somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাওয়া ঘর

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ ভোর ৪:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সূর্যের সোনালী স্বপ্নময় আলোটা এসে দোলনচাঁপার গায়ের ফোঁটা ফোঁটা শিশিরে পড়েছে। বিন্দু বিন্দু জলকণা সাতরঙে জলছে টুকরো প্রিজমের মত। টুইইইই...করে কি একটা নীল ডানা পাখি উড়ে গেল কাঠগোলাপের ডাল ছেড়ে। ভীষণ মিষ্টি সুবাস নিয়ে এক ঝলক বাতাস ঘুরতে ঘুরতে রাজহাঁসের ডানার মত শুভ্র পর্দা উড়িয়ে জানালা বেয়ে এসে উইন্ড চাইমটায় টুংটাং ছন্দ তুলেছে। সেখান থেকে সুর ছড়িয়ে পড়ছে একে একে পুরো ঘরেই, ডাইনিং এর উল্টে রাখা বাসন আর চামচে, বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা খেলনা ব্রাইড এন্ড গ্রুম পুতুল দুটোতে, ড্রেসিং টেবিলের পাশে সাজানো ভর্তি ভর্তি চুড়ির আলনাটায়...এখানে ওখানে...টুংটাং...রিনিঝিনি...মোনা বিচিত্র সব সুর বাজায়, বেহালায়, বাঁশীতে, পিয়ানোতে...

................সুর আর ছন্দ আর আলো আর স্বপ্ন আর সুবাস................

স্বপ্নময় আলোটা জ্বলজ্বল করে মোনার চোখে। পাগল করা সুবাসে সে ভেসে যায়, ঘুরতে ঘুরতে এসে হাওয়াটা দুষ্টুমি খেলে মোনার চুলে। দুপায়ে ব্যালের ছন্দ তুলে সে হেঁটে বেড়ায় ঘরের এ প্রান্ত ও প্রান্ত। আর ঠোঁটের কোণে তার খেলা করে গভীর প্রশান্তি। মোনা সুখী...পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই...


'আসিফ কালও তুমি হটপটটা ভুলে গেছিলে। রোজ রোজ বাইরের হাবিজাবি খেলে শরীর খারাপ করবে না? তখন কিন্তু আমি দেখতে পারবো না বলে দিচ্ছি।'

'তাহলে কার কাছে গিয়ে আমি কাতরাবো মোনা বেগম? অফিসের নতুন সাইজ জিরো সুন্দরীর কাছে!'

'ছি ছি ছি! কিসব বল তুমি! মুখে একটু যদি লাগাম থাকে! ও কি, অমনিই যাচ্ছো যে...খাবারটা নিয়ে যাও না সোনা!'

মোনার একটা বাচ্চা নাই। কিন্তু আসিফকেই তার আগলে রাখতে হয় ছোট বাচ্চার মত। মোনা যতটা গোছাল, আসিফ যেন তার তিনগুণ এলোমেলো। মোনার সবকিছু নিয়মের মধ্যে শৃঙ্খলিত, আর আসিফ ছন্নছাড়া। এই বুড়ো বাবুটাকে সামলাতেই মোনার সারাবেলা চলে যায়। শান্ত-শিষ্ট, কিছুটা সুচিবাইগ্রস্ত, নিজের উল্টোমেরুর এই মেয়েটাকে আসিফ পাগলের মত ভালবাসে। মোনার উপরে সে ভীষণভাবে নির্ভর করে প্রতিটা কাজে। ওকে ছাড়া তার একটা দিনও চলে না। দুজন যেন দুটো গুটু গুটু চড়ুই পাখি!


মোনা ভেসে ভেসে বেড়ায় সারা ঘরে। তার গোলাপী পোশাকের প্রান্ত লুটিয়ে পড়ে। দূরে, বহু বহুদূরে বাঁশী বেজে চলে। মোনা কান পেতে শোনে, একটু হাসে...আবার প্রজাপতির মত ভাসতে থাকে। জানালার পর্দা সরাতেই বাগানটা হেসে ওঠে চোখের সামনে বিচিত্র সব রঙ নিয়ে। হাজার অনুরোধেও আসিফকে বাগানে যেতে রাজি করানো যায় না। কিন্তু সেই একটা খুরপি হাতে চন্দ্রমল্লিকার বেড খুচিয়ে দিচ্ছে। একবার হাতের উল্টোপিঠে সূর্য আড়াল করে মুখ উপরে তুলে সুন্দর করে হাসলও। নীল ডানার পাখিটা টুইইই টুইইই করে ডেকেই চলেছে অবিরাম।


'ফোন ধর না কেন এতক্ষণ ধরে? কই ছিলা? কতবার রিঙ হইসে জানো তুমি? আমিতো টেনসনে অস্থির!'

'স্যরি সোনা! বাইরে একটা পাখি এমন ডাকছিল, আমি এমন তন্ময় হয়ে গেছিলাম! ফোনের রিঙটোন আর পাখির ডাক মিলে মিশে গেল!'

'কোথায় পাও তুমি এইসব গাতক পাখি তুমিই জানো। একটা গাছপালা নাই বাড়ির ত্রিসীমায়, পাখি এসে বাসা করবে!'

'কিন্তু ডাকছিলতো, সত্যি!'

'আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। শুনো আমার দেরী হবে আজ ফিরতে। কিছু ফরেইন ডেলিগেটস আসবে। রেডিসনে তাদের এটেন্ড করতে যাওয়া লাগবে।'

'দেরী! আজও দেরী!'

'হ্যাঁ! কি বলছো? আচ্ছা ছাড়ছি এখন। খেয়ে নিয়ো তুমি। বাইইই।'


মোনা ধীরে ধীরে ফোন নামিয়ে রাখে হাত থেকে। এগিয়ে গিয়ে সামনের ঘরের দরজার হাতল ঘোরায়। মোনার হাওয়া ঘর! দরজা খুলতেই এক ঝলক বাতাস এসে ওকে ঝাপটে ধরে। দিগন্তরেখায় লুটিয়ে পড়া সূর্যের লাল আলোয় লালচে হয়ে ওঠে ঘর, মিষ্টি সুবাস লুটোপুটি খায় মোনার খোলা চুলে। হাত বাড়িয়ে মোনা দুহাতে জড়ায় জানালার শুভ্র পর্দা। বহু দূরে রাস্তায় দুহাতে শক্ত করে সাইকেলের হ্যান্ডেল আঁকড়ে ধরে সাত-আট বছরের একটা মেয়ে প্রাণ-পণে প্যাডেল চাপছে। তার খয়েরী বুটি বুটি জামাটার প্রান্ত উড়ছে পেছনে। উত্তেজনায় ফোস ফোস করে শ্বাস পড়ছে তার, মাঝে মাঝে হাতের উল্টো পিঠে সরাচ্ছে কপালে জমে ওঠা ঘামের ফোঁটা। মোনা রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে থাকে, ও পারবে...পারবেই...উৎকন্ঠায় তার নিজের কপালেও জমে ওঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম, নাকের দুপাশ ফুলে ফুলে উঠে ঘন শ্বাসে। দিনের আলো কমে আসছে, ছোট্ট মেয়েটার শরীর আবছায়া হয়ে আসতে আসতে একসময় মিলিয়ে যায়। মোনার জানা হয় না সে সত্যি পারল কি না...পারল কি না প্রতিযোগিতায় সবাইকে পিছনে ফেলে বহু বহুদূর যেতে। হতাশ হয়ে মোনা বসে পড়ে দেয়াল ঘেষে, গলায় যেন কি দলা পাকিয়ে ওঠে। ওর মনে হয় সেই বাচ্চা মেয়েটার সবাইকে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার উপরেই তার নিজেরও অনেক অনেক কিছু নির্ভর করছে। মোনা নিজেও তো চেয়েছিল একদিন, বহুদূর যাবে...বহু বহুদূর...আকাশ ছোঁবে...


'মোনা...মোনা...এ্যাই মেয়ে...কি হয়েছে তোমার? মেঝেতে শুয়ে আছো কেন? ঘরের বাতি জ্বালোনি, খাওনি, এমন কুঁকড়ে মুকড়ে মেঝেতে পড়ে আছো! শরীর খারাপ নাকি, হ্যাঁ?'

'না না...শরীর ঠিক আছে। কি যে হল, ঘুম চলে এসেছিল!'

মোনা নিজেকে গুছিয়ে নেয়। হাল্কা কিছু খাবার খেয়ে ঘরে এসে দেখে আসিফ শুয়ে পড়েছে। পাশে আধশোয়া হয়ে আলতো হাতে আসিফের চুলে হাত বুলায় মোনা। মোনার বুকে মুখ গুজে শ্বাসের মত ফিসফিসে স্বরে আসিফ বলে, 'কি হয়েছে তোমার আজকাল? এমন আনমনা কেন?'

'কিচ্ছু না...কিচ্ছু না...কিচ্ছু না...'

'মোনা আমাদের কি একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ না বলতো?'

'আমার ভীষণ ভয় করে যে! না জানি কি আসবে!'

'ভয় করলে কেমন করে হবে মোনা! আর আমিতো আছি।'

'আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?'

'পাগলি! কেন ভাবছো অমন?'

'ভয় হয়...বড্ড ভয়...ভীষণ অসহায় লাগে নিজেকে যখন তুমি থাকো না পাশে।'

'ভয় নেই মোনা। আমি আছি।'


'আদিত্য...আদিত্যওওওও...আদি...আদিইইইই...' অনেক অনেকক্ষণ ধরে মোনার কানে ইইইইই..টা প্রতিধ্বনি তোলে। আর খুব দুষ্টু একটা বাচ্চার খিলখিল হাসি। ফাঁকি দিতে পেরে বেজায় খুশি! মোনা ডেকেই চলে, 'আদিইইইইই...'
জানালা দিয়ে নিচে চেয়ে দেখে বাবা-ছেলে খুব মনোযোগে বাগানে প্রজাপতি ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাতরঙা একটা প্রজাপতির পিছনে তেমনি করে উড়ে চলেছে আদিত্য। আর পিছে পিছে আসিফ, মুখে কি পরিতৃপ্তির এক হাসি!


ঝননননননন্

'বুয়া কতদিন তোমাকে বলেছি একটু সাবধানে কাজ করো। যখন তখন থালা-বাসন ফেলে দাও হাত থেকে এটা কেমন কথা! আর একটু শান্ত হয়ে কাজ করা যায় না? কাজের সময় এত শব্দ করতে হয়!'

আজ আসিফের সব পছন্দের ডিস রান্না করছে মোনা। ফ্রাইড রাইস, চাইনিজ ভেজিটেবল, চিকেন কারি...


পাগলটার মনে আছে কি না আজকের দিনের কথা কে জানে! সারাদিন তো কাজ কাজ করে অস্থির হয়ে থাকে। পৃথিবীর সব কাজ মহাশয়ের একারই করতে হবে, আর কেউ নাই যেন! উফ্ কত দ্রুতই না সময় চলে যায়! পাঁচ পাঁচটা বছর চলে গেছে দেখতে দেখতে কোনদিক দিয়ে মোনা ভেবেই পায় না।

যদি মনে না থাকে! যদি ভুলে যায়! নাহ্ তাই কি হয়!

আজ মোনার হাওয়া ঘর আলোয় ভরে গেছে, মিষ্টি সুবাস ভরা বাতাস পাগলের মত লুটিয়ে পড়ছে মোনার পায়ে, চুলে, পোশাকের প্রান্তে। প্রজাপতির মত মোনা নেচে বেড়ায় পুরো ঘর। আজ মোনার বড় সুখের দিন! সেই সুখে নীল ডানার পাখিটাও গেয়ে চলেছে...টুইইইই...


'মোনা, আমি আজ ফিরতে পারবো না সোনা। তুমি খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ো, ওকে?' ফিরবে না...ফিরবে না...কি রিপোর্ট এসেছে টেস্টে?


তাড়াহুড়োয় ফ্রাইং প্যানের উপরটায় আগুন উঠে গেছে কেমন! উহ ছড়িয়ে পড়ছে! মোনার ঘরের ধবধবে সাদা পর্দা দাউ দাউ করে কমলা হয়ে গেল।


'আজকের দিন তুমি বাইরে থাকবে?'

'কেন? আজকে আবার কি?'


ভুলে গেলে আসিফ! ভুলে গেছো? ওহ আগুনটা কেউ নেভায় না কেন? মোনার সাজানো ঘরটা পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে! হাওয়ায় কণা কণা ছাই উড়ছে কেবল। হাওয়া ঘরের রঙ মুছে গেছে...ফুলের মিষ্টি সুবাস নেই...তীব্র পোড়া গন্ধ কেবল...

ক্লান্ত বিধ্বস্ত মোনা লুটিয়ে পড়ে মেঝেয়!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ ভোর ৪:৩৯
৪২টি মন্তব্য ৪২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×