খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/বর্গী এলো দেশে। অষ্টাদশ শতকের অশ্বারোহী লুটেরা মারাঠা সৈন্যদলের নাম বর্গি। বলা যায় ডাকাতের প্রতিশব্দ। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের সেই দিন আর নেই। যার কারণে বর্গী শব্দটার সঙ্গেই নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হচ্ছে। সভ্যতার(!) উত্কর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে দস্যুবৃত্তির প্যাটার্ন। গুম, খুনের জন্য আজ আর খোকা ঘুমানো কিংবা পাড়া জুড়ানোর দরকার হয় না। যখন তখন চাইলেই যাকে তাকে হাওয়া করে দেয়া যায়। লোকমুখে শুনা যায়, বহু সংখ্যক মানুষের এই হাওয়া হওয়ার পিছনে নাকি বিশেষ পোশাকের একদল সুঠামদেহীর হাত আছে। এই সুঠামদেহীদের আবার নিয়ন্ত্রণ করে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, ব্যাপক ক্ষমতাধর এক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের হাতেই রাজদণ্ড। অবশ্য এই গুম কালচারটাকে খুব নেতিবাচকভাবে দেখারও কিছু নেই। একজন রাজা নিজের সুরক্ষার জন্য চাইলে যে কাউকে গুম করতেই পারেন। বরং রাজার নির্দেশে গুমের বিরুদ্ধে কথা বলার দায়ে লাখ খানেক মানুষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহের দায়ে হুলিয়া জারি হওয়াও অসম্ভব নয় বৈকি। যাই হোক রাজাকে সুরক্ষিত রাখা তো নাগরিকদের একান্ত কর্তব্য। কতক লোকের গুম-খুনে কিইবা যায় আসে?
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বাসায় ফেরার পথে গাড়ির চালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন বিরোধীদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা। নাম এম ইলিয়াস আলী। বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদ টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে নিজ এলাকায় ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করেছিলেন জাঁদরেল এ বিএনপি নেতা। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির ঠিক একদিন আগে গত ১৬ এপ্রিল আবু বকর সিদ্দিক নামের একজন গার্মেন্ট কর্মকর্তা হঠাত্ই হাওয়ায় মিলে গেলেন। ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবস হলেও বাংলাদেশে যেন ১৫-২১ এপ্রিল পালিত হয় জাতীয় গুম উত্সব। যাই হোক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সন্ধান মিলছিল না আবু বকর সিদ্দিকের। রাতে নারায়ণগঞ্জের জামতলা এলাকার আবুল কালাম নামের এক ব্যক্তি জানালেন দুপুর বেলায় তার সামনেই জনৈক ব্যক্তিকে নীলরঙা গাড়িতে তুলে নেয় টি-শার্ট পরা কতক যুবক। নিখোঁজ আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী এশিয়ার নোবেলখ্যাত ম্যাগসাইসাই পুরস্কার জয়ী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বরেণ্য এ পরিবেশ আইনজীবির স্বামীর চিন্তায় ঘুম হারাম হয় নাগরিক সমাজের। নাগরিকদের চাপে শেষ পর্যন্ত নিখোঁজের ৩৫ ঘণ্টা পর খুঁজে পাওয়া যায় নিপাট ভদ্রলোক আবু বকর সিদ্দিককে। স্বামীকে উদ্ধারে পাশে থাকার জন্য গণমাধ্যম, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রধানমন্ত্রী ও আরেক বৃহত্ রাজনৈতিক দল বিএনপি নেত্রীকে ধন্যবাদ জানান রিজওয়ানা।
জীবন সঙ্গীকে ফিরে পেয়ে এই বোনের হূদয়ের রক্তক্ষরণ কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু দুই বছরেও রক্তক্ষরণ থামছে না ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনার। আবু বকর সিদ্দিকের মতো ইলিয়াস আলীও ফিরে আসবেন— এমন আশায় হয়তো এখনো বুক বেঁধে আছেন ইলিয়াস পরিবারের সদস্যরা। ভিন্নমতের রাজনীতিক ছাড়াও গুম হচ্ছেন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ছাত্র, শিক্ষক তথা নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ফলে একটা অজানা আতঙ্কে দিন কাটছে বহু পরিবারের। যে আতঙ্কের সর্বশেষ শিকার আবু বকর সিদ্দিক। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার গত ১৫ এপ্রিল তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ৩৫ জন নাগরিক গুম হয়েছেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আরো ৬ জন গুম হয়েছেন অভিযোগ তাদের স্বজনদের।
আবু বকর সিদ্দিক অপহরণকারীদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এটা অবশ্যই সুসংবাদ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গুম হওয়া শতাধিক মানুষের কথা চিন্তা করে আমি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারছি না। তাহসিনা রুশদীর লুনার মতো আমরাও আশায় থাকবো গত ৪ বছরে গুম হওয়া ১৮৭ জনের পরিবার শিগগিরই তাদের প্রিয়জনকে ফিরে পাবেন। ১২ বছরের মেয়ে সাইয়ারা নেওয়ালকে কোলে তুলে ইলিয়াস আলী বলবেন— তোমার জন্যই আমার ফিরে আসা মামনি। আর তোমাকে আমার অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মন খারাপ করতে হবে না। এভাবেই প্রিয়জনকে মন খারাপের রাজ্য থেকে ছুটি দেবেন বহু দিন, মাস, বছর ধরে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া মানুষেরা।
গুমরাজ্য থেকে প্রত্যাবর্তনকারী মানুষদের সঙ্গে নিয়ে আমরা একটি নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে এগিয়ে যাবো। তখন আর কেউ বলবে না— ১৫ থেকে ২১ এপ্রিল বড্ড খারাপ সময়। কারণ এ সপ্তাহটা জাতীয় গুম উত্সব। সময়টা আতঙ্কের, বিভত্সতার, সভ্য সমাজে অসভ্যতা, বর্বরতা ফিরিয়ে আনার। আমরা বলবো সাইয়ারা নেওয়ালদের চোখের পানিতে আর কোনো মহাসাগর সৃষ্টি হবে না। গুম উত্সব বলে কিছু থাকবে না। কেউ কেউ হয়তো তখন ‘গুমরাজ্য বিদায় সপ্তাহ’ পালন করবেন। সবার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হোক। নতুন করে আর একটি মানুষও যেন কোথাও হারিয়ে না যায়।
facebook.com/JournalistMesbahPatwary
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ২:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


