একটা পোস্ট দেখে লেখার সাধ জাগলো। যা নিয়ে লিখবো তা আমার নেই।
আমার দাদা-দাদি, নানা-নানি কেউ নেই। বাবা মা যখন ছোট ছিলেন তখনই তারা পরপারে উড়াল দিয়েছেন। বাবার বয়স যখন ৪ বছর তখন দাদি অসুস্থতায় মারা যান আর ৭ বছর বয়সে দাদা।
মার বয়স যখন ৮ বছর তখন নানি মারা যায়, ১৪ বছর বয়সে নানা। আমার ৭ জন খালা একটা মামা। মামা সবার ছোট ছিলেন ২০১২ সালে উনিও মারা যান।
বাবার বড় ভাই ছিলেন মানে আমার বড় আব্বা তার সাথেও জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বার দেখা হয়েছে।
আমার মা বাবা মামাতো ফুফাতো ভাইবোন ছিলেন। নিজেদের ভেতরে বিয়ে শাদী হয়েছে। বাবা আর বড়বাবা দুইজনই ছোটবেলায় এতিম খানায় ছিলেন চাচাদের অবহেলার কারণে। নিজের বাবার যা কিছু ছিল তা আর ভাগ্যে জোটেনি। বাবার চাচারা নিজেদের করে নিয়েছিলেন সব। তারপর বাবার মামা এতিম খানা থেকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখেন। নিজের ছেলেদের মতো রাখলেও তার দোকানে কাজ করাতেন। বাবার জীবন সংগ্রামের কথা অন্যদিন লিখবো। আজ এই দাদা-দাদি, নানা-নানি কে কখনো না দেখার অনুভূতি তা কেমন তা লিখার চেষ্টা করি।
ছোটবেলায় সারাদিন মায়ের কাছে বায়না করে বলতাম,ওমা বলতো আমার নানী কেমন ছিল? মা বিভিন্ন ভাবে নানীর বর্ণনা দিতেন। এলাকার যেসব বয়স্ক মানুষ ছিল তাদের থেকে শুনতাম আমার নানা-নানি, দাদা-দাদি কেমন ছিলেন।
আমার নানি ছিলেন কালো বর্ণের তবে মানুষ্ হিসেবে পুরো পাড়া জুড়ে তার সুনাম ছিল। নাম ছিল জুলেখা খাতুন, সবাই জলপাই বলে ডাকে এখনো। একদম মাটির মানুষ ছিলেন। মারা যাওয়ার আগেও নাকি তার মাথার সবগুলো চুল একদম কিশকিশে কালো ছিলো। শাড়ি পড়তেন সবসময় এক পাল্লা করে। কোনোদিন ছবি তুলেননি।
আমার দাদির নাম শহর বানু। রূপে গুনে সেরা ছিলেন পুরো শহরের ভেতর। গায়ের রং নাকি একদম ধবধবে দুধসাদা ছিলো। এক কলসি ভর্তি শুধু গয়নাই ছিলো তার। যেদিন উঠানে বসতেন সেদিন নাকি এলাকার বৌ ঝিদের ভিড় লেগে যেতো তাকে দেখার জন্য। এটা আমাদের এলাকার মুরুব্বিদের থেকে শোনা কথা। আমার বাবা এবং মা বলেন আমার বড় বোন অনেকটা দাদির মতো হয়েছে, তবে দাদি আরো বেশি সুন্দর ছিলেন। কোন এক অজানা অসুখে অকালে মারা যান।
আমার দাদার নাম ইসরাইল শেখ। পাকিস্তান পিরিয়ডে সরকারি ড্রাইভার ছিলেন। বাবা খুব গর্ব করে বলতেন ওই সময় নাকি তিনি জীপ গাড়ি চালাতেন। একদিন হেটে বাড়ি ফেরার সময় হোঁচট খেয়ে পরে গিয়েছিলেন রেললাইনের ওপর। সরাসরি বুক যেয়ে রেল লাইনের পাতের ওপর পড়েছিলো এবং ওখানেই মারা গিয়েছিলেন।
আমার নানা অনেক দুঃখী মানুষ ছিলেন। আয় রোজগার তেমন ছিলো না। ঘরে মা মরা সাত মেয়ে আর এক ছেলে। নুন আন্তে পান্তা ফুরাতো। তার নাম ছিলো মোস্তফা শেখ। যুদ্ধের সময় কয়েকজন লোককে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের করতোয়া নদীর ধাঁরে লাইন করে দাঁড় করিয়েছিলো ব্রাশ ফায়ার করার জন্য। নানা ছিলেন একদম লাইনের শেষে। ফায়ার শুরু হওয়ার সাথে সাথেই নানা সহ আরো দুয়েকজন বুদ্ধি করে নদীতে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন। যুদ্ধের কয়েকবছর পর অসুস্থতাজনিত কারণে নানা মারা যান। এসব গল্প শুনে শুনে জীবনের অর্ধেকটা সময় পার হয়ে গেলো। কল্পনায় তাদেরকে দেখি। আশেপাশে কারো দাদা দাদিকে দেখলেই অনেক সম্মান করি।
একবারে ঈদের দিনে এক বন্ধুর সাথে তার নানা বাড়ি গিয়েছিলাম। বাড়িতে ঢুকতেই তার নানা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাতের মধ্যে একটা ১০০ টাকার নোট ধরে দিলো। পাশে আমি দাঁড়িয়ে ভেবেছিলাম আমাকেও হয়তো জড়িয়ে ধরবে। তেমন টা হলো না , জিজ্ঞেস করলো কে এটা ? তারপর আমার হাতেও ১০ টাকার একটা নোট দিয়ে দিলো। বন্ধুর মা বলেছিলো বন্ধুর নানা নানি মানেই আমার নানা নানী। সেটা আসলে হয়ে উঠে না। হয়তো একসময় বুড়ো হয়ে যাবো তবুও তাদেরকে না দেখার এই খায়েশটা হয়তো আমৃত্যু থেকেই যাবে। ভালো থাকুক সবার নানা নানী দাদা দাদি। জীবনে সব স্মৃতিই আছে শুধু তাদের সাথে কাটানো কোনো স্মৃতি নেই । আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতবাসি করুন ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


