কল্পনা দত্ত, বৃটিশ আমল
কল্পনা দত্তকে অগ্নিকন্যা উপাধি দিয়েছিলেন সয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বোমা পিস্তল যার সঙ্গী তিনিতো অগ্নিকন্যাই। অনেকেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নামের আগেও অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা ব্যবহার করেন। চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাবে অভিযানের নেতৃত্ব ছিল কল্পনা দত্তের হাতেই। কিন্তু ঘটনা ঘটানোর আগেই তিনি গ্রেফতার হয়ে যান বলে দায়িত্ব পরে প্রীতিলতার উপর। কল্পনা দত্তের জন্মও চট্টগ্রামে। তিনিও খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন মেট্রিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে ৪র্থ হয়েছিলেন। কলকাতার বেথুন কলেজে পড়ার সময় তিনি নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকান্ডে জরিয়ে পরেন। স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে প্রতি সকালে কলেজ কম্পাউন্ডে সাইকেলে ঘুরপাক খাওয়া, প্রতি রোববার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন তিনি। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম এবং কানাই লাল দত্তের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বেথুন কলেজ-এ গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘ-এ যোগদান করেন। তিনি কোর্ট ও জেলে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন যাতে বিপ্লবীরা পালাতে পারেন। কিন্তু পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। চট্টগ্রামে ফেরার সময় তিনি কিছু বিষ্ফোরক নিয়ে আসেন। নিজে তৈরি করেন গান কটন। তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মীতে যোগ দেন এবং তাঁর সাথে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলার আগে তা সমীক্ষা করে দেখতে গিয়েই তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। জামিনে বের হয়েই আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৩৩ সালে তাদের ডেরা পুলিশ ঘিরে ফেললে সূর্যসেন গ্রেফতার হলেও কল্পনা দত্ত পালাতে সক্ষম হন*। বিচারে সূর্যসেনকে ফাঁসি দেয়া হয়। কল্পনা দত্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে আবারো গ্রেফতার হন। কল্পনা দত্তেরও ফাঁসি হতো। মামলার রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ বলেন, ‘মেয়ে বলে এবং বয়স কম বলেই কল্পনা দত্তকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা গেল না। রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু সি এফ এভরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্য অপরিসীম পরিশ্রম ও আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গভর্নরের কাছেও গিয়েছিলেন। গান্ধীজি কল্পনার বাবাকে বলেছিলেন, সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে চেষ্টা করবেন। তবে ১৯৩৯ সালের ১ মে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর তিনি পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। জেলে থাকতেই কমিউনিস্টদের সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছিলেন। নারী ও কৃষকদের সংগঠিত করতে থাকেন। চট্টগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি নির্বাচনও করেন। দেশ ভাগ হয়ে গেলে তিনি ভারতে চলে যান এবং ৮২ বছর পর্যন্ত আমৃত্য নারী আন্দোলনে সক্রিয় থাকেন। তাঁদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেছেন দীপিকা পাড়ুকোণ।
*তিনি সূর্যসেনের সাথেও গ্রেফতার হতে পারেন। বিভিন্ন স্থানে দুরকম তথ্যই রয়েছে।
মতিয়া চৌধুরী, পাকিস্তান আমল
তখন মতিয়ার বয়স মাত্র ২২ বছর। সংবাদ অফিসে সাংবাদিকতা করতেন বজলুর রহমান। *মতিয়া এসেই বললেন, চল বিয়ে করবো। বজলুর রহমান উঠলেন এবং তাদের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। তখনই সে অগ্নিকন্যা। ইডেন কলেজে পড়ার সময়ই বাম ধারার ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হন। এ সময়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় এবং আগুনঝরা বক্তব্য রাখায় খেতাব পান অগ্নিকন্যার। আগুনের তেজ সবসময়ই ছিল তার মধ্যে। দলে বিভক্তি দেখা দিলে তিনি নেতৃত্ব দেন মস্কোপন্থী গ্রুপের। এরপর যোগদেন ন্যাপ-এ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে ১৯৭৯ সালে যোগদান করেন। এ সময় আব্দুস সালাম আজাদ রসিকতা করে বলেছিলেন, আমাদের এখানে এলে তো পানিকন্যা হয়ে যাবে। তার বিরোধীরা কেউ কেউ তেলকন্যা বলেও কটাক্ষ করেছেন। মতিয়া তা হননি, এখনো মানুষ তাকে অগ্নিকন্যা বলতেই ভালবাসে। রাজপথে সংগ্রাম করে ১৫ বার কারাবরণ করেছেন, রাজপথে পুলিশের লাঠির ঘা খেয়েছেন, আত্মগোপনে থেকেছেন কিন্তু নতজানু হননি। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি কৃষিমন্ত্রী হয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও দুবার মন্ত্রী হয়েও অতি সাধারণ জীবন যাপন করেছেন এবং করছেন, দুর্নীতি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। স্থানীয় দুর্বৃত্তরা বারবার সততার জন্য তাকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অগ্নিপরীক্ষায় তিনি বহুবারই বিজয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাও বিভিন্ন বক্তব্যে বলেন, ছাত্র জীবনে তিনি ছিলেন মতিয়া চৌধুরীর ভক্ত। ওয়ান এলিভেনের সময়ও মতিয়া তেজদীপ্ত ভূমিকা রাখেন। তিনি এখনো মোটা কাপড় পরেন, সাদামাটা চলাফেরা করেন, সাজগোজ কখনোই করেননি। মন্ত্রী হয়েও পুলিশ প্রটেকশনের গাড়ি নেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে দেখা যেত বাজার-সদাই করতে। লোভ-লালসা তাকে স্পর্শ করেনি।
*একজন সাংবাদিকের কাছে শোনা।
লাকি আক্তার, বাংলাদেশ
একেকটা সংগ্রাম একেকজনকে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেয়। লাকি আক্তার যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় গণজাগরণমঞ্চ। সেখানে দুর্দান্ত ভূমিকা তাকে প্রথমে শ্লোগান কন্যা এবং পরবর্তীতে অগ্নিকন্যার খেতাব এনে দেয়। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হন। নারীদের মধ্যে তিনি তৃতীয় আর প্রথম ছিলেন আরেক অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী। তার আগে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামী আব্দুল কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণা করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তার প্রতিবাদেরই ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে আন্দোলন শুরু হয়। মানুষ ধরে নেয় সরকার বদল হলেই কাদের মোল্লা মুক্তি পেয়ে যাবে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে যারা মেনে নিতে পারেননি তারা শাহবাগে অহিংস বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করে। একসময় তা দেশব্যাপী বিক্ষোভে রূপ নেয়। এই মঞ্চে জ্বালাময়ী শ্লোগান দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন লাকি আক্তার। মুষ্ঠিবদ্ধ মাইক্রোফোনে স্লোগানের মাধ্যমে সবাইকে আলোড়িত করেন তিনি। তার ছন্দবদ্ধ স্লোগানে উপস্থিত সবাইকে বিমোহিত করে ফেলেন। তার উদ্দীপ্ত স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত থাকত শাহবাগ চত্বর।
শাহবাগের আন্দোলনে যিনিই এসেছেন, তেজোদীপ্ত কণ্ঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেছেন, ‘ক-তে কাদের মোল্লা...তুই রাজাকার..তুই রাজাকার। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, হামলা ও বিরোধীতার মুখেও গর্জে উঠতো শ্যামলা রঙের তেজোদীপ্ত লাকির বজ্রকণ্ঠ। তার স্লোগানের উদ্দীপনা জাগিয়ে চলত শাহবাগের ‘গণজাগরণ’/’প্রজন্ম চত্বর’।
লাকির স্লোগান শুনে কেউই চুপ থাকতে পারেননি। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশুসহ গণজাগরণ চত্বরে উপস্থিত সবাই তার স্লোগানে গলা মিলিয়ে উচ্চারণ করেছেন- ‘একটাই দাবি, ফাঁসি ফাঁসি’। কাদের মোল্লাসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সারা জাতিকে এক সুঁতোয় গেঁথেছেন অমিত সাহসী কন্যা লাকি আক্তার। ফলও এসেছিল। আদালত আপীলে ফাঁসি দিয়েছিল এবং তা কার্যকর হয়েছিল। তিনি এখন সিপিবির গণসংগঠনে কাজ করছেন। কৃষকদের সংগঠিত করছেন। কল্পনা দত্তও কাজ করেছিলেন কৃষকদের সাথে।
বিস্ময়কর যে আমাদের তিন অগ্নিকন্যারই সম্পর্ক রয়েছে বাম রাজনীতির সাথে।
তথ্যসূত্র:
রাজনীতি ও নারী শক্তি ক্ষমতায়নের নতুন দিগন্ত, লেখক কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
রাস সুন্দরী থেকে রোকেয়া, লেখক গোলাম মুর্শিদ
অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্তের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, লেখক- সুব্রত বিশ্বাস
জাতিরপিতা.ওয়াল্ডপ্রেস.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০২০ দুপুর ২:৪০