এখানে কফিন পাওয়া যায়
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
দারুণ একটা দিন ছিল সেইদিন। বহুদিন পরে বন্ধুরা একসাথে হয়েছিলাম। পাস করে বেরুনোর পরে চাকরি-বাকরি, সংসার, ব্যক্তিগত জীবনে সবাই এতটাই ব্যস্ত যে বন্ধুদের সময় দেয়া হয়ে ওঠে না। এমন কি আজকাল কেউ সেটা অনুভবও করে না। তাই কোন একজনের মাথায় যখন চিন্তাটা এলো ধরেই নেয়া হয়েছিল প্রতিবারের মত ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে এবারো গেট টুগেদারটা বাতিল করে দেয়া হবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সবাই-ই রাজি হয়ে গেলো এবং এটাতেও একমত হল যে সবাই একাই আসবে। সাথে একখানা লেজুর থাকলে ঠিক প্রাণ খুলে কথা বলা যায় না।
খুব উচ্ছল ছিলাম আমরা সেইদিন। ঠিক ছাত্রাবস্থায় যেমন ছিলাম আরো বছর দশেক আগে। অকারণেই হাসছিলাম, হই হই রই রই করছিলাম, যা দেখছিলাম তাতেই মজার কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম, যেদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। এমনকি কখনো সখনো বেশ অশ্লীল রসিকতাও করছিলাম। প্রত্যেকের চেহারাতেই একটা উজ্জ্বল ভাব ফিরে এসেছিল। মনে হচ্ছিল আমাদের মুখে আঁটা মুখোশটা যত্ন করে খুলে রাখা হয়েছে একপাশে।
কর্মক্ষেত্রে সফলতার ভিত্তিতে সবার চলন বলনেই পরিবর্তন এসেছে। কারো কারো নিজস্ব গাড়ি হয়েছে, কেউ অফিস থেকে পেয়েছে আর কেউ চলে ট্যাক্সি ক্যাব বা সিএনজিতে। এখন আর কেউ লোকাল বাসে বাদুড়ঝোলা হওয়ার কষ্ট করে না। কিন্তু সেইদিন আমরা ঠিক করেছিলাম আগেকার মত দল বেঁধে বাসেই উঠবো। কিছু প্রায় মাঝবয়সী লোকের ক্রমে উঁচু হতে থাকা কন্ঠস্বর, হই চই, চিৎকার, হাসাহাসি বাসের লোকজনকে বিরক্ত করে তুলছিল। আর তাতে আমরা অন্যরকম আনন্দ পাচ্ছিলাম। এরমাঝেই একজন একটা খেলা বের করে নিল, বাসের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যেকোন সাইনবোর্ড আর দেয়াল লিখনের লেখা জোরে জোরে পড়তে থাকা, যতক্ষণ দেখা যায়। কত যে বিচিত্র কথা লেখা! সেসব শুনে হাসির না হলেও বাকিরা হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
সিগন্যালে বসে থেকে এমনি একটা দেয়াল লিখনের দিকে একজন মনযোগী হয়ে উঠল। দুই লাইনের লেখা, শুধু একপাশের উপর-নিচের দুটো শব্দ
"এখানে.......
পাওয়া........",
কি পাওয়া যায় এখানে? এই চারটা শব্দ বিশেষভাবে একটা বক্স করে লেখা। বাসের জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে, কাত হয়ে, চিত হয়ে আমরা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। এবং অবশেষে শব্দটা উদ্ধার করা গেল। সজীব, আমাদের মধ্যে সফলতম বন্ধুটি গলা মোটা করে জোরে জোরে উচ্চারণ করল,
"এখানে কফিন
পাওয়া যায়"।
খুব আনন্দের মধ্যে হঠাৎই আমাদের বুকের ভেতর একটা হিম অনুভূতি হল। সবাই চুপ হয়ে গেলাম একসাথে। কেউ কারো চোখের দিকে তাকাচ্ছে না, যেন আরেকজনের চোখে তাকালে আয়নায় নিজেকেই দেখা হয়ে যাবে। সেকেন্ড তিরিশের একটা অস্বস্তিকর বিরতি। তারপরেই হেসে উঠে হালকা করার চেষ্টা করলাম পরিবেশ।
'হা হা হা! কার লাগবে রে কফিন? কফিনে শুয়ে জোছনা দেখবি নাকি আজ রবিবারের মামার মতন?' আজ রবিবার শুনে কৈশোরের নস্টালজিয়া পেয়ে বসল, স্মৃতিচারণ শুরু করলাম সেই নাটকের বিভিন্ন ঘটনার, হাস্যরসাত্মক সংলাপের এবং কৈশোরের প্রথম প্রেম শীলা আহমেদের। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে গেলাম পুরো ঘটনাটা। এইভাবেই বহুদিন পরে একটা দিন মুখোশের আড়াল থেকে নিজেকে বের করে এনে একেবারেই নিজেদের মত কাটালাম আমরা।
আজ আমি বাসায় একা। বাচ্চাটাকে নিয়ে স্ত্রী বাপের বাড়ি গেছে কিছুদিনের জন্য, কোন এক তুতো ভাইয়ের বিয়ে খেতে। বেশ কিছুদিন সেখানেই কাটাবে। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে আমারই রাজত্ব। ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি আর কয়েক জায়গায় আড্ডাবাজি করে রাত এগারটা পার করে বাসায় ফিরলাম। তারপরও যেন ক্লান্তি খুব একটা স্পর্শ করতে পারছে না আমাকে, বরং বেশ চাঙা অনুভব করছি। লিভিং রুম থেকে ডাইনিং, ডাইনিং থেকে কিচেন, কিচেন থেকে বেডরুম, সেখান থেকে ব্যালকনি...আমার অবস্থাটা যেন অনেকটা 'কি করি আজ ভেবে না পাই'। স্থির হতে পারছি না কিছুতেই। এরকম ফাঁকা বাড়ি অহরহ পাওয়া যায় না। তাই এ সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি কিছুতেই। আগেই যোগাড় করে রাখা ব্র্যান্ডির বোতলটা বের করে আনলাম, লিভিং রুমের টেবিলে সুন্দর করে স্ন্যাকস, বোতল, গ্লাস, টুকরো বরফ সাজিয়ে বেশ আয়োজন করে বসলাম। ডিমলাইটের নীলচে মদির আলো, আর ডিভিডিতে চলছে এডাল্ট মুভি। আহ্ এ যেন এক স্বপ্নময়, স্বর্গীয় অনুভূতি!
জানি না কতক্ষণ কেটেছে, আমি তখন উত্তেজনার চরমে, পৌঁছে গেছি নেশার চূড়ায় এমন সময় টিভি স্ক্রীনের আলো কমে আসতে লাগল হঠাৎ করেই। থেমে গেল চরম উত্তেজিত নায়ক-নায়িকা, আস্তে আস্তে তারা নিস্তেজ হয়ে পড়ল একে অপরের বাহুতে। তারপরে দুজনেই মুখ তুলে সরাসরি তাকাল আমার চোখে। কি নিষ্প্রাণ, ঘোলাটে দৃষ্টি তাদের চোখে! আমার বুকের ভেতরটা বরফের মত হিম হয়ে গেল। নিস্তেজ, প্রাণহীন গলায় কথা বলে উঠল তারা, 'আমরা ফিরে যাচ্ছি আমাদের অন্তিম গন্তব্যে। তুমিও চলে এসো। দেরি করো না।' বিস্ফোরিত চোখে দেখলাম তারা হাত ধরাধরি করে পিছনে রাখা একটা কফিনে শুয়ে পড়ল। একটা দোকানের সামনে রাখা কফিনটা, সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা "এখানে কফিন পাওয়া যায়"।
জান্তব একটা চিৎকার বের হয়ে এল আমার গলা থেকে, ঘরে এসি চলা সত্ত্বেও দরদর করে ঘেমে গোসল হয়ে যাচ্ছি, হাতের গ্লাসটা এত জোরে চেপে ধরেছি যে ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে, কেটে গেছে হাত। কিন্তু কোন ব্যথা অনুভব করছি না আমি আর। ভয়ানক আতঙ্কে ক্রমাগত গোঁ গোঁ করে চলছি তখনও, মুখে ফেনা জমছে। এবং তারপরে হঠাৎই অন্ধকার হয়ে গেল সব।
মোবাইলের একটানা কান্নায় বহুকষ্টে যখন চোখ মেললাম সকাল হয়ে গেছে। পড়ে আছি মেঝেতে, হ্যাঙ ওভারের প্রতিক্রিয়ায় মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। গতরাতের ঘটনা আবছা মনে পড়ছে। ভাবতে চাইলাম যা দেখেছি সবই মদ্যপ অবস্থার ফলাফল। হাত বাড়াতে যেতেই ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম, গ্লাসের ভাঙা টুকরোগুলো ঝিন ঝিন শব্দ করছে আশে পাশে। উঠে বসলাম অনেক চেষ্টার পর। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি টেন মিসডকলস, রিনা, আমার স্ত্রী। কলব্যাক করার ইচ্ছে হল না। ডিভিডি প্লেয়ারটা চলে চলে শেষ হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে আরেকবার চালিয়ে পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছাটা সংবরণ করলাম। উত্তপ্ত মস্তিষ্কের এসব চিন্তাকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। আমি বাস্তববাদী, উচ্চাকাঙ্খী মানুষ। আমার সামনে একটা দীর্ঘ, কর্মব্যস্ত দিন অপেক্ষা করে আছে।
কিন্তু দিন শেষে একা ঘরে ফিরতে খুব অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। যেন কেউ পথ চেয়ে আছে সেখানে আমার। অশুভ, অশরীরি, ভয় জাগানিয়া কেউ। রিনা আর বাবুয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম, ছেলেকে আদর করে আমি বাবুয়া ডাকি। এতটা অরক্ষিত নিজেকে কখনো লাগেনি। যেন বড্ড ক্লান্ত আমি, একটা ঘুম চাই, নির্বিঘ্ন, শান্তিময়, অন্ধকার, শব্দহীন; ঠিক যেমনটা থাকে কফিনের ভিতর। জীবনের বিলাসিতাকে অতিমাত্রায় ভালবেসে যারা আঁকড়ে ধরে কঠিনভাবে মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখাবার ভয় তাদেরই সবচেয়ে বেশি। শান্তিময়, নির্বিঘ্ন ঘুম তাদের জন্য অভিশাপ।
রাতের নিস্তব্ধ ফ্ল্যাটে আবার সেই ভয়টা ফিরে এলো। সবগুলো ঘরের আলো জ্বেলে দিয়ে বসে রইলাম লিভিং রুমের সোফায়। ঘাড়ের পেছনটা শিরশির করতে লাগল পেছনে কোনকিছুর উপস্থিতি টের পেয়ে। বারকয়েক ঝট করে ঘাড় ঘোরালাম। পেছনের দেয়াল থেকে বাবুয়া উচ্ছ্বসিত হাসিমুখে চেয়ে রইল। জানি কেউ নেই, কিছু নেই, সমস্তই আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। তারপরও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। তিন ঘন্টার মধ্যে রিনাকে সাতবার ফোন করা হয়ে গেল। 'কিছু না, মনে পড়ছে খুব তোমার কথা। তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারি না জানো তো!' এইসব তরল কথা বলেও পার পাওয়া গেল না। কোথাও যে কিছু গোলমাল হয়েছে রিনা ঠিকই টের পেয়ে গেল। খুব শিগগিরই সে ফিরে আসবে বলে জানাল। মুখে বারবার না করলেও মনে বেশ সাহস ফিরে পেলাম। স্বস্তিটা ফিরে আসতেই ঘুমও এলো চোখ ছাপিয়ে।
তখন কত রাত জানি না। ভারী গম্ভীর একটা হুম হুম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। যেন কেউ খুব কষ্টে গাঢ় শ্বাস ফেলছে খুব ধীরে, আর তারই ফাঁকে হুম হুম করে যাচ্ছে। চোখ মেলে দেখি গাঢ় অন্ধকার, কোথায় আছি বুঝে উঠবার আগেই হাতে প্রচন্ড টান অনুভব করলাম। সেইসাথে গোঙানি বেড়ে গেল, কেউ যেন ডেকে চলেছে 'আয়, আয়' বলে। প্রচন্ড আতংকে হাত-পা হিম হয়ে এলো, মনে হচ্ছে বিছানার ভেতরে সেঁধিয়ে যাই। কিন্তু সেটা করা সম্ভব হল না। প্রচন্ড শক্তিতে কেউ যেন আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল শোবার ঘর লাগোয়া ব্যালকনিতে। বাড়ির পিছনদিকের এই প্লটটা ফাঁকা, কিছু ঝোপ-জঙ্গল মাথাচাড়া দিয়ে আছে শুধু। বাইরে ঘুটঘুট্টে অন্ধকার, এমনকি মিউনিস্যাপিলিটির বাতিগুলোও জ্বলছে না। কিছুক্ষণ পরে অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই বুঝলাম আমার দৃষ্টিপথ আটকে রেখেছে একটা বিশাল কাল কফিন। ব্যালকনির সামনের অংশটায় শূণ্যে ভেসে রয়েছে সেটা, ডালাটা হা হয়ে আছে। যেন গিলে নিতে চাইছে আমাকে। আর কোন এক আসুরিক শক্তি হাত-পা ধরে আমাকে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে কফিনের ভেতর। তীব্র আতংকে আমি হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করলাম, সেইসাথে চিৎকার। কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না। অসহায়ভাবে গোঁ গোঁ করতে লাগলাম শুধু। আমার গলা বুজে আসতে লাগল, দম বন্ধ হয়ে এলো। তারপরে আর কিছু মনে নেই। এ্যালার্ম ক্লকের একটানা শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। সমস্ত শরীরে প্রচন্ড ব্যথা।
অফিসের এ্যানুয়াল মিটিং এর প্রস্তুতির জন্য কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার খুব একটা তাড়াও অনুভব করছিলাম না অবশ্য। শূণ্য ঘরে আবার সেই জান্তব ভয়েরা ফিরে আসবে সে আশংকাতো ছিলই মনে। রাত সাড়ে বারটায় যখন ডেস্ক থেকে মাথা তুললাম, পুরো অফিস ফাঁকা। কোন প্রাণের সাড়া নেই। আমার সামনে সারি সারি কিউবিকল দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এতক্ষণ টের পারি নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এসির বাতাসটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই ঠান্ডা। হালকা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল সারা গায়ে। আমার ডেস্কের উপর ছাড়া বাকি সবগুলো বাতিই নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। হালকা আলো দেখা যাচ্ছে বাইরের করিডোরে। ল্যাপটপ আর ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এক হাতে বাতিটা নিভিয়ে দিলাম বেরুবো বলে। সাথে সাথেই হিসহিসে একটা বাতাস বয়ে এলো ফ্লোরের শেষ মাথা থেকে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। পড়ি মরি করে ছুটলাম দরজার দিকে, এই টেবিল, ওই দেয়ালে বাড়ি লেগে পায়ে ব্যথা পেলাম কয়েক জায়গায়। সেসব তোয়াক্কা না করে এক ছুটে এসে উঠলাম লিফটে, সাঁই সাঁই করে লিফট আমাকে নিয়ে এলো আন্ডার গ্রাউন্ড কার পার্কে।
কার পার্কের হলদে মরা আলোয় পুরো আন্ডার গ্রাউন্ড রহস্যময় দেখাচ্ছে। আমি পাগলের মত আমার গাড়িটা খুঁজতে শুরু করলাম আরো গাড়ি, জীপ আর ডেলিভারী ভ্যানের ভেতর। এমন সময় মনে হল একঘেয়ে একটানা সুরে কেউ ডেকে চলেছে, 'আয়, আয়, আয়, আয়...'। একজন দুজন করে কোরাসে গলা বাড়তে লাগল। শত শত মানুষের কন্ঠে 'আয়, আয়' ডাকের আওয়াজ বাড়তে লাগল। সরাসরি মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত হানতে লাগল সেই ডাক। গাড়িগুলো সব উধাও হয়েছে, সেখানে মুখ হা করে দাঁড়িয়ে আছে রাত্রিকাল সব কফিন। আর তাদের পাশে পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছায়ার মত কিছু অবয়ব। সাদা পোশাক পরা দেহ, ভাবলেশহীন চোখ, আর সমতল মুখ। চোখ ছাড়া আর কিছু নেই সে মুখে। তারা প্রত্যেকেই ডাকতে থাকে আমাকে, ' আয়, আয়। এইখানেই তোর ঠিকানা, এইখানেই চির শান্তি। আয়, আয়। দেরি করিস না। আর সময় নাই।' আমি সংজ্ঞা হারালাম সেখানেই।
এত কষ্ট করে সমস্ত প্রিপারেশন নিয়েও এ্যানুয়াল মিটিং এ এ্যাটেন্ড করা হল না। প্রচন্ড অসুস্থ অবস্থায় সকালে লোকজন আমাকে উদ্ধার করে কার পার্ক থেকে। প্রচন্ড জ্বর, সমস্ত শরীরে ব্যথা, অনবরত প্রলাপ বকছিলাম আমি। যার বিষয়বস্তু একটাই, 'কফিন'। আমি আমার আশে পাশে কফিন দেখতে লাগলাম ক্রমাগত। অশরীরী ছায়ামানবেরা প্রায়ই আমাকে ডাকতে লাগল 'আয়, আয়' বলে। হাসপাতালের শুভ্র দেয়াল আর বিছানা যেন নতুন আতংক হয়ে দেখা দিল আমার কাছে। মাঝে মাঝেই মনে হতো সাদা বিছানার চাদর কাফনের কাপড় হয়ে জড়িয়ে ধরছে আমাকে। আমার গলা থেকে পাশবিক চিৎকার বের হয়ে আসতো। এক মুহূর্তের জন্য রিনাকে চোখের আড়াল হতে দিতাম না। বাবুয়া ভয় পেতে শুর করল আমাকে। অবশেষে একদিন নিস্তার পেলাম সেই যন্ত্রণা থেকে। বাড়ি ফিরে এলাম।
তারও দুই মাস পরে অফিস করতে শুরু করলাম। কেউ আমাকে সরাসরি কোন প্রশ্ন করতো না, শুধু চোখে নির্লজ্জ কৌতূহল আর অসহ্য করুণা নিয়ে তাকিয়ে থাকতো, কানাকানি করতো আড়ালে। মুখ বুজে সব সয়ে যেতাম। কথা কম বলতাম, একা একা থাকতে শুরু করলাম। একাকীত্বের সুযোগে পুরনো আতংক ফিরে এল আবারও। রাস্তাঘাটে হঠাৎ সাইনবোর্ড দেখতে লাগলাম "এখানে কফিন পাওয়া যায়", অফিসের করিডোরে, লিফটের ভেতর, নিজের শোবার ঘরে জলজ্যান্ত একটা কফিন অহরহই শুয়ে থাকতে লাগল। সেখান থেকে বারবার সেই একই আহ্বান ভেসে আসে, 'এসো, এখানে চিরশান্তি। এটাই শেষ ঠিকানা। এসো, দেরি করো না'।
আমি আরেকটু সময় চাই। জীবনকে বড় ভালবাসি যে! চাকরিক্ষেত্রে সফল আমি, ছোট সুখের একটা সংসার, প্রেমময়ী স্ত্রী, দেবশিশুর মত সন্তান আমার বাবুয়া। এত তাড়াতাড়ি আমি কি করে ঘুমাই! আরো কত দূর যেতে হবে আমার, কত পথ পাড়ি দিতে হবে। অফিসের এমডি হওয়ার স্বপ্ন লালন করছি কতদিন হল, বাবুয়াকে একটা সুন্দর নিশ্চিত ভবিষ্যৎ দিয়ে যেতে হবে। আমি না থাকলে আমার স্ত্রী যদি অন্য কারো সঙ্গীনি হয়! সেটাই বা কি করে সহ্য করবো? আরেকটু সময় চাই যে আমার।
ভয়ে মুখ গুজি রিনার বুকে, সাহস খুঁজি বাবুয়ার হাসিতে। নিজেকে প্রবোধ দেই এই সবই ভুল, আমার কল্পনা। জীবনকে ভালবাসি বলেই মরে যেতে ভয় পাই। ভয় থেকে নিরাপত্তাহীনতা, আর সেখান থেকেই এইসব অবাস্তব অর্থহীন কল্পনা। তাতে আমার একটা লাভই হয় প্রতিবার, আমি আরো বেশি করে শুনি সেই অমোঘ ডাক। আমার অপরাধতো কম নয়। জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যকে নিয়ে রসিকতা করেছিলাম, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। তাই এখন তার তাড়া খেয়ে ফিরছি। এই আমার শাস্তি, এই আমার প্রায়শ্চিত্ত।
মাসছয়েক পরের কথা। আমার থলথলে দেহটা শুকিয়ে জীর্ণ হয়ে গেছে, তেল চকচকে ত্বক বিবর্ণ, চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, মাথার চুল পড়ে মাথায় টাক প্রায়। খাওয়া, ঘুম, কাজ-কর্ম সব বন্ধ। ঘরেই বন্দী থাকি বেশিরভাগ সময়। একদিন ফেসবুকে একটা গ্রুপ মেসেজ পেলাম, আমার দশজন বন্ধু দেখা করতে চাইছে। সন্ধ্যায়, আমাদের পুরনো আড্ডায়। সেই দশজন, যারা আড়াই বছর আগের ঝলমলে একটা দিন একসাথে কাটিয়েছিল।
যাবো না যাবো না করেও শেষ মুহূর্তে গিয়ে পৌঁছালাম। ওরা চলে এসেছিল আরো আগেই। কেউ কাউকে কিছু বলিনি, অন্যদের দিকে তাকিয়ে যেন আয়নায় নিজের মুখই দেখছিলাম। প্রত্যেকের চোখে শুয়ে আছে গভীর কাল এক কফিন, এক ভয়াল, অশুভ ছায়া হয়ে। নিরবে বসে থাকি আমরা দশ বন্ধু।
৩০টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
উৎসব মণ্ডল বেঁচে আছেন: সে সেনা তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন। (সাময়িক)
খুলনায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে উন্মত্ত জনতার হা’মলায় আহত উৎসব মন্ডল সামরিক হাঁসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
উৎসব মন্ডল এর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বেশ ভালো। চিকিৎসকরা খুব আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা দিচ্ছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
যে গল্পের শেষ নাই.....
যে গল্পের শেষ নাই.....
পাসের সীটের যাত্রী সাথে আলাপচারিতায়- নাম জানার পর, জিজ্ঞেস করলাম- "বাড়ি কোথায়?"
ছেলেটি বলল- 'ঝালকাঠী, কীর্ত্তিপাশা গ্রাম।' কীর্ত্তিপাশা শুনেই বুকের ভিতরে উথাল পাথাল ঢেউ- এক কিশোরীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
জুলাই গণহত্যায় শেখ হাসিনার বিচার সরাসরি সম্প্রচার করা হবে!
"জুলাই গণহত্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার সরাসরি সম্প্রচার করবে সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শিগগিরই এই বিচার কার্যক্রম শুরু হবে।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) উচ্চ পর্যায়ের এক... ...বাকিটুকু পড়ুন
=কয়েন প্লান্ট বা পয়সা পাতা (বৃক্ষ পরিচিতি)=
০১। কয়েন প্লান্ট ( Hydrocotyle vulgaris)
কয়েন প্লান্ট বা পয়সা পাতা গাছ। দেখতে আগের দশ পয়সার মত এর পাতা। গাছগুলো খুব ঝুপালো হয়। পাতা গাঢ় সবুজ রংয়ের। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট হচ্ছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট!
আজ রাতে, ট্রাম্প ও কমলার মাঝে ডিবেইট!
দেশের সর্বোচ্চ পদের চাকুরীটার জন্য ৩য় বিশ্বে ডিবেইট হয় না; ফলে, বাংলাদেশের মানুষ কঠিন রাজনৈতিক ডিবেইট দেখার সুযোগ কখনো পাননি। আজকের... ...বাকিটুকু পড়ুন