করোনার বিপর্যয়ের মধ্যেই বিশ্বরাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। সেটা হল আমেরিকার তীব্র নিষেধাজ্ঞা ও হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে ৪৫.৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাসোলিন ও অন্যান্য পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ পাঁচটি সুপার ট্যাংকারে করে সুদূর ভেনেজুয়েলার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছে ইরান। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুসারে দুইটা ট্যাংকার ইতোমধ্যেই ভেনেজুয়েলার ইআই পালিটো বন্দরে পৌঁছে গেছে। ঘটনাটা বিশ্বরাজনীতিতে নানাদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ইরান ও ভেনেজুয়েলা উভয় দেশের উপর আমেরিকার কঠোর তেল নিষেধাজ্ঞা কার্যকর আছে। অর্থাৎ বিশ্বের অন্য কোন দেশ এই দুটি দেশের কাছে তেলজাত পণ্য যেমন রপ্তানি করতে পারবে না তেমনি এদের থেকে আমদানিও করতে পারবে না। এই অবস্থায় আমেরিকার কঠোর নিষেধাজ্ঞা যেখানে বিশ্বের প্রায় সব দেশই অনুসরণ করতেছে সেখানে আমেরিকার উঠান দিয়ে আমেরিকার নাকের ডগায় ইরান সুদূর ভেনেজুয়েলায় তেল পাঠাচ্ছে এটা আমেরিকার জন্য রীতিমত চ্যালেঞ্জ।
আমেরিকা প্রথমে হুমকি দিয়েছে এবং ক্যারিবিয়ান সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে বলে খবর প্রকাশ হওয়ার পর ইরান ও ভেনেজুয়েলা উভয় দেশের পক্ষ থেকে পাল্টা হুমকি এবং ইরানের পক্ষ থেকে পারস্য উপসাগরে আমেরিকাকে একই পরিণতি বরণ করতে হবে বলে হুশিয়ারি দেওয়ার পর লেজ গুটিয়ে নেয় আমেরিকা। উল্লেখ্য গত বছর আমেরিকার অনুরোধে জিব্রালটার প্রণালীতে ইরানের সিরিয়াগামী একটা তেলবাহী জাহাজ আটক করেছিল ব্রিটেন। এর জবাবে টিট ফর ট্যাট হিসাবে ব্রিটেনের একটি তেলবাহী জাহাজ আটক করেছিল ইরান।
পাঁচ পাঁচটা সুপার ট্যাংকারে করে ইরানের তেল জাত পণ্য ভেনেজুয়েলায় পাঠানো এই জন্য বিশ্ব রাজনীতিতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ যে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পতনের যে শুরু হয়েছে তার সুস্পষ্ট নানা প্রমাণের মধ্যে এটা হল আর একটি ঘটনা।
আমেরিকা তার প্রতিদ্বন্ধী দেশগুলোর সরকার উৎখাত এবং অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা একটা সফট উইপোন হিসাবে ব্যবহার করে। ইরান ও ভেনেজুয়েলার মধ্যেকার তেল বাণিজ্যের মাধ্যমে সেই নিষেধাজ্ঞার অস্ত্রকে ভোতা করে দেওয়া হল। এরপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো উৎসাহিত হবে। অন্তত মার্কিন বিরোধী দেশগুলো উপলব্ধি করবে নিজেদের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চালু রাখতে এবং এক দেশের বিপদে আর একদেশের এগিয়ে আসাতে আর কোন ভয় নেই। এতে দেশে দেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ধ্বসে পড়বে।
আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে ইরান ও ভেনেজুয়েলার এই তেল বাণিজ্যর মাধ্যমে। আমেরিকা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে ভেনেজুয়েলার তেল শোধনাগারগুলো সংস্কার, উন্নয়ন ও তেল রপ্তানির বিনিময়ে ইরান ভেনেজুয়েলা থেকে স্বর্ণ নিয়ে আসছে। এভাবে ডলারের বিপরীতে আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে পুনরায় স্বর্ণ চালু শুরু হলে তা হবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পতনের জন্য শেষ পেরেকের উপর হাতুড়ির শেষ বাড়ি। ঠিক এই জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বারবার ইরান ও ভেনেজুয়েলার বিনিময় মাধ্যম হিসাবে স্বর্ণের কথা বলে উদ্বেগ জানাচ্ছেন।
এই তেল বাণিজ্যের প্রত্যক্ষ ফলাফল হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করে ইরানকে বশে আনার যে চেষ্টা এবং ভেনেজুয়েলায় সরকার উৎখাতের যে পরিকল্পনা করেছে তা এখন গুড়ে বালি। ইরান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নত হয়ে নানাভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করতে সক্ষম হলেও তেল অবরোধের কারণে ভেনেজুয়েলা পড়েছিল চরম বিপদে। আমেরিকা চেয়েছিল জনগণকে উস্কে দিয়ে জুয়ান গুয়াইডোকে জনপ্রিয় করে ভেনেজুয়েলাকে অস্থিতিশীল করে মাদুরো সরকারের পতন ঘটানো।নিষেধাজ্ঞার কারণে রিফাইনারিগুলো সংস্কারের অভাবে অকার্যকর হয়েছিল।মার্কিন রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইরান সবদিক দিয়ে ভেনেজুয়েলার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে আমেরিকার পরিকল্পনা নিশ্চিৎ ভেস্তে গেল।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২০ রাত ৮:২০