somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাক্তার মরিস বুকাইলির মিথ্যাচার

১২ ই জুন, ২০২১ সকাল ৭:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডাক্তার মরিস বুকাইলির নাম ইসলামী জগতে একটি বহুল পরিচিত নাম। অনেক মুসলিম তার লিখিত বই “বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান” নামক বইটি অনেক গর্ব সহকারে সংগ্রহে রাখে। তারা মনে করে যে, মরিস বুকাইলি একজন খৃষ্টান সাদা চামড়ার মানুষ হয়েও যে দাবি করেছেন, বাইবেলে ভুল আছে, কিন্তু কোরআনে কোন ভুল নেই এবং কুরআনের কোন বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের সাথে বিরোধপূর্ণ নয়, এতেই প্রমাণ হয়ে যায়, কোরআন সত্য। তাদের সত্য প্রমাণের মাপকাঠি কতই না নিচু। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন আমার হলের লাইব্রেরিতে বইটি ছিল। আমি বইটি পড়েছি তবে বাইবেল সম্পর্কে আলোচনার অংশ গুলো বাদ দিয়ে। কারণ বাইবেলে যে ভুল আছে তা নিয়ে ডাক্তার মরিস বুকাইলির সাথে আমার কোনো দ্বিমত নেই। আমার অবশ্য বইটি পড়তে খুব কষ্ট হয়েছে। কারণ আমার কাছে বইটি খুবই নিম্নমানের মনে হয়েছে। এটি একগাদা গোজামিল ও ভুল তথ্যে ভরা। পরবর্তীতে আমি অনেক মুসলিম এর কাছ থেকে আহ্বান শুনেছি, “আপনি কি ডাক্তার মরিস বুকাইলির বই পড়েছেন? তিনি প্রমাণ করেছেন যে, কুরআন সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ও সত্য।” আমার তখন মনে হত, এই আবালেরা বলে কি? এই গোজামিল মার্কা নিম্নমানের বই পড়েই ওরা এর লেখকের দাবির সাথে একমত। আমার সন্দেহ জাগে, যারা আমাকে বইটি পড়তে বলে, তাদের মধ্যে কতজন সত্যিকারভাবে বইটি পড়েছে।

আমি এখন বইটির কুযুক্তির কিছু উদাহরণ দিব। তিনি তার বইতে “ভূ-পৃষ্ঠের নকশা” শিরোনামে লেখায় নিম্নোক্ত কোরআনের আয়াত তুলে ধরেছেন, এটা প্রমাণ করতে যে কুরআন বিস্ময়করভাবে বিজ্ঞানসম্মত :-

“তিনি আকাশ মন্ডলী স্থাপন করিয়াছেন স্তম্ভ ব্যতিত-তোমরা দেখিতেছ; তিনিই পৃথিবীতে

স্থাপন করিয়াছেন পর্বতমালা, যাহাতে উহা তোমাদের লইয়া ঢলিয়া না পড়ে।” সূরা লৃকমান ৩১:১০-১১

“এবং আমি পৃথিবীতে সৃষ্টি করিয়াছি সুদৃড় পর্বত যাহাতে পৃথিবী উহাদিগকে লইয়া এদিক ওদিক ঢলিয়া না যায়।” সূরা আম্বিয়া ২১:৩১

“এবং তিনি পৃথিবীতে সুদৃড় পর্বত স্থাপন করিয়াছেন, যাহাতে পৃথিবী তোমাদের লইয়া আন্দোলিত না হয়।” সূরা নাহল ১৬:১৫

“আমি কি করি নাই ভূমিকে শয্যা ও পর্বতসমূহকে কীলক বা খুঁটি।” সূরা আল-নাবা ৭৮:৬-৭

কিন্তু তার উদ্ধৃত করা এই আয়াতগুলো মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গায় যেখানে পর্বত আছে, সেখানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়। আর পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গায় যেখানে কোন পর্বত নেই, সেখানে সবচেয়ে কম ভূমিকম্প হয়। বেশিরভাগ ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে বিশেষ করে টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংযুক্ত অংশ সমূহে। সমুদ্রের তলদেশেও পর্বত আছে। এটা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, সেই পর্বতগুলো সুনামী তৈরীর জন্য দায়ী।

এরপর ডাক্তার বুকাইলি লিখেছেন,

“আধুনিক ভূতাত্ত্বিকদের মতে, পৃথিবী পৃষ্টের ভাজের ওপরে ভিত্তি করে পর্বতসমূহ দন্ডয়মান।

এসব খাজভাজের আয়তন মোটামুটিভাবে দশ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে । এসব ভাজ-

খাজের প্রাকৃতিক অবস্থান থেকেই ভূত্বক দৃড়তা ও স্থিরতা লাভ করেছে।”

তার ভূত্বকের এই দৃড়তা ও স্থিরতা লাভের দাবিও সঠিক নয়।

ডাক্তার বুকাইলির বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ভূতত্ত্বের অধ্যাপক ড. ডেভিড এ ইয়ং বলেছেন,

“একদিকে এটি সত্য যে, অনেক পর্বতমালা ভাজকরা শিলান্তর দিয়ে গঠিত (আর এই ভাজটি

বিশাল আকারের হতে পারে) এই কথা সত্যি নয় যে, এই ভজগুলো ভূপৃষ্ঠকে স্থির রাখে । এই

ভাজগুলোর অস্তিত্ব পৃথিবীর অস্থিরতার একটি কারণ।”

কাজেই পর্বতসমূহ পৃথিবীকে কম্পনের হাত থেকে রক্ষা করে না। তাদের গঠন অতীতে ও আজও পৃথিবীর কাঁপার একটি কারণ।

কুরআনের অনেকগুলো আয়াতে আকাশের সাতটি স্তর এর কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনায় ডাক্তার বুকাইলি নিম্নোক্ত আয়াত গুলোর উল্লেখ করেছেন :-

“তোমরা কি লক্ষ্য কর নাই, আল্লাহ্‌ কীভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন সপ্ত স্তরে বিন্যস্ত আকাশ মন্ডলী?

এবং সেথায় চন্দ্রকে স্থাপন করিয়াছেন আলোরপে ও সূর্যকে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপরূপে।” সূরা নূহ ৭১:১৫-১৬

“তিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আকাশ।” সূরা মূলক ৬৭:৩

“আমি তো তোমাদিগের উর্ধে সৃষ্টি করিয়াছি সপ্ত স্তর এবং আমি সৃষ্টি বিষয়ে অসতর্ক নই।

“জিজ্ঞাসা করো? কে সপ্তাকাশ ও আরশের অধিপতি” ” সুরা মোমেনুন ২৩:১৭, ৮৬

“অতঃপর তিনি আকাশমন্ডলকে দুই দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করিলেন এবং প্রত্যেক আকাশে

উহার বিধান ব্যক্ত করিলেন।” সূরা হামিম আল-সেজদা ৪১:১২

“সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং উহাদিগের মধ্যে অর্তবর্তী সমস্ত কিছু তাহারই পবিভ্রতা ও মহিমা

ঘোষণা করে।” সূরা বনি-ইসরাইল ১৭:৪৪-১

“তিনি পৃথিবীর সব কিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন, তৎপর তিনি আকাশের দিকে

মনোসংযোগ করেন এবং উহাকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন; তিনি সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” সূরা আল-বাকারা ২:২৯

ডাক্তার বুকাইলি দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, কুরআনের এই আয়াত গুলোর সাথে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মিল আছে। তিনি ৪০ কিলোমিটার পুরু বায়ুমন্ডলকে প্রথম আকাশ ধরে নিয়েছেন। এরপর একে এক লক্ষ দিয়ে গুণ করে তাকে দ্বিতীয় আকাশ, তাকে আবার এক লক্ষ দিয়ে গুণ করে তাকে তৃতীয় আকাশ এবং এভাবে সাতটি আকাশের বর্ণনা করেছেন। অথচ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে মহাশূন্যে সব জায়গা গুণগতভাবে একই রকম আর নিরবচ্ছিন্নভাবে সাজানো। ডাক্তার বুকাইলি তার নিজের খামখেয়ালি মতো আকাশকে সাতটি স্তরে বিভক্ত করেছেন, যা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়।

লেখক এরকমভাবে উল্কাপিণ্ড ও অন্যান্য বিষয়েও কুরআনের অবৈজ্ঞানিক তথ্যকে বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবী করার চেষ্টা করেছেন। এর জন্য কেউ যখন কুরআনের সত্যতার প্রমাণ স্বরূপ আমাকে ডাক্তার মরিস বুকাইলির বই পড়তে বলে, তখন আমার খুব হাসি পায়।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০২১ সকাল ৭:৫৮
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×