বাংলাদেশে যে সকল নারীর ক্ষমতায়ন দেখি তাদের অধিকাংশই উচ্চবিত্তের না হয় প্রভাবশালী পরিবারের। এটার পক্ষেও যুক্তি রয়েছে যে, তারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়ে নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন। এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য ছিল না। আমাদের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উচ্চ শিক্ষিত নন। তার একটিই যোগ্যতা- তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। অন্যথায় প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোন সুযোগই তিনি পেতেন না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদও যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা না হতেন তবে তাকে ড. কামাল হোসেন নয়াদিল্লী গিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে দেশে নিয়ে আসতেন না। এরশাদ সাহেবের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদও রাজনীতিতে থাকতেন না যদি না তার স্বামী দেশের রাষ্ট্রপতি না হতেন। বর্তমান স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও উচ্চ শিক্ষিতা ও অভিজাত পরিবারের মানুষ। তাঁর পিতা ছিলেন সচিব ও মা ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। আমাদের সিটিকর্পোরেশনের একমাত্র নারী মেয়র (নগরপিতা) ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ক্ষেত্রেও দেখি- তার পিতা আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জের মেয়র ছিলেন। বিএনপি নেত্রী সেলিমা রহমান এসেছেন আরো উচ্চ পরিবার থেকে। তাঁর পিতা আব্দুল জব্বার খান বিচারপতি ও স্পীকার ছিলেন, ভাই রাশেদ খান মেনন, সাংবাদিক সাদেক খান, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মন্ত্রী-সাংবাদিক এজেএম এনায়েতুল্লাহ খান। আওয়ামী লীগের আইভী রহমানের পিতা ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, স্বামী জিল্লুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী। জহুরা তাজউদ্দিনও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী ছিলেন। ডা. দীপু মনির পিতা এমএ ওয়াদুদও রাজনীতিবীদ ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিতে প্রভাববিস্তার করে উঠে আসা একমাত্র প্রভাববিস্তারকারী নারী হলেন- মতিয়া চৌধুরী। হয়তো বাম রাজনীতি করে উঠে এসেছেন বলে সম্ভব হয়েছে। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও সাহারা খাতুনও ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
ভারতে আমরা কিছুটা ভিন্নতা দেখি। উত্তর প্রদেশে তফশিলী সম্প্রদায়ের নারী জয়ললিতা, মায়াবতী ও মিরা কুমার। মায়াবতী সমাজবাদী দলের প্রধান হয়ে মূখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কংগ্রেস মিরা কুমার লোকসভার স্পীকার ও মন্ত্রী ছিলেন। তামিলনাড়ুর আম্মা খ্যাত অভিনেত্রী ব্রাহ্মণ কণ্যা জয়ললিতা ৬ বার মূখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী ব্রাহ্মণকন্যা হলেও তিনিও উঠে এসেছেন পাঠপর্যায় থেকেই। চিরকুমারী জয়ললিতা ও মমতা ব্যানার্জী স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাববিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। জয়লতিতা আকস্মিক মৃত্যুবরণ করার খবর পেয়ে বহু কর্মীই আত্মহত্যা করেছিলেন। সাদাসিধে পোশাকের মমতাও অর্জন করেছেন ঈর্ষনীয় সাফল্য। তিনি দল প্রতিষ্ঠা করে তার প্রধান হয়েছেন। তবে ইন্দ্রিরা গান্ধীও এসেছেন অভিজাত ও রাজনৈতিক পরিবার থেকে। তিনি বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন। সোনিয়া গান্ধীও তাই। তার পরিচয় তিনি রাজিব গান্ধীর স্ত্রী।পাকিস্তানে আমরা দেখেছি বেনজির ভূট্টোকে। তিনি যদিও অক্সফোর্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবুও জুলফিকার আলী ভূট্টোর কন্যা হিসেবেই তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। পারিবারিক রাজনীতি থেকে আসা অং সান সুচি নোবেল পেয়েও মায়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছেন এবং রুহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর প্রতি তার রাক্ষুসে চেহারা প্রদর্শন করেছেন। নেত্রী হিসেবে সারা ভারতে বিজেপি নেত্রীত্রয়ী উমা ভারতী, সুষমা স্বরাজ ও স্মৃতি ইরানী খ্যাতি পেয়েছেন সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে। কিন্তু কংগ্রেস এমনকি সিপিআই/এমও পারেনি এমন নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। তেলেগু-দেশমের রেণুকা চৌধুরী, কংগ্রেসের মার্গারেট আলভা, জনতা দলের প্রমিলা দণ্ডবতে, সিপিআইর গীতা মুখার্জী সুপরিচিত হয়ে উঠতে পারেননি।
সারা পৃথিবীতেও এই সংকট রয়েছে। বিল ক্লিনটনের স্ত্রী হওয়া ও নিজেকে বারবার সিনেটর/পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে সফল প্রমাণিত করার পরেও হয়তো নারী হওয়ার কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিলারী ক্লিনটন হেরে যান অর্বাচীন ডুনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। নিউজিল্যান্ড ও জার্মানীর মতো দেশে যদিও জাসিন্ডা ও মার্কেল সফলভাবেই দায়িত্ব পালন করে নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। উন্নত দেশগুলোতেও পৃথিবীর অর্ধেক নারীরা এখনও এক তৃতীয়াংশ আসনও গ্রহণ করতে পারেননি। টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী, রূপা হক ও আফসানা বেগম- বাংলাদেশের যে ৪ জন ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট মেম্বার হয়েছেন তারা সকলেই নারী। বিশেষ করে ওখানে তারা নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন এবং বারবার নির্বাচিত হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় নারী নেতৃত্বের করুণ হালের অন্যতম কারণ মৌলবাদী শিক্ষানীতি এবং এখনো ব্যাপক সংখ্যক মানুষ ধর্মশাস্ত্রগুলোতে বিবৃত নারীকে হীনস্থানে রাখতে বদ্ধপরিকর হওয়া। ভারতে ব্যাপকহারে কন্যা সন্ত্রানের ভ্রুণ হত্যা ও বিধবা বিবাহের বন্ধ রাখার বিষয়ে সামাজিক ভাবাদর্শ তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানের অবস্থা আরো খারাপ।
গ্রামীণ নারীরা এখনো স্বামীর নির্যাতন থেকে বের হতে ডিভোর্স দিতে সাহস পান না। এক্ষেত্রে অবশ্য শহরগুলো কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের মেয়েরা ডিভোর্সে এগিয়ে রয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে ডিভোর্সের আবেদন পুরুষের চেয়ে নারীরা দ্বিগুনেরও বেশি করেন। নারী মুক্তির আন্দোলন সফল করতে হলে নারীর ক্ষমতায়ন দরকার আর এজন্য দরকার নারীর সুশিক্ষা, উপার্জন ও সম্পদের মালিক হওয়া। ধর্মীয় ও সামাজিক বাঁধা অতিক্রম করার জন্য সংগ্রামে নারীকেই হাল ধরতে হবে। আজ নারীরা যে পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন, তাতে তাদের সংগ্রামই মূল ভূমিকা রেখেছে। সেটা শিক্ষা অর্জনে হোক, ভোটাধিকার অর্জনে হোক, গৃহের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ হোক, নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার হোক- সব তারা সংগ্রাম করেই অর্জন করেছে। কেউ দিয়ে যায়নি। বিশ্বজুড়ে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ছে, নেতৃত্ব বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে। এই ধারা বজায় রাখতে হলে, মৌলবাদী ও রক্ষণশীল চক্রের বিছানো জাল ছিন্ন করেই এগিয়ে যেতে হবে। শফিক রেহমানের যায়যায়দিন পত্রিকায় সংরক্ষিত নারী সংসদসদস্যদের বলেছিলেন ত্রিশ সেট অলঙ্কার। পত্রিকাটি নিষিদ্ধ হয়েছিল তবে ওই সংখ্যাটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। পদ যদি আলঙ্করিক হয় তবে তা নারী উন্নয়নে তেমন কাজে আসে না। তবুও না থাকার চেয়ে সংরক্ষিত আসন থাকা অনেক ভাল। নারী নিজের যোগ্যতায়, সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠা পেলেই তারা নারী উন্নয়নে প্রকৃত ভূমিকা রাখতে পারে এবং এটাই প্রকৃত ক্ষমতায়ন। শুধু অভিজাত ও রাজনৈতিক পরিবারের নয়, যোগ্যতা থাকলে যদি সব পর্যায়ের নারীরাই রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ পদে যেতে পারে তবেই নারীর জাগরণ ঘটবে, নারী মুক্তির সম্ভাবনা বাড়বে।