ভাষা আন্দোলনের দিনপন্জী - ৪ এ থাকছে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির দিনপন্জী । এখানে উল্লেখ্য যে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের প্রায় সকল সূত্রেই ১৯৪৯-৫০ এর ঘটনাবলী উপেক্ষিত এবং অনুল্লেখিত । অথচ এই সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী ভাষা আন্দোলন এবং তার ভিত্তিতে পরবর্তীতে স্বাধিকার এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ।
৯ মার্চ ১৯৪৯ : পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে সরকারী কর্মকান্ড ও শিক্ষার একমাত্র ভাষা এবং সেই সাথে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার অব্যহত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দিনের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে আরবী হরফে প্রচলন করার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দেয় । প্রস্তাবের মুল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুয়ানী বাংলা হরফ থেকে বাংলাকে মুক্ত করে ইসলামী ভাবাদর্শের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ আরবী হরফে বাংলা লেখা প্রচলন করা । এই লক্ষ্যে ৯ মার্চ ১৯৪৯ মৌলানা আকরাম খানকে চেয়ারম্যান করে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয় । (১)
এই লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার একটি বড় আকারের ফান্ড গঠন করে এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্লামেন্টে এর সপক্ষে বলেন "“The board is of the opinion that in the interest of national unity and solidarity and the rapid advancement of general education in Pakistan, it is necessary to have all the regional languages of Pakistan written in the same script; the Arabic script was most useful for this purpose…" (২)
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সহ সকল ভাষাতত্ববিদ আরবী হরফে বাংলা লেখার এই উদ্ভট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন কিন্ত তদসত্বেও পাকিস্তান সরকার তাদের মনোভাবের ব্যাপারে অনঢ় থাকে ।
২৩ জুন ১৯৪৯ : পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গী, বিভিন্ন ন্যায্য দাবী দাওয়া পূরনে অস্বীকৃতি এবং ভাষার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ সরকারের নীতির বিরোধিতায় মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ (মুসলিম শব্দটি ১৯৫৫ সালে বাদ দেওয়া হয়), শেখ মুজিবুর রহমান নিযুক্ত হন সহ সাধারণ সম্পাদক হিসাবে । একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও পীর মানকি শরীফ এর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় । পরবর্তীতে এই দুই দল একীভূত হয়ে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর আহবায়ক নিযুক্ত হন । ভাসানী ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ৮ বছর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন । পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রাজপথের আন্দোলন সংগঠনের পাশাপাশি পার্লামেন্টেও রাষ্ট্রভাষা ভাষার দাবীতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে । (৩,৪)
১১ মার্চ ১৯৫০ : কমিউনিষ্ট ভাবধারার ছাত্র নেতা আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় Dhaka University State Language Movement Committee । এই কমিটি ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
এপ্রিল ১৯৫০ : পার্লামেন্টে আরবী হরফে বাংলা লেখার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন দানা বেধে ওঠে । (৫)
সেপ্টেম্বর ১৯৫০ : পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর এবং জনগণের মৈলিক চাহিদা পূরণের উপায় নির্ধারণের লক্ষ্যে গঠিত The Basic Principle Committee (BPC) of the National Constitutional Assembly পার্লামেন্টে রিপোর্ট প্রদান করে । এই রিপোর্টে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয় । BPC রিপোর্ট বিশেষ করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । আওয়ামী মুসলিম লীগ BPC রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালী রাজনৈতিক নেতারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনার পাশাপাশি অন্যান্য দাবী দাওয়ার রূপরেখা প্রণয়নের জন্য Grand National Convention (GNC) আহবান করেন । (৬)
১৪ নভেম্বর ১৯৫০ : পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবিদের সমন্বয়ে গঠিত Committee of Action for Democratic Federation ১৪ই নভেম্বর ১৯৫০ ঢাকায় আয়োজন করে Grand National Convention । GNC থেকে বাঙালীদের মুল দাবীগুলির পাশাপাশি উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব গৃহীত হয় । উল্লেখ্য এই GNC তে পশ্চিম পাকস্তানী কিছু বিরোধী রাজনৈতিক নেতাও অংশ নেন এবং তারাও এই দাবীর প্রতি সমর্থন জানান । (৬)
৭ ডিসেম্বর ১৯৫০ : মৌলানা আকরাম খান এর নেতৃত্বে গঠিত ১৬ সদস্যবিশিষ্ট East Bengal Language Committee আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবকে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং উদ্ভট হিসাবে আখ্যায়িত করে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করে । এই কমিটি রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালত ও শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বতোভাবে বাংলা ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করে । (৫)
১। DEFINING THE FRONTIERS OF IDENTITY : BALANCING LANGUAGE AND RELIGION IN BANGLADESH, Smruti S Pattanaik*
২। Rangalal Sen, “Political Elites in Bangladesh” (Dhaka, UPL, 1986), p. 105.
৩। Talukder Maniruzzaman, Bangldesh Revolution and Its Aftermath, UPL, 1988, pp. 20-21
৪। M.B. Nair, Politics in Bangladesh: A Study of Awami League, 1949-'58, New Delhi: Northern Book Centre, 1990, p. 61 and pp. 248-249
৫ । Martyr Dhirendranath Datta
My tribute to the forgotten Harbinger of the Bengali language movement
By M. Waheeduzzaman Manik
৬ । Constitutional Development, Banglapedia, 1773-1972
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


