somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভিয়েতনামের পথে পথে...

২৭ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বসে আছি থাই এয়ারপোর্টে, নাম সুবর্নভুমি। অক্ষরেখাজনিত হিসেব নিকেশে এখানে এসে পৌঁছেছি দুপুর ৪. ৩০ এ। আপাতত জুতো খুলে পা এর উপর পা তুলে বসে আছি। এয়ারপোর্টের জনৈক নিরাপত্তারক্ষী ভদ্রলোক কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে শেষ মেশ জিজ্ঞেসই করে বসলেন ,
where are you going?
অনেক কষ্টে মজা নেওয়ার লোভটা সামলালাম।



সকাল বেলাটা বেশ ঘটনাবহুলই গেল বলা চলে। মাজখানে দু'দফায় আটকা, প্রথম দফা তাও সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ডলার দেখিয়ে বাঁচোয়া। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় বড় মুশকিল, ১২ ঘণ্টার বেশী ট্রান্সিটে নাকি থাকার নিয়ম নেই। বড়কর্তা যতই বলেন সমস্যা নেই, সাগরেদ সাহেব কোনরকমেই ছাড়ার পাত্র নন। শেষ মেশ অবশ্য গজ গজ করতে করতে ছেড়েছেন, আমরাও রওনা হয়েছি ভিয়েতনামের পথে।



দু'দফা প্লেন জার্নির পর আসলে বিমান ভ্রমণ আর বরিশালের লঞ্চ ভ্রমণের মধ্যে খুব একটা তফাত থাকে না। ট্রান্সিটের পরের অংশটুকুর জন্য বিমানের মাঝের অংশে বসায় অবশ্য অনুভূতি অনেকটা সেরকমই। মাঝখানে নাস্তার সময়টুকু বাদ দিলে বাকিটা সময় কেটেছে চোখ বন্ধ করেই; ১২-১৩ ঘণ্টার ট্রান্সিটে আসলে এমনটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। :'(



আমরা উঠেছি সাইগণসান হোটেলে; অফিস থেকে ৫-৭ মিনিটের ট্যাক্সির রাস্তা। সুন্দর সাজানো ছিমছাম হোটেল। ট্যাপ সিস্টেমে ঘুরাইলে ঠাণ্ডা গরম দুই রকম পানিই পড়ে (ইয়াসিনরে ডাইকা আনার পরও ব্যর্থ হয়ে হোটেলের লোক ডাকায়ে কায়দাকানুন শিখসি; গ্রেট সাকসেস :D :D )



সকালে জম্পেশ নাস্তা-ই হল প্রতিদিন, ডিম রুটি জেলি জুস ফলমুল দিয়ে। হোটেলেরর ছাদে রেস্তোরা, প্রথম দিন ঢোকার সাথে সাথেই শেফ ভদ্রলোক কিছু জিজ্ঞেস করতে লাগলেন; সম্ভবত কি খাব জাতীয় কিছু; ভাষার সমস্যাটা এখানে প্রকট। ভদ্রলোক ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি বলতে পারেন; কিন্তু আমার এবং উনার উচ্চারণ; আকাশ পাতাল ভিন্নতা। যতই অক্সিলারি ভার্ব সহ যাবতীয় অতিরিক্ত শব্দ ফেলে দিয়ে বলি 2 other come, then I eat; উনি জিজ্ঞেস করেন আমার ডাবল ডিম লাগবে কিনা (বাকি ২ জন বুঝাতে আমার দু'আঙুল দেখে উনার জিজ্ঞাসা); শেষমেশ বের হয়ে দরজায় এসে দাঁড়ানোর পর বোধহয় বুঝলেন যে কারো জন্য আসলে অপেক্ষা করছি। :/



একদিন দুপুরে ভিয়েতনামের স্ট্রিট ফুড চেখে দেখার সুযোগ হল; নুডুলস এ ডুবানো মাছ ভাঁজা। তেল এবং লবণ; এ দু'জিনিসের সাথে এদের বোধকরি বড় রকমের শত্রুতা আছে; অবশ্য এদের স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে শত্রুতাটাকে আপন করে নিতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে। কারোরই বয়স বোঝার উপায় নেই আসলে; সবাইই কম বেশি চিরতরুন টাইপের। যে পরিমাণ নুডুলস ছিল বাটিতে; তাতে আমার পুরো সপ্তাহের অন্ন সংস্থান হয়ে যাবার কথা। চপস্টিক ব্যাবহার করতে গিয়ে হাত ব্যাথাও করে ফেলেছি ফাঁকতালে। :D



আরেকদিন সৈকত ভাই ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে নিয়ে গেলেন চা খেতে। আমাদের পক্ষে নাকি চা শেষ করা সম্ভব না। এখানকার চায়ের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। এঁরা মূলত গ্রিন টি খায়; তবে আমাদের দেশেরটার মতন না। প্রচণ্ড রকমের তেতো চা; আমাদের দেশের চিরতার রসের চেয়েও বেশি। আমাদের চা সার্ভ করা হল বরফ দিয়ে; তেতোভাব সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য। এঁরা সাধারণত ধোঁয়া উঠাটাই খায়; তবে সেটা নাকি আমাদের পক্ষে গলা দিয়ে নামানো সম্ভব না। বরফ দেওয়াটা এক দফা খেলেই অবশ্য বোঝা যায় আসল জিনিস কি হবে। এই চা-ও নাকি এদের স্বাস্থ্যের গোপন রেসিপির আরেকটা।



কেন্তা মিজুতানি - জাপানিজ ভদ্রলোক। ভিয়েতনামে আছেন বেশ কিছুদিন হল। ভাল ইংরেজি পারেন, ইউরোপেও ছিলেন কয়েকদিন। বর্তমানে ভিয়েতনামের ভাষা শেখার চেষ্টা করছেন। উনার কাছেই জানা গেল সংগ্রামের কথা। ভিয়েতনামের ভাষায় নাকি "বা" এরই ৬ ধরনের ভিন্ন উচ্চারণ রয়েছে। এবং একেকটার অর্থ একেকটার চেয়ে ভিন্ন। কণ্ঠের উঠানামার সাথে শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যায় আমূলভাবে। অর্থাৎ আমরা যদি দৈবভাবে সঠিক শব্দটা বলতেও পারি; সঠিক 'উচ্চারণ' না হওয়ায় স্থানীয় লোকের শব্দটা বোঝার সম্ভাবনা কম। তবে আমাদের দৌড় রেস্তোরা আর ট্যাক্সি পর্যন্তই, সুতরাং আন্দাজ করে কাজ চালিয়ে দেন স্থানীয়রা। দু'সপ্তায় শব্দ শিখেছি মোটে পাঁচটে - 'দেচাই', 'দেফাই', 'দেতাং', 'কম ভিয়েত' আর 'আই নিউ এম' - অর্থ যথাক্রমে ডানে যান, বায়ে যান, সোজা যান, ভিয়েতনামীজ ভাষা বুঝি না এবং শেষটা পাঠকের জন্য কুইজ রইল। (যদিও সবাই-ই পারবেন, জানা কথা ;) )



এই ছবিটা ভাষা সঙ্ক্রান্ত এক মজার ঘটনার। স্টারবাক্স এর সুন্দরী কাউন্টারগার্ল কাপের গায়ে নাম লেখার জন্য ইয়াসিনের নাম জিজ্ঞেস করামাত্র ইয়াসিন আক্ষরিক অর্থেই মাথায় হাত তুলে দিল। দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে "দাস্তগীর" বলার সাথে সাথেই বোঝা গেল; ভদ্রমহিলা কিছুই বুঝেন নি। ফুমিকো সান "দাস" বলার পর "ধাস" "ডাআআস" সহ নানা বিচিত্র শব্দ করে টরে শেষ মেশ এই দশা দাঁড়ালো স্যার এর নামের ! :-D



১৭ তারিখ; বাংলাদেশ এম্বাসিতে অনুস্থান। সবাই মিলে দলবেঁধে গেলাম; ভাল খাওয়া দাওয়া দিবে তাই। এম্বাসি অফিস থেকে বেশ খানিক্টা দুরেই; ঘন্টাখানেক লাগে ট্যাক্সিতে। গিয়ে বসে আছি; অতিথিরা তো আর আসেন না ! পরদিন আবার অফিস; সব ভেবে চিন্তে খাওয়া দাওয়া না করেই বের হয়ে চলে এলাম বেশ খানিকক্ষণ পর। এবার তো বিপদ; ভিয়েতনামে রাত ১০টা নাগাদ সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়ার মতন ভাল কোন দোকান পাই না। সৈকত ভাইকে বলি; ভাই চলেন এলাকায় গিয়েই খাবো; উনি মানার পাত্র নন। অনেক খুঁজে টুজে একটা বিয়ে বাড়ির মতন সাজানো জায়গায় হাজির হলাম। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর জানা গেল; জায়গাটা ব্যুফে রেস্তোরা। এক ওয়েটার জানালো; ব্যুফে খোলা থাকবে ৯.১৫ পর্যন্ত; তারপর তারা খাবার দাবার তুলে ফেলবে; তবে বসে খাওয়া যাবে ১০ টা নাগাদ। ঘড়িতে তখন ৮.৪৬ বাজে। সৈকত ভাই নাছোড়বান্দা; উনি এখানেই খাবেন।


কি আর করা; ঢুকলাম; শুরু করলাম ইতিহাসের দ্রুততম ব্যুফে খাওয়া। প্রত্যেকে তিনটে করে প্লেট হাতে ছুটলাম; এ মাথা থেকে ওমাথা। টেবিলে কাজ না হওয়ায় টানাটানি করে আরও কিছু চেয়ারও যোগাড় করে নিয়ে আসা হল প্লেট রাখতে। আমাদের কীর্তিকলাপে মজা পেয়ে খাবার শেষের আগে ওয়েটার এসে আরও দু'প্লেট ভর্তি পছন্দের আইটেমগুলো দিয়ে গেলেন ! রাত ১০ টা পর্যন্তই খেয়ে তারপরেই বাসায় ফিরেছি। :D



হালং বে থেকে ফিরছি। বসে আছি বোটের ছাদে; সাথে ভিয়েতনামিজ ট্যুর গাইড, চালক, সহকারী, তিনজন কানাডিয়ান, একজন ব্রিটিশ, তিনজন চায়নীজ, একজন জার্মান আর আমরা তিন বাংলাদেশী। হটাত করে প্রস্তাব উঠল; যে যার ভাষায় গান গাইব; জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে শুরু হবে ব্যাপারটা। কানাডিয়ানরা নাচতে নাচতে তুড়ি বাজিয়ে শুরু করল; চায়নীজরা তো গাওয়ার সময় রীতিমত নাচলোও গানের সাথে। এবার আমাদের পালা। তিনটে বাংলাদেশী ছেলে বেসুরো গলায় কিন্তু গভীর দরদে একসাথে শুরু করলাম। হটাত করেই চারপাশের কলরব চুপ হয়ে গেল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, কুয়াশায় ঢাকা চারপাশের রহস্যময় হালং বে পাহাড়, সমুদ্র আর পাশে ১১ জন অচেনা ভীনদেশীর মাঝখানে সুর তুলে গাইছি -
আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি...
অন্যরকম এক অনুভুতি !

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১০
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×