
পুকুরে গোছল করা একদম নিষেধ ছিল আমার। কানের অসুখ,তাই গোছলের সময় তুলার ভেতর সামান্য নারিকেল তেল ভিজিয়ে নিয়ে দুই কানে সিপি দিয়ে গোছল করতে হতো। সাথে আইসক্রিম, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি এসব একদম হারাম ছিলো। বয়স তখন কতোই আর হবে,এই ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ি। সেই বয়সের যে প্রধান সমস্যা তা হলো নিষেধের বরখেলাপ করা। একদম ১০০ তে ১০০ বরখেলাপ করা। আমিও সেই গন্ডির বাহিরে নই। যা নিষেধ তাই করতে হবে এতে জীবন চলে গেলেও কারো কিছু করার নেই।
আমাদের পাড়া থেকে অন্য এক পাড়ায় একটা পুকুর ছিলো।সবাই কারখানার পুকুর বলে ডাকতো। গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলে তখন, সকালে নাস্তা করে বের হয়ে যাচ্ছিলাম খেলার জন্য। মাঠে, ঘাটে, রাস্তায়, বাজারে যখন যেখানে সুযোগ পেতাম সেখানেই খেলতাম। আমার ক্লাসের এক বন্ধুর বাড়ি ছিল ওই পুকুরের কাছাকাছি। সে এসেছিলো আমাদের পাড়ার মাঠে খেলতে। খেলা শেষে আমাকে বললো চল একসাথে গাও ধুই। আমি বললাম কই গাও ধুবি? সে বললো তার বাড়ির সাথেই যেই পুকুর সেখানেই গাও ধোই ওরা সবাই। সাত পাঁচ না ভেবেই ওর সাথে চলে গেলাম সেই পুকুরে। যেয়ে দেখি অনেক মানুষ সেখানে গোছল করছে , কেউ কেউ ফুটবল দিয়ে খেলছে, কেউ কেউ ওপর পাশে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। আমি সাঁতার না জানা, তাই একটু ভয় ভয় লাগছিলো, কিন্তু ওই সময় খুশির ঠেলায় দিলাম পানিতে লাফ। সামনেই লাফালাফি করলাম। পরনের গেঞ্জি খুলে শুধু হাফ প্যান্ট পরেই নেমে গিয়েছিলাম পানিতে। অনেকক্ষন লাফালাফি করে উপরে উঠে গেঞ্জিটা হাতে নিয়ে আবার দৌড় দিলাম মাঠের দিকে। উদ্দেশ্য, ভেজা প্যান্ট পরে বাড়িতে যাওয়া যাবে না, মা বুঝে যাবে পুকুরে নেমেছিলাম। মাঠে যেয়ে রোদের মধ্যে কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করলাম, কিছু সময় মেহগনি গাছের আগালের ওপর উঠে হওয়া বাতাস খেয়ে নেমে দেখলাম প্যান্ট শুকিয়ে গেছে। তারপর বাড়িতে গেলাম। ঝামেলা হলো রাতে, প্রচন্ড কান ব্যথা শুরু হলো। পুকুরের ময়লা পানি কানে ঢুকেছিলো, তার প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কান্নাকাটি করে শুয়ে বসে রাত পার করলাম।
পরদিন সকালে বাড়ির ওপর মাছ বিক্রি করতে এলো এক লোক। অনেক আগে থেকেই আমাদের এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করে। নাম কালু। লোকটির গায়ের রং শ্যাম বর্ণের ছিল তবে রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করে কালো হয়ে গেছেন। সেদিনের রোদে ঘেমে তাকে কালো থেকে একদম ঘিয়ে ভাজা কালো জামের মতো দেখাচ্ছিলো। জোরে জোরে কয়েকবার ''মাছ আছে মাছ'' বলে ডাক দিলো। ঘরে রান্নার তেমন কিছু নেই। আব্বুর কাজ নেই কয়েক সপ্তাহ ধরে। কোনোরকম ডাল ভাত খেয়ে খেয়ে কয়েকদিন পার করেছি সবাই। আশে পাশের বাড়ি থেকে কয়েকজন মহিলা কালুর কাছে থেকে মাছ কিনে যার যার ঘরে চলে গেলো। মাকে জিগ্গেস করলাম মাছ কিনবা না ? মা কোনো উত্তর না দিয়ে বললো, তোর আব্বু বাহিরে গেছে আসার পরে কিনে আনবে নি। তুই পান্তা খাবি ? পান্তা আমার প্রিয় খাবার। কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ আর লবন মেখে খেতে বসলাম। মনের মধ্যে শুধু মাছ খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিলো।
পান্তা খাওযা শেষে গেলাম মাঠে। মাঠের মধ্যে দেখি একটা এক টাকার সোনালী কয়েন পরে আছে। চুপ চাপ তুলে নিলাম পকেটে। মাথার মধ্যে অদ্ভুত দারুন একটা চিন্তা এলো। গেলাম হানিফের দোকানে, আট আনা দিয়ে একটা বড়শি আর আট আনার নাইলন সুতা। দোকানদার কে বললাম সুতাটা বড়শির সাথে ভালোমতো বেঁধে দিতে। এটা অন্যরকম একটা গিট্টু দিতে হয়, এখনো পারিনা। দোকানদার বেঁধে দিলো। এরপর ওটা নিয়ে গেলাম বারিকের বাঁশের আড়ার ভেতর। দিনের বেলায় ভয়ে কেউ যেত না ওখানে, সবাই বলতো ভূত প্রেত আছে নাকি। কেউ গেলে তাকে নাকি বাতাস লাগে। পরে হুজুর দিয়ে ঝাড়া লাগে। আমি দিব্বি খেলতাম ওই বাঁশের আড়ার ভেতর। ওখান থেকে একটা ভালো দেখে কঞ্চি ভেঙে তার মাথায় আমার বড়শির সুতো টাইট করে বেঁধে নিলাম। মাটি খুঁড়ে করেকটা চ্যারা (কেঁচো ) নিয়ে গেলাম সেই কারখানার পুকুরের কাছ। সেখানে কয়েকজন বড়ো মানুষ আগে থেকেই ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল। তারা মাছ পেয়েছে কিনা আমি জানিনা। আমি কোনোদিন মাছ ধরিনি, কিভাবে ছিপি ধরে টান মারে তাও জানিনা। দেখলাম ওদের বড়শির সুতার সাথে একটা সোলার মতো কি একটা বাধা। মাছ যখন বড়শিতে ঠিক দেয় তখন সেটা দেখলে বোঝা যায় যে মাছ আসছে টোপ খেতে। আমিও আশে পাশে পড়ে থাকা একটা শিমটা নিয়ে বেঁধে দিলাম সুতার সাথে। এরপর বড়শির মাথায় কেঁচো গেথে নিয়ে সেটা ছুড়ে দিলাম পুকুরের পানিতে। প্রায় ২ থেকে তিন মিনিট পরেই আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখে আমার হাতে টান লাগলো। অমনি ছিপ ধরেই দিলাম একটা টান। দেখি প্রায় আমার একহাত সমান একটা মাছ আমার বড়শির সাথে উঠে এসেছে। আমি ভয়ে অস্থির। ওই পাশে থেকে একটি লোক দৌড়ে এসে আমার মাছ কেড়ে নিলো বড়শিসহ। বললো, এই মাছ নিয়ে তুই এখান থেকে বের হতে পারবিনা, এই মাছ আমার। লোকটার নাম মাছুম। নাম মাছুম হলেও কাম পাক্কা শয়তানের মতো। তখন দেখি আর একজন লোক এসে ওকে বললো মাছটা ভালোই ভালোই ওই পিচ্চিরে দিয়েদে নইলে তোরে এই পুকুরের পানি খাওয়ামু। তারপর সেই মাছুম শয়তান আমার বড়শি সহ মাছ আমাকে দিয়ে দিলো। আমি আর এক মুহূর্ত ও দেরি না করে মাছ আর বড়শি নিয়ে দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে বাড়িতে। বাড়িতে যেয়ে দেখি আব্বু বসে আছে, মাও অন্যপাশে বসে আছে। আব্বুর কাছে টাকা নাই সম্ভবত। হঠাৎ আমাকে বাড়ির ভেতর মাছ নিয়ে ঢুকতে দেখে দুইজনই অবাক হয়ে গেলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো মাছ কোথায় পেলাম। বললাম কারখানার পুকুর থেকে ধরে নিয়ে আসছি। মা আর আব্বুর মুখ কেমন যেন লাগছিলো, না খুশি না বেজার। মানে কেমন যেন একটা।
মা জিজ্ঞেস করলো তুই মাছ কবে থেকে ধরতে শিখেছিস ? আমি বললাম আজকেই প্রথম ধরেছি। মা আর কথা না বাড়িয়ে মাছ টা নিয়ে কুটতে বসে গেলো। দুপুরে খেতে বসে দেখলাম আব্বু খুব মজা করে খাচ্ছে, মা ছোট বোনকে খাইয়ে দিচ্ছে, আমিও খাচ্ছি। মাছটা বড়োই ছিল সবারই খাওয়া হয়েছিলো। মা বাবার ক্ষুধা সহ্য করার শক্তি অনেক, মা বাবার অনেক ক্ষুধা লাগে। নিম্নবিত্ত পরিবারের মা বাবাদের অনেক ক্ষুধা লাগে, কিন্তু সেই ক্ষুধা হার মেনে যায় তাদের ধৈর্যের কাছে,দারিদ্রতার কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২৫ দুপুর ২:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


