী সবাই আর্মি কাটিং দেওয়ার পরে মজা করে বলতো ''চাম ছাট'' দিছে। সে সময় এটা মেনে নেওয়াও খুবই কষ্টকর ছিল।

একবার ঈদের আগে আব্বুর নিষেধ অমান্য করে মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলাম মুন্নার সেলুনে। ঈদের মধ্যে অনেক ছেলেরাই রাহুল কাট বা টাইটানিক কাট দিতো। যারা একটু বয়সে বড়ো তারা সব সময়ই এসব কাট দিতো। আমার খুব ইচ্ছে হতো রাহুল কাট দেওয়ার জন্য বা টাইটানিক কাট দেওয়ার। ঈদের দুইদিন আগে মায়ের থেকে ১০ টাকা নিয়ে গেলাম মুন্নার সেলুনে, প্রচুর ভিড়। মুন্নাকে যেয়ে বললাম রাহুল কাট দিয়ে দেওয়া লাগবে। মুন্না আমাকে দেখে বললো আপনার আব্বাকে লিয়ে আসেন তারপর চুল কাটমু। সে জানে আমি শহীদের সেলুনে চুল কাটি তাই ভয়ে চুল কাটতে চাচ্ছিলো না। পরে বললাম আব্বুই টাকা দিয়ে পাঠাইছে চুল কেটে দেওয়ার জন্য। হাতের মধ্যে টাকা দেখে তারপর বসাইছে চুল কাটার জন্য। অবশেষে আমার প্রতীক্ষিত রাহুল কাট দিয়ে দিলো। খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি এলাম। আব্বু বাড়িতে নেই। মা সাবান আর ঝিঙের খোসলা দিয়ে ডলে গা মাথা ঘুসে গোছল করিয়ে দিলো। মাকে বললাম আব্বু দেখলে যদি মারে তখন তুমি আটকাবে। মা বললো ঠিকাছে আসলে আমি বুঝিয়ে বলবনি। সন্ধ্যায় ইফতারের আগে আব্বু বাসায় আসলো। আমি আব্বুর সামনে আসছিনা। শীতের সময় ছিল তাই মাথায় মাফলার দিয়ে পেঁচিয়ে ইফতার করতে বসলাম। আজান দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আব্বুর চোখ পড়লো আমার চুলের দিকে। মুখে পানি না দিয়েই বললো মাফলার খুলো।আমি উঠে দৌড় দিতে নিয়েছি আর খপ করে ধরে ফেলছে। মাফলার খুলে দেখে চুলের অবস্থা বেহাল (তার ধারণা অনুযায়ী )। কিসের ইফতার কিসের রোজা আগে আমার চুল ধরে টানাটানি। মা উঠে আগেই সরে গেছে। আমি তো ভয়ে দিয়েছি চিৎকার। পাশের বাড়ি থেকে আমার মায়ের খালা দৌড়ে আসছে। এসে বুঝে শুনে আব্বুর মাথা ঠান্ডা করে ইফতার খাওইলো। আব্বু জিজ্ঞেস করলো কে চুল কাটছে এইভাবে। আমি ভয়ে শহীদের নাম বলছি। যদি শুনে মুন্নার সেলুনে গিয়েছিলাম তাইলে প্রহারের মাত্রা বেড়ে যাবে। নামাজ শেষ করেই আমাকে নিয়ে রওনা দিলো শহীদের সেলুনের দিকে।বেচারা মাত্র ইফতার করে উঠেছে আর আব্বু যেয়ে হাজির আমাকে সাথে নিয়ে।
-এই বালসিরুখা (আব্বু খেপে গেলে এই গালিটা ব্যবহার করতেন) এ কি চুল কাটছো ?
-ভাই, এই চুল তো আমি কাটিনি (তিন পা পেছনে যেয়ে শহীদ মামার উত্তর)।
-তো কে কাটছে?
আমি কান্না করতে করতে বললাম মুন্না মামা কাটছে। আর কই যাই, শুরু হয়ে গেলো মাইর। সেলুনের দুই একজন এগিয়ে এসে আমাকে মুক্ত করে নিলো। শহীদ মামা বললো ভাই আমি ভালো করে চুল কেটে দিচ্ছি, আপনে আর মাইরেন না। ওই সময়ই আমাকে আবার চুল কাটায়ে আর্মি ছাট দিয়ে বাসায় এনে মায়ের সাথে এক দফা ঝগড়া করে ক্ষান্ত হইছিলো আমার বাবা।পরবর্তী ১০ বছর ভুলেই গিয়েছিলাম এলাকায় আরো নতুন নতুন সেলুন হয়েছে।
বাবার বয়স হয়েছে এখন কিন্তু চুল কাটেন ওই শহীদ মামার কাছেই। জীবনের তাগিদে বাসা থেকে এখন বাহিরে। যদি কখনো মাকে বলি চুল কেটে এলাম বাবা পাশে থেকে মাকে বলে ভিডিও কল দাও, দেখি ওর কানের সাইডের চুল গুলো ঠিকমতো মিলাইতে পারছে কিনা নাপিত। মা হাসেন ভিডিও কল দিয়ে আব্বুকে দেখায় আমার চুল। আব্বু বলে হয়নি চুল কাটা। এসব নাপিতেরা চুলই কাটতে পারে না। গতবছর ঈদের সময় সুযোগ হয়েছিল আব্বুকে চুল কাট তে নিয়ে যাওয়ার।শহরের সবচেয়ে আধুনিক সেলুনে নিয়ে গিয়েছিলাম আব্বুকে। আমি মন খারাপ করবো বলে অনেক কষ্টে উনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে চুল কেটে দাড়ি সাইজ করে নিয়ে এসেছিলাম। মনে মনে ভাবলাম যাক আব্বু এবার তার নিয়ম থেকে বের হইছে। সব আত্মীয় স্বজনদের বলতে পারবো আব্বু অন্য সেলুনে গিয়েছিলো। পরদিন সকালে মা এসে বললো "তোর আব্বু রাতে শহীদের সেলুনে গিয়েছিলো, দাড়ি কাটা নাকি ঠিক হয়নি, ওখান থেকে ঠিক করে নিয়ে আসছে।''
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:২৭
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সমসাময়িক চিন্তা ও পাশের দেশের অবস্থা!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৩৩

পাশের দেশের মি শুভেন্দু বাবু যেভাবে চিন্তা করেন, তাতে তাদের দৈনত্যাই প্রকাশ পায়! অথচ বহু বছর আগেই তাদের জ্ঞানী ব্যক্তিরা আমাদের সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। যাই হোক, এই সবকিছুই থেমে যাবে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনধিকার চর্চা নয়, শান্তিরক্ষি ভারতে প্রয়োজন

লিখেছেন মোহাম্মদ সজল রহমান, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৫৫

বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় অভিযুক্ত এবং ইসকন সংগঠন থেকে বহিঃস্কৃত ধর্ম প্রচারক বিতর্কিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, তার মুক্তির জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের এক শ্রেণীর জনগণ যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে, তাতে মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমরা উকিলরা কেউ চিন্ময়ের পক্ষে দাঁড়াবো না , না এবং না

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২




সাবাস বাংলাদেশের উকিল । ...বাকিটুকু পড়ুন

আগরতলায় হাইকমিশনে হামলা কাকতালীয় না কি পরিকল্পিত?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩২

গতকাল (২ ডিসেম্বর) ভোরে আগরতলার হিন্দু সংগ্রাম সমিতির বিক্ষোভকারীদের দ্বারা বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের প্রাঙ্গণে হিংসাত্মক বিক্ষোভের পর ন্যাক্কারজনকভাবে আক্রমণ করে। বিভিন্ন তথ্যে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত যে বিক্ষোভকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের সাথে যুদ্ধ করে ভারত লাভবান হবে বলে মনে করি না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০



আমাদের দেশে অনেক মুসলিম থাকে আর ভারতে থাকে অনেক হিন্দু। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধে মুসলিমদের সাফল্য হতাশা জনক নয়। সেজন্য মুসলিমরা ভারতীয় উপমহাদেশ সাড়ে সাতশত বছর শাসন করেছে।মুসলিমরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×